চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

নিয়ম ‘ভেঙে’ ফলাফল পুনর্মূল্যায়ন

নিয়ম অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ নেই। প্রতিষ্ঠার পর থেকে কোনো বিভাগেই এমনটা হয়নি। তবে এবার নিয়ম ‘ভেঙে’ ইংরেজি বিভাগে স্নাতকোত্তরের উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ফলাফল প্রকাশ নিয়ে গত ২৯ সেপ্টেম্বর একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কমিটি ফলাফল প্রকাশে কোনো অনিয়ম খুঁজে পায়নি। তবে তদন্তে নির্ভুল রায় দেওয়ার পরও ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হননি একজন সিন্ডিকেট সদস্য ও স্নাতকোত্তরের পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান। তাঁরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী এভাবে ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ নেই।

জানা গেছে, ৭ অক্টোবর সিন্ডিকেটের জরুরি সভায় ইংরেজি বিভাগের স্নাতকোত্তর ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষের প্রকাশিত ফলাফল বাতিল করে পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করা হয়। তবে এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন সিন্ডিকেট সদস্য নঈম উদ্দিন হাছান আওরঙ্গজেব চৌধুরী। সিন্ডিকেটে কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গৃহীত এই সিদ্ধান্ত (ফলাফল পুনর্মূল্যায়ন) ভবিষ্যতে উদাহরণ বা নজির হিসেবে দেখানো যাবে না। ফলাফল পুনর্মূল্যায়ন কমিটিতে আছেন বিভাগের সভাপতি মাহ-এ-নূর কুদ্সী ইসলাম, অধ্যাপক সরওয়ার মোরশেদ ও মুহাম্মদ রোকন উদ্দীন।

বিভাগের স্নাতকোত্তর ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা শুরু হয় চলতি বছরের ১২ মে। পরীক্ষা শেষ হয় ১২ জুন। ফলাফল প্রকাশিত হয় ১৮ আগস্ট। ১১৭ জন নিয়মিত শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেন। ফেল করেন ৩৯ জন। অকৃতকার্য শিক্ষার্থীরা ন্যূনতম সিজিপিএ ২ দশমিক ২৫ তুলতে পারেননি।

এরপর ২১ আগস্ট বিভাগের সভাপতি মাহ-এ-নূর কুদ্সী ইসলাম বরাবর ফলাফল প্রত্যাখ্যান ও নতুন কমিটি গঠনের মাধ্যমে উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের আবেদন জানান শিক্ষার্থীরা। ১ সেপ্টেম্বর বিষয়টি নিয়ে কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন কার্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের একাডেমিক কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় ফলাফল পুনর্মূল্যায়ন কমিটি গঠন করা হয়। পরবর্তীতে ৫৫৫তম জরুরি সভায় কমিটির বিষয়টি অনুমোদন দেয় সিন্ডিকেট।

ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের দাবি নিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইংরেজি বিভাগের স্নাতকোত্তরের এক শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, ফলাফল বিপর্যয় ঘটেছে। তাঁদের ফলাফল আশানুরূপ হয়নি। বিভাগের কিছু শিক্ষক উত্তরপত্রের অবমূল্যায়ন করেছেন। এভাবে এত শিক্ষার্থী ফেল করতে পারেন না। এ কারণে তাঁরা উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়ন চেয়েছেন। কর্তৃপক্ষ তাঁদের দাবির সঙ্গে একমত হয়ে কমিটি করে দিয়েছে।

শিক্ষকেরা জানান, আগে কখনো ফলাফল পুনর্মূল্যায়ন করা হয়নি। একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেট থেকে সর্বসম্মতিক্রমে পাস হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাবিষয়ক নিয়ম ও বিধির ২ নম্বর ধারার ১১ নম্বর উপধারায় বলা আছে, পরীক্ষার্থীদের উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়ন করা যাবে না।

‘নিয়ম ও বিধির পরিপন্থী’

