তরুণীর ঘাটতিগুলো শুনে তদবিরকারী সাহেব বললেন, ‘শিখিয়ে পড়িয়ে নেবেন’

বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) মহাপরিচালক হিসেবে কর্মজীবনের (২০১৬-২০২১) শেষ অধ্যায়টি পার করেছেন হারুন রশীদ। এর আগে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে নানা পদে কাজ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতার বয়ান তিনি দিয়েছেন তাঁর ‘আমলাবেলা’ নামের আত্মজৈবনিক বইয়ে। গত বইমেলায় প্রকাশিত বইটিতে তিনি বিটিভিতে নিজের চাকরির পর্বকে বর্ণনা করেছেন ‘এ যে ভীষণ যন্ত্রণা’ শিরোনাম দিয়ে। এই পর্বের বিশেষ অংশগুলো নিয়ে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। আজ থাকছে দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব

কথায় বলে, সূর্যের চেয়ে বালির উত্তাপ বেশি। বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি) নেতারা যতটা না দাপট দেখান, তার চেয়ে ঢের বেশি চোটপাট করেন তাঁদের তদবিরে অনুষ্ঠান করতে আসা তথাকথিত তারকা বা রাজনৈতিক দলের আদর্শের ধারক–বাহকেরা। বইটিতে অনেক উদাহরণ আছে। এখানে শুরুতে দুটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো বিটিভির অনুষ্ঠানের নেপথ্যে কী ঘটে, তা পাঠককে জানাতে।

প্রথম: মাতৃভক্ত সন্তান

এক সুদর্শন যুবক। খুব সাধারণ মানের গানের শিল্পী তিনি। ছাত্রজীবনে যুক্ত ছিলেন বৃহত্তর রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনে। সেই সূত্রে অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও উপস্থাপনা করতে তাঁর বিটিভিতে শুভাগমন। এই মাতৃভক্ত সন্তান নিজের পরিকল্পনায় একটি অনুষ্ঠানের পাশাপাশি অবিলম্বে তাঁর মায়ের পরিকল্পনায় একটি অনুষ্ঠানের উপস্থাপনা শুরু করেন।

সাবেক মহাপরিচালক হারুন রশীদ লিখেছেন, ‘দুই অনুষ্ঠানেই তিন–চারটি গান, একাধিক নিম্নমানের নৃত্য পরিবেশন করা হতো। সাথে থাকত যুবকের উপস্থাপনা। প্রতি অনুষ্ঠানে সে নিজেও একটি করে গান গাইত। মানসম্মত না হওয়ায় বিটিভির অনুষ্ঠান বিভাগ তার একটি অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। আর একটি অনুষ্ঠানের মান উন্নয়নের প্রচেষ্টা নেয়।’

এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া হলো সাংঘাতিক। প্রতিভা বিকাশের প্রতিবন্ধকতা বলে কথা! এই তরুণ কারও তদবির আর নিজের যোগ্যতায় (ছাত্রসংগঠন করা) এতটা দূর এসে যদি বাধাপ্রাপ্ত হন, তাহলে তো হইচই বাধিয়েই ফেলবেনই!

হারুন রশীদের ভাষায়, ‘এ জন্য ভীষণ হইচই শুরু করে দেয় যুবক। এমনিতেই অনুষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তাদের প্রতি তার অভিযোগের অন্ত ছিল না। তাকে যথাসময়ে স্টুডিও দেওয়া হয় না, তার অনুষ্ঠানের বাজেট কম, সম্মানী হিসেবে তাকে প্রাপ্যতার চেয়ে কম অর্থ দেওয়া হয়, ইত্যাদি। তার অভিযোগ করার ধরন ছিল উদ্ধত ও অমার্জিত।

কর্মকর্তাদের প্রতিনিয়ত হুমকি-ধমকি দিত সে। বদলি, চাকরি থেকে বিদায় করার ভয় দেখাত। কারও মতামত ও সিদ্ধান্ত তার পছন্দ না হলে সে তাকে ভিন্ন তরিকার লোক, রাজাকার, অসৎ, চরিত্রহীন এসব বলে গালিগালাজ করত। শুধু মুখে বলেই ক্ষান্ত হতো না। অনেক সময় তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন দপ্তরে লিখিতভাবে মিথ্যা ও মনগড়া অভিযোগ জানাত।

