বিআরটি প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ কাজ চলছে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায়। জনবহুল এই মোড়ে প্রতিদিন কয়েক হাজার যানবাহন ও মানুষের চলাচল থাকলেও নেই কোনো নিরাপত্তাবেষ্টনী। ভারী যন্ত্রপাতি ওঠানো–নামানোর পাশাপাশি চলছে রেলিং স্থাপনের কাজ। চলমান এসব কাজের মধ্যেও নিচ দিয়ে চলাচল করছে গণপরিবহন ও সাধারণ মানুষ।
শুধু চান্দনা চৌরাস্তা নয়, চলমান বিআরটি প্রকল্পের আবদুল্লাহপুর থেকে গাজীপুরের শিববাড়ী মোড় পর্যন্ত প্রায় ১৬ কিলোমিটার সড়কে একই চিত্র দেখা গেল। দুর্ঘটনা এড়াতে কিংবা সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে নেই জোরালো কোনো পদক্ষেপ। মাঝেমধ্যে ওপরে কাজ চলমান আর নিচে যানবাহন আটকানোর জন্য ছোট ছোট টুল বসিয়ে রাখতে দেখা গেল। কিন্তু ধারেকাছে বাস র্যাপিড ট্রানজিটের (বিআরটি) কোনো শ্রমিক বা কর্মচারীকে পাওয়া যায়নি।
গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় গত ১৫ জুলাই উড়ালসড়কের লঞ্চিং গার্ডার পড়ে এক নিরাপত্তাকর্মী নিহত ও দুজন আহত হন। সর্বশেষ ১৫ আগস্ট উড়ালসড়কের গার্ডারের চাপায় রাজধানীর উত্তরায় প্যারাডাইস টাওয়ারের সামনে একটি প্রাইভেট কারের পাঁচ আরোহী নিহত ও দুজন আহত হন। ওই দিন বিকেলে ব্যস্ত সড়কে গার্ডার ওঠানোর কাজ করার সময় একটি ক্রেন কাত হয়ে গেলে ওই দুর্ঘটনা ঘটে।
গতকাল বুধবার আবদুল্লাহপুর থেকে শিববাড়ী মোড় পর্যন্ত প্রায় পুরো সড়কই কাটা দেখা গেল। কোথাও সড়ক বিভাজক নেই। যত্রতত্র পড়ে আছে ইট, বালু, সিমেন্ট, রডসহ নানা নির্মাণসামগ্রী। বিভিন্ন জায়গায় খুঁড়ে রাখা হয়েছে বড় বড় গর্ত। এর মধে৵ চলমান কাজের কোথাও ব্যবহার করা হয়নি নিরাপত্তাবেষ্টনী। ফলে পুরো সড়কেই চলাচলে দেখা দিয়েছে নিরাপত্তাঝুঁকি।
আবদুল্লাহপুর থেকে টঙ্গীর স্টেশন রোড পর্যন্ত চলছে ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ। ফ্লাইওভারের নিচে বা উপরে ব্যবহার করা হয়নি কোনো নিরাপত্তাবেষ্টনী। খোলামেলা পরিবেশেই চলছে মালামাল ওঠানো–নামানোর কাজ।
জানতে চাইলে বিআরটি প্রকল্পের সহকারী প্রকৌশলী মো. মহসিন প্রথম আলোকে বলেন, মহাসড়কে চলমান কাজে নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অবশ্য কয়েকটি স্থানে নিরাপত্তাব্যবস্থা আগেও নেওয়া হয়েছিল।
স্টেশন রোড পার হয়ে মন্নু গেট এলাকায় যেতেই বিশাল কর্মযজ্ঞ চোখে পড়ে। ব্যস্ত সড়কের ঠিক মাঝখানে চলছে গার্ডার বসানোর জন্য পিলার নির্মাণের কাজ। এ কাজ করতে গিয়ে সড়কের মাঝবরাবর তৈরি করা হয়েছে বিশাল গর্ত। সেখানে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বেরিয়ে আছে রড। পাশেই পড়ে আছে লোহালক্কড়। ক্রেনের সাহায্যে সড়কে চলচলকারী গাড়ি ও লোকজনের ওপর দিয়ে তোলা হচ্ছে ভারী নির্মাণসামগ্রী।
