দুর্নীতিগ্রস্ত আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো করপোরেট পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকে

হাইকোর্ট
ফাইল ছবি

অপরাধীরা দিন দিন অত্যাধুনিক হয়ে উঠছে। যেখানে বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রকে সীমাবদ্ধতার মধ্যেও সীমিত সম্পদ নিয়ে একটি উন্নয়নশীল জাতি হিসেবে তাদের সঙ্গে লড়াই করতে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে বলে এক রায়ে উল্লেখ করেছেন আপিল বিভাগ। রায়ে বলা হয়েছে, দুর্নীতিগ্রস্ত আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলো করপোরেট পর্দার আড়ালে লুকিয়ে থাকে। দুর্নীতিগ্রস্ত কোম্পানিগুলো নিজেদের রক্ষা করতে ঢাল হিসেবে সার্বভৌমত্বের ওপর নির্ভর করে।

গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহের জন্য ২০০৩ সালে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের সঙ্গে কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর করা যৌথ উদ্যোগ (জয়েন্ট ভেঞ্চার) চুক্তি বাতিলের রায় বহাল রেখে আপিল বিভাগের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে এমন পর্যবেক্ষণ এসেছে। ৫৮ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়টি রোববার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

রায়ে বলা হয়, নাইকো রিসোর্সেস (বাংলাদেশ) লিমিটেড ও নাইকো রিসোর্সেস লিমিটেড যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ বিন্যস্ত করে তা ছড়িয়ে দেয় এবং গোপনে তাদের কর্মকাণ্ড এগিয়ে নেয়। তাদের এমন অবৈধ কর্মকাণ্ড দায়মুক্তির সঙ্গে চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া যাবে না, যখন জালিয়াতি ও দুর্নীতি ঘটে।

রায়ে আরও বলা হয়, এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে বাংলাদেশে নাইকো রিসোর্সেস (বাংলাদেশ) লিমিটেড ও নাইকো রিসোর্সেস লিমিটেড দুর্নীতির একটি পরিকল্পনা মাধ্যমে সাধারণ অপরাধীর ভূমিকা নেয়...। এমতাবস্থায় আদালতের দায়িত্ব আছে এই সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার। ক্ষমতার অপব্যবহার এবং অসাধু বিনিয়োগকারীদের যারা সুবিধা দেয় এবং রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সরকারের যেসব কর্মকর্তা এর মাধ্যমে নিজেদের সমৃদ্ধ করে—এ ধরনের দুর্নীতি, রাষ্ট্রকে তার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে।

বাপেক্সের সঙ্গে নাইকোর করা যৌথ উদ্যোগ (জয়েন্ট ভেঞ্চার) বাতিল ঘোষণা করে ছয় বছর আগে হাইকোর্ট রায় দিয়েছিলেন। রায়ে পেট্রোবাংলার সঙ্গে নাইকোর গ্যাস সরবরাহ ও কেনাবেচার চুক্তিও বাতিল ঘোষণা করা হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করে নাইকো রিসোর্সেস (বাংলাদেশ) লিমিটেড। এই লিভ টু আপিল খারিজ করে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বিভাগ গত ১৮ জুন ওই রায় দেন।

আইনজীবীদের তথ্যমতে, ২০০৩ সালের ১৬ অক্টোবর বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলন নিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের সঙ্গে কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর করা যৌথ উদ্যোগ (জয়েন্ট ভেঞ্চার) চুক্তি হয়। পেট্রোবাংলার সঙ্গে নাইকোর গ্যাস সরবরাহ ও কেনাবেচার বিষয়ে ২০০৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর চুক্তি হয়। দেশের কয়েকটি প্রান্তিক গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহের জন্য চুক্তি দুটি হয়েছিল। সেই অনুসারে ফেনী গ্যাসক্ষেত্র থেকে নাইকো গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহ করে এবং সুনামগঞ্জের ছাতকের টেংরাটিলায় কূপ খনন করতে গিয়ে দুবার বিস্ফোরণ ঘটায়।

এ অবস্থায় দুই চুক্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে জনস্বার্থে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম ২০১৬ সালে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ৯ মে হাইকোর্ট রুলসহ চুক্তির কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ দেন। রুলে কানাডার প্রতিষ্ঠান নাইকোর করা ওই চুক্তি দুটি কেন বাতিল করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। নাইকো কানাডা ও নাইকো বাংলাদেশের সম্পত্তি কেন জব্দ করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। রুল চূড়ান্ত (অ্যাবসলিউট) ঘোষণা করে ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট রায় দেওয়া হয়। একই বছর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করে নাইকো রিসোর্সেস, যা খারিজ করে ১৮ জুন রায় দেন আপিল বিভাগ। পূর্ণাঙ্গ রায়টি রোববার প্রকাশ করা হয়।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। নাইকোর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মুস্তাফিজুর রহমান খান। রিট আবেদনকারীর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী তানজিব-উল আলম।

নাইকোর আইনজীবী মুস্তাফিজুর রহমান খান রোববার প্রথম আলোকে বলেন, চুক্তি বাতিল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। হাইকোর্টের দেওয়া পর্যবেক্ষণও রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। মক্কেলের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

পূর্ণাঙ্গ রায় দেখেছেন ও পড়েছেন বলে জানান বাপেক্স ও পেট্রোবাংলার আইনজীবী মঈন গনি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নাইকো দুর্নীতির মাধ্যমে ওই দুটি চুক্তি করে, এটি স্বীকৃত। ওই চুক্তি দুটি করা হয় দুর্নীতির মাধ্যমে, যা বাতিল করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। দুই চুক্তির আওতায় নাইকো কানাডা ও নাইকো বাংলাদেশের সব সম্পত্তি রাষ্ট্রের অনুকূলে ফেরত এসেছে। ব্লক-৯-এ নাইকোর যে সম্পত্তি আছে, তা–ও জব্দের মাধ্যমে রাষ্ট্রের অনুকূলে আনা হয়েছে।