‘তার অভিযোগের টার্গেট হতো প্রধানত অনুষ্ঠান প্রযোজক ও অনুষ্ঠান অধ্যক্ষরা এবং ঢাকা কেন্দ্রের জেনারেল ম্যানেজার। কখনো কখনো ডিডিজি ও ডিজির বিরুদ্ধেও অভিযোগ করত সে’, লিখেছেন হারুন রশীদ।

দ্বিতীয় ঘটনা

এবারের জনের কথা সরাসরি সাবেক মহাপরিচালকের লেখা থেকেই পড়ে নেওয়া যাক, ‘একজন তরুণীর কথা বলি। তরুণী সুন্দরী। তবে মিডিয়া সম্পর্কে তার তেমন ধারণা নেই। লেখাপড়াও তেমন করেছে বলে মনে হয় না। মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী নীতিনির্ধারক বললেন, ওই তরুণীকে বিটিভি থেকে একটু সহযোগিতা করতে হবে।সহযোগিতা মানে তাকে কোনো অনুষ্ঠানে যুক্ত করতে হবে এবং নিয়মিতভাবে সে যাতে টাকাপয়সা পায়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। তরুণী দেখা করল আমার সাথে। খুব উদ্ধত ও বেপরোয়া তার আচরণ, কথা বলার ভঙ্গি। অনেক ভাবনাচিন্তা করে আমি তাকে প্রতি সপ্তাহে প্রচারিত জনপ্রিয় একটি অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা হিসেবে কাজে লাগানোর জন্য সংশ্লিষ্টদের বলে দিলাম। প্রতি মাসে পাঁচ দিন প্রচারিত হয় ওই অনুষ্ঠান। তাকে দুটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হলো। প্রথম দিনেই ঝামেলা বাধালেন সেই তরুণী। প্রযোজক ও অন্য সবার চেয়ে ঢের বেশি সম্মানী দাবি করলেন তিনি। প্রযোজক বোঝালেন নিয়ম আছে, নীতিমালা আছে, তিনি ইচ্ছে হলেই যথেচ্ছ সম্মানী দিতে পারেন না। তরুণী আরও রেগে আগুন। তেজোদৃপ্তা হয়ে জানিয়ে দিলেন, ওসব নিয়মনীতি শিকেয় তুলে রাখুন, তাকে বেশি টাকা দিতে হবে নয়তো প্রযোজকের বারোটা বাজিয়ে ছাড়বেন। সে ক্ষমতা তার আছে।’

শুটিং শেষে নিরুপায় প্রযোজকেরা এসে মহাপরিচালককে জানালেন সেই কথা।মহাপরিচালক তখন তরুণীর আচার-আচরণ এবং কাণ্ডকারখানার কথা জানালেন যাঁর তদবিরে তরুণীটির আগমন, সেই ঊর্ধ্বতন নীতিনির্ধারককে। নীতিনির্ধারক উল্টো কাহিনি শোনালেন মহাপরিচালককে। ‘তিনি বললেন: “ওই অনুষ্ঠান তো মাসে পাঁচ দিন হয়। তাকে মাত্র দুটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করতে দিয়েছেন কেন? ওকে পাঁচটি অনুষ্ঠানই উপস্থাপনা করতে দিন।” আমি তরুণীর ঘাটতিগুলো তুলে ধরলে নীতিনির্ধারক সাহেব বললেন: “শিখিয়ে পড়িয়ে নেবেন।”’

এরপর জনপ্রিয় ওই অনুষ্ঠানের একক উপস্থাপিকা হয়ে গেলেন ওই তরুণী। ফলে ক্রমাগত দর্শক মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করলেন দীর্ঘ সময়ের জনপ্রিয় ওই অনুষ্ঠান থেকে। একসময় অনুষ্ঠানের স্পনসর বিজ্ঞাপন দেওয়া বন্ধ করে দিল। এর মধ্যে ওই তরুণীকে বিটিভির আরও কয়েকটি কমিটির সদস্য করা হলো। সদস্য করা হলো জাতীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ এক কমিটিরও।