একইভাবে স্টেশন রোড থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত চেরাগআলী, মিল গেট, টঙ্গী কলেজ গেট, হোসেন মার্কেট, কুনিয়া তারগাছ, বোর্ডবাজার, বাসন সড়ক, ভোগরা বাইপাসসহ অন্তত ১৭টি জায়গায় ঝুঁকিপূর্ণভাবে কাজ করতে দেখা যায়। এসব জায়গার কোথাও বিআরটির স্টেশন, কোথাও ফ্লাইওভার, কোথাও চলছে পদচারী সেতু নির্মাণের কাজ। এসব স্থানেও নিরাপত্তাবেষ্টনী ব্যবহার করতে দেখা যায়নি। এর মধে৵ কোনো কোনো জায়গায় নামে মাত্র ব্যবহার করা হয়েছে বাঁশ ও কাঠের বেড়া।
কথা হয় মিল গেট এলাকায় মো. জাকির নামের এক ট্রাফিক পুলিশ সদস্যের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা ২৪ ঘণ্টাই সড়কে থাকি। সারা দিন এসব দেখতে দেখতে আমরা এখন ক্লান্ত। এ রাস্তায় ডিউটিতে (দায়িত্বে) আসলেই মনে একধরনের ভয় কাজ করে। একদিকে যানবাহন, অন্যদিকে এসব কাজে ঝুঁকি—সব মিলিয়ে হতাশ থাকি।’
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায়। প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত এখানে হাজারো মানুষ চলাচল করেন। কিন্তু এখানেই বিশাল জায়গা নিয়ে চলছে উড়ালসেতু নির্মাণের কাজ। চৌরাস্তা এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ইট, বালু সিমেন্টসহ নানা জিনিস। মাথার ওপর ঝুলতে দেখা যায় ভারী যন্ত্রাংশ ও নির্মাণসামগ্রী। কিন্তু এসবের নিচে রাখা হয়নি কোনো বেষ্টনী। ফলে প্রতিদিন হাজারো মানুষকে পথ চলতে হচ্ছে এসব ঝুঁকি মাথায় নিয়ে।
সড়কের এমন অব্যবস্থাপনায় চরম হতাশ স্থানীয় বাসিন্দারা। চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় একটি গাড়ির সুপারভাইজারের কাজ করেন মো. নজরুল ইসলাম। পাঁচ বছর ধরে এখানেই থাকেন তিনি। তিনি বলেন, ‘মাথার উপর তাকালেই মনে হয় উপর থেইক্যা কিছু একটা পড়ল। এইহানে ডিউটি করি প্রায় পাঁচ বছর। এই পাঁচ বছর ধইর্যাই এমন ভয়ের মধ্য দিয়া যাইতেছি। সারাক্ষণই ভয়ে ভয়ে থাকি।’
চান্দনা চৌরাস্তা থেকে গাজীপুরের শিববাড়ী মোড় পর্যন্ত বাকি চার কিলোমিটারে চলছে একই প্রকল্পের কাজ। সেখানেও দেখা গেছে চরম অবহেলা ও গাফিলতি। এর মধে৵ সার্ডি রোড, গাজীপুর জেলা কারাগার, কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ শিববাড়ী মোড় পর্যন্ত অনন্ত ছয়টি জায়গায় প্রকল্পের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ চলমান দেখা গেল।
জানতে চাইলে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গাজীপুরের ওপর দিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য যানবাহন চলাচল করে। বিআরটির কাজ শুরু করার আগেই অনেকবার প্রকল্প কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। তখন তাঁরা নিরাপত্তাব্যবস্থা, ধুলাবালি রোধ, বিকল্প রাস্তা নির্মাণসহ নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন; কিন্তু প্রকল্প কর্মকর্তারা তার কিছুই করেননি।