‘রুনা লায়লার দোষ নেই, যত দোষ আমার বেলায়’

অনেকেই আছেন গানের চেয়ে টিভি পর্দায় নিজের সৌন্দর্য, বেশভূষা, গয়নাগাঁটির প্রদর্শনেই থাকেন বেশি মনোযোগী। এমন এক সংগীতশিল্পীর ধৃষ্টতার বিবরণ দিয়েছেন লেখক তাঁর বইয়ে। কোনো আহামরি গায়িকা তিনি নন। তবে গান করার পাশাপাশি  তিনি তথ্যমন্ত্রীর দপ্তরের তদবিরে গানের একটি অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাকারী (?) ও উপস্থাপিকার দায়িত্বও পালন করেন। তাঁর অনুষ্ঠানের গায়ক-গায়িকারা সিডি বাজিয়ে নিজেদের গানের সঙ্গে ঠোঁট মেলান। যথারীতি এ অনুষ্ঠানেও থাকে তিন–চারটি গান, একটা কবিতা আবৃত্তি। আর থাকে উপস্থাপিকার নিজের গাওয়া এক বা একাধিক গান।

প্রিভিউ কমিটির মাধ্যমে অনুষ্ঠান যাচাই করিয়ে নেওয়ার জন্য বছরে কোটি টাকা খরচ হয় বিটিভির শিল্পী সম্মানী খাতে। বিস্ময়কর একটা ব্যাপার হলো, একটি চলচ্চিত্র একবার প্রিভিউ হওয়ার পর একবারই বিটিভিতে দেখানো হয়। সেই ছবি কয়েক দিন পর আবার দেখাতে হলে আবারও প্রিভিউ কমিটিতে পাঠাতে হয়।

লেখকের ভাষায়, ‘এক অনুষ্ঠানে গায়িকার সাজসজ্জা এবং গান পরিবেশনার ঢং দেখে আমি কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। গায়িকা–কাম উপস্থাপিকার সাজসজ্জা বিয়ের কনেদের মতো। গলায়, হাতে, কানে, নাকে ঢাউস ঢাউস সাইজের অলংকার। দুই হাতের আট আঙুলে আংটি। গান পরিবেশনের সময় যতটা না গানের প্রতি মনোযোগী ছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি মনোযোগ দিয়ে অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে সে তার আংটি এবং অন্যান্য অলংকার প্রদর্শন করছিল। আমি তাকে সরাসরি কিছু না বলে সংগীত বিভাগের প্রধানকে দিয়ে আমার পর্যবেক্ষণ জানিয়েছিলাম। আমার মতামত শুনে সে নাকি বলেছিল, “রুনা লায়লা গান গাওয়ার সময় আঙুল, আংটি দেখালে অসুবিধা নাই। আমরা দেখালেই দোষ?” এ রকম বেয়াদবকে কী শাস্তি দেব ভেবে পাচ্ছিলাম না।’

অনুষ্ঠান শুরু হলে বন্ধ করা কঠিন

বিটিভিতে সম্প্রচার হওয়া অনুষ্ঠানের শুরু আছে, কিন্তু শেষ নেই। সাবেক মহাপরিচালক লিখেছেন, কোনো অনুষ্ঠান একবার শুরু হলে সেটা বন্ধ করা কঠিন হয়ে পড়ে। হোক সেটা তদবির বা নানা রকম চাপের কারণে শুরু করা অনুষ্ঠান। দেশের একজন বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সপ্তাহে একটি করে অনুষ্ঠান করেন। সে অনুষ্ঠানে তিনি বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল মানুষদের সঙ্গে কথা বলেন শুধু। অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্ট বিটিভির প্রযোজক ও অন্যরা অনেকবার তাঁকে বলেছেন, যাঁকে স্টুডিওতে আনা হয়, তাঁর জীবন ও সফলতার ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র অনুষ্ঠানের শুরুতে উপস্থাপন করলে ভালো হয়। কিন্তু ওই ব্যক্তিত্ব প্রামাণ্যচিত্র বানানোর কষ্টটা নিতে চাননি। তাঁরা ২০১৮ সালে হিসাব করে দেখেছেন, ম্যাড়মেড়ে, অনাকর্ষণীয় এ অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা, উপস্থাপনা এবং স্ক্রিপ্ট লেখা বাবদ ওই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব প্রতি অনুষ্ঠানে ১৪ হাজার টাকা করে ১০ বছরে বিটিভি থেকে প্রায় ৭০ লাখ টাকা সম্মানী নিয়েছেন।

হারুন রশীদ লিখেছেন, ‘দক্ষ ও সৃজনশীল অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের অভাব। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য শক্তির তদবিরকারীদের ভিড়ে মেধাবী ও সৃজনশীল পরিকল্পনাকারী, লেখক ও উপস্থাপকেরা ভিড়তে পারেন না বিটিভির ধারেকাছে।’

এক প্রথিতযশা নৃত্যশিল্পী ওই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকেও ছাড়িয়ে গেছেন। এই জ্যেষ্ঠ নৃত্যশিল্পী প্রতি সপ্তাহে একটি করে দলীয় নৃত্যানুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন। অনুষ্ঠানে তিনি নিজেও একটি নাচ পরিবেশন করেন। নাচের দল নিজেদের তৈরি করা নাচ পরিবেশন করে। অথচ বিশিষ্ট ওই নৃত্যশিল্পী প্রতি অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিচালনা করার জন্য বিটিভি থেকে পারিশ্রমিক নেন। নাচের দলগুলোকে দলীয়ভাবে সম্মানী দেওয়া হয়। বিটিভি ঢাকা কেন্দ্র হিসাব করে দেখেছে, ওই নৃত্যানুষ্ঠান পরিকল্পনা, উপস্থাপনা, নৃত্য পরিচালনা ও অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশনা বাবদ তিনি প্রতি অনুষ্ঠানে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা হিসাবে ১০ বছরে বিটিভি থেকে প্রায় দুই কোটি টাকা সম্মানী নিয়েছেন। উপরন্তু নাচের দলগুলোর কাছ থেকেও তিনি সম্মানী আদায় করেন বলে শোনা গেছে।

এক সিনেমা যতবার দেখানো হবে, ততবার প্রিভিউ কমিটি

বিটিভিতে দুটি ‘প্রিভিউ কমিটি’ আছে, যাদের কাজ হলো বেসরকারিভাবে নির্মিত অনুষ্ঠান ও চলচ্চিত্র পর্যালোচনা করে তা সম্প্রচার করা যাবে কি যাবে না, সেই মত দেওয়া। প্রথম দিকে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা শিল্পী ও সংস্কৃতিজনেরা এর সদস্য ছিলেন। ক্রমান্বয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের স্থলাভিষিক্ত হতে থাকেন দলীয় লোকজন (সংস্কৃতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দলীয় লোকজন নয়)। প্রিভিউ কমিটির সদস্যদের অন্যতম একটি শর্ত থাকে যে তাঁরা বিটিভির অনুষ্ঠান বা অন্য কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবেন না। কিন্তু তাঁরা যুক্ত থাকেন নানা কাজের সঙ্গে। শুধু অনুষ্ঠান ও ঠিকাদারিই নয়, তাঁদের কেউ কেউ বিটিভির নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি ইত্যাদি বিষয়ে তদবির করেন। তদবির করেন অন্যদের অনুষ্ঠান দেওয়ার ব্যাপারেও। এসব অনেক তদবিরের নেপথ্যে অনৈতিক সুবিধা গ্রহণের কথাও শোনা যায়।

এসব কমিটি গঠন করা হয় তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে। মাঝেমধ্যেই পরিবর্তন হয় কমিটি, কমিটির সদস্য। কিছু লোক আছেন, যাঁরা প্ল্যানার হিসেবে বিটিভিতে অনুষ্ঠান করেন, প্রিভিউ কমিটির সদস্য হিসেবে সম্মানী নেন এবং বিটিভিতে সরবরাহের ব্যবসা করেন। আর এসব কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার সুবাদে তাঁরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিটিভিতে অবস্থান করেন। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে উল্টো বলা হয়েছে, ব্যবসায়িকভাবে বিটিভির সঙ্গে যুক্ত লোকদের প্রিভিউ কমিটিতে না রাখার জন্য। কমিটিতে যাঁরা থাকবেন, অনুষ্ঠান করতে দেওয়া যাবে না।

সাবেক মহাপরিচালক লিখেছেন, ‘সপ্তাহে চার দিন জনপ্রিয় একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করা সুন্দরী তরুণী প্রিভিউ কমিটির সদস্য বিধায় তাকে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা না করার কথা বললে মন্ত্রণালয়ে অত্যন্ত উচ্চপর্যায় থেকে বলা হলো, সে অনুষ্ঠান করবে। প্রিভিউ কমিটির সদস্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের প্রিভিউ সেশনে অংশ নিতে বিটিভিতে আসার জন্য অনেক সময় বিটিভি থেকে গাড়ি পাঠাতে হয়। কমিটির কিছু কিছু সদস্য সভায় আসেন না, কিন্তু উপস্থিতির রেজিস্টারে স্বাক্ষর করে সম্মানী গ্রহণ নিশ্চিত করেন। আমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের গাড়ি সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। কিছুদিন এটা বজায় থাকলেও একসময় আমাকে না জানিয়ে মন্ত্রণালয়ের অফিসারদের গাড়ি দেওয়া শুরু হলো। এ ব্যাপারে বিটিভির কর্মকর্তাদের যুক্তি, “আপনি তো সব সময় এখানে থাকবেন না। মন্ত্রণালয়ের লোকদের এটুকু সুবিধা না দিলে তারা ঠিকমতো আমাদের কাজ করবে না।”’

এ রকম রেষারেষি ও শত্রুতায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন নারী কর্মকর্তা ও কর্মীরা। তাঁদের হেয়প্রতিপন্ন করতে প্রতিদ্বন্দ্বী সহকর্মীরা তাঁদের চরিত্রে কালিমা লেপনের চেষ্টা করেন।

হারুন রশীদ লিখেছেন, ‘প্রিভিউ কমিটির সভায় হাজির না থেকে পরে এসে হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর প্রদান বন্ধ করার পর একজন সদস্য ও বিশিষ্ট অভিনেতা আমাকে বলেছিলেন যে এটা করে আমি নাকি তাঁর সম্মানহানি করেছি। আমি তাঁকে বলেছিলাম, “আমি তো বরং আপনার সম্মান রক্ষা করেছি। সবাই বলাবলি করত যে আপনার মতো একজন বিশিষ্ট মানুষ সভায় উপস্থিত না থেকেও উপস্থিত আছেন দেখিয়ে সরকারের টাকা গ্রহণ করছেন।”’

প্রিভিউ কমিটির মাধ্যমে অনুষ্ঠান যাচাই করিয়ে নেওয়ার জন্য বছরে কোটি টাকা খরচ হয় বিটিভির শিল্পী সম্মানী খাতে। বিস্ময়কর একটা ব্যাপার হলো, একটি চলচ্চিত্র একবার প্রিভিউ হওয়ার পর একবারই বিটিভিতে দেখানো হয়। সেই ছবি কয়েক দিন পর আবার দেখাতে হলে আবারও প্রিভিউ কমিটিতে পাঠাতে হয়। সাবেক মহাপরিচালক লিখেছেন, ‘আমি সিদ্ধান্ত দিলাম, একটি চলচ্চিত্র একবার প্রিভিউয়ের পর বিটিভিতে প্রদর্শিত হলে এবং সেটা আবারও বিটিভিতে দেখানোর জন্য নতুন করে প্রিভিউয়ের প্রয়োজন নেই। আগের প্রিভিউয়ের সুপারিশ ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সংশোধন ও পরিমার্জন করে প্রচার করা যাবে। এ সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হলেন কমিটির সদস্যরা। তাঁরা আমাকে নানাভাবে পীড়াপীড়ি করলেন সিদ্ধান্ত বদলানোর জন্য। আমি রাজি হলাম না। এ বিষয়ে একদিন তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব আমাকে হাসতে হাসতে বললেন, “সভাটভা করে কেউ যদি কয়টা পয়সা পায়, তাতে আপনার অসুবিধা কী?”’

বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন

‘কাকের মাংস কাকে’

বিটিভির অভ্যন্তরীণ বিভাগের অজানা কিছু ঘটনাও হারুন রশীদ তাঁর বইয়ে তুলে ধরেছেন। বিশেষত অনুষ্ঠান ও শিল্প নির্দেশনা বিভাগের মধ্যে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা মাঝেমধ্যে এমন পর্যায়ে চলে যায় যে তা কদর্যতার সীমা ছাড়িয়ে যায়। লোকে বলে ‘কাক কাকের মাংস’ খায় না। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের কেউ কেউ হিংসা–বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে নিজেরাই নিজেদের বিরুদ্ধে অনৈতিক কুৎসা ছড়ান।

হারুন রুশীদ তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘সবাই বড় আয়োজনের অনুষ্ঠান করার সুযোগ চান। কিন্তু পান না। বিশেষ দিবসের বিশেষ অনুষ্ঠান এবং বিটিভির অন্যতম জনপ্রিয় অনুষ্ঠান নাটক প্রযোজনা ও শিল্প নির্দেশনার দায়িত্বও সবাই পান না। এসব নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে কিছু অতৃপ্তি ও অসন্তোষ থাকে। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ নষ্ট হয় তখন, যখন এসব অতৃপ্তি ও অসন্তোষ মারাত্মক রেষারেষি, ক্ষেত্রবিশেষে ব্যক্তিগত শত্রুতার পর্যায়ে চলে যায়। এ রকম রেষারেষি ও শত্রুতায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন নারী কর্মকর্তা ও কর্মীরা। তাঁদের হেয়প্রতিপন্ন করতে প্রতিদ্বন্দ্বী সহকর্মীরা তাঁদের চরিত্রে কালিমা লেপনের চেষ্টা করেন। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো পুরুষদের সাথে সাথে নারী কর্মকর্তাদের কেউ কেউও তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী নারী সহকর্মীর চরিত্র নিয়ে নেতিবাচক কথাবার্তা বলে বেড়ান। কাঙ্ক্ষিত পদ ও দায়িত্ব না পাওয়া, ভালো অনুষ্ঠান না পাওয়া, বাজেট কমবেশি হওয়া ইত্যাদি কারণে কিছু কিছু শাখার লোকদের মধ্যে বিরাজিত অসন্তোষ কখনো কখনো এমন পর্যায়ে চলে যায় যে তাঁরা মন্ত্রণালয়, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ বিভিন্ন দপ্তরে তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী সহকর্মীদের বিরুদ্ধে উড়োচিঠি পাঠান। সহকর্মীদের অপদস্থ করার জন্য বাইরের লোকদের উসকে দেন।’

শেষ কথা

কত রকমের অন্যায় আবদার, অনুরোধ এবং নির্দেশ যে বিটিভিকে হজম করতে হয়, তা বলে শেষ করা কঠিন। সাবেক মহাপরিচালক লিখেছেন, ‘বিটিভির অনুষ্ঠানের মান পড়তে শুরু করে ২০০০ সালের পর থেকে। এ সময় থেকেই মূলত শুরু হয় দলীয় বিবেচনায় শিল্পী তালিকাভুক্তি ও অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের ধারা। ২০০৮ সালে এসে এটা তদবির ও দলীয় প্রভাব মহামারির আকার ধারণ করে। ফল পাওয়া গেল হাতেনাতে। অনুষ্ঠানের মান গেল রসাতলে।’ তিনি লিখেছেন, ‘তদবিরে মানহীন অনুষ্ঠান বিটিভির সক্ষমতা ও ইমেজকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে থাকল।’

ভালো অনুষ্ঠান বেশি না হওয়ার কারণ সম্পর্কে হারুন রশীদ লিখেছেন, ‘দক্ষ ও সৃজনশীল অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নের অভাব। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য শক্তির তদবিরকারীদের ভিড়ে মেধাবী ও সৃজনশীল পরিকল্পনাকারী, লেখক ও উপস্থাপকেরা ভিড়তে পারেন না বিটিভির ধারেকাছে।’

এই ‘রসাতল’ থেকে বিটিভিকে কে টেনে তুলবে, সেই প্রশ্ন নিশ্চয়ই এখন উদিত হয়েছে পাঠকের মনে। এর জবাব অবশ্য লেখক তাঁর বইয়ে দেননি।