স্নাতকোত্তর ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষের পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক যাকীয়াহ্ তাসনিম। ২৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর চিঠি দিয়ে ফলাফল পুনর্মূল্যায়ন কমিটি বাতিল চান তিনি। চিঠিতে বলা হয়, পরীক্ষাবিষয়ক নিয়ম ও বিধির কোথাও কোনো বিভাগের একাডেমিক কমিটিকে শিক্ষার্থীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের জন্য কমিটি করার এখতিয়ার দেওয়া হয়নি। এটি নিয়ম ও বিধির পরিপন্থী। ফলে এই কমিটি এখতিয়ার বহির্ভূত অবৈধ কমিটি।

ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্তের ব্যাখ্যা জানতে গত সোমবার উপাচার্য মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতারের কার্যালয়ে গেলে দেখা করার অনুমতি পাওয়া যায়নি। এরপর মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘উপাচার্যকে ছোট ছোট বিষয় নিয়ে ফোন করার দরকার নেই। আমি এখন বড় বিষয় নিয়ে কাজ করছি। আপনি রেজিস্ট্রারের সঙ্গে কথা বলুন।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিন্ডিকেট যে কোনো সময় যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এটাকে বিশেষ কেস (ঘটনা) হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এটিকে উদাহরণ হিসেবে দেখানো যাবে না। আগের সিন্ডিকেট সিদ্ধান্ত ছিল স্বাভাবিক সময়ের। তবে এখন পরিস্থিতি অস্বাভাবিক ছিল।’

ফলাফল শতভাগ নির্ভুল

শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২৯ সেপ্টেম্বর ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের বিষয়টি তদন্ত করতে উপাচার্য ইয়াহ্ইয়া আখতার চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন। এতে আহ্বায়ক করা হয় কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন মো. ইকবাল শাহীন খানকে। ফলাফল প্রস্তুতে কোনো ধরনের অসংগতি, অনিয়ম কিংবা জালিয়াতি হয়েছে কি না, তা যাচাইয়ের কাজ করে ওই কমিটি। এ জন্য নম্বরফর্দ, গড় নম্বরফর্দ, ট্রেবুলেশন শিট, গ্রেড শিট, কোড শিট, মৌখিক পরীক্ষা, টিউটোরিয়াল ও টার্মিনাল পরীক্ষার নম্বরফর্দ বিশ্লেষণ করেছেন কমিটির সদস্যরা।

সরল দৈবচয়ন পদ্ধতিতে নির্বাচিত নমুনা যাচাই করে তদন্ত কমিটি নিশ্চিত হয়, স্নাতকোত্তর-২০২১ বর্ষের পরীক্ষার প্রকাশিত ফলাফল শতভাগ নির্ভুল। কমিটির প্রতিবেদনে এই তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ফলাফল প্রস্তুত করতে নিয়ম অনুযায়ী প্রস্তাবিত প্রক্রিয়া যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়েছে। তাই তদন্ত কমিটি মনে করে ফলাফল পুনর্মূল্যায়নের যৌক্তিকতা নেই। এ রকম পুনর্মূল্যায়ন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

কমিটির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ট্রেবুলেশন শিট পরীক্ষা করে এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কমিটি দেখেছে, পরীক্ষা সমাপ্তি এবং ফলপ্রকাশ পর্যন্ত পরীক্ষা কমিটি সর্বমোট সময় নিয়েছে ৬৬ দিন। অর্থাৎ ফলাফল গ্রহণযোগ্য সময়সীমার মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে।

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ইকবাল শাহীন খান প্রথম আলোকে নিশ্চিত করে বলেন, তাঁরা ফলাফলে কোনো ধরনের অসংগতি পাননি। জানতে চাইলে পরীক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান যাকীয়াহ্ তাসনিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সততার সঙ্গে তাঁরা ফলাফল তৈরি করেছেন। কিন্তু প্রকাশিত ফলাফল নিয়ে যা হয়েছে, তা পরীক্ষা কমিটির জন্য বিব্রতকর। তদন্ত কমিটি প্রকাশিত ফলাফলকে শতভাগ নির্ভুল বলে উল্লেখ করছে। তবু সিন্ডিকেট ওই অবৈধ কমিটিকে বৈধতা প্রদান করে উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা আমাকে অপমানিত ও গভীরভাবে হতাশ করেছে।’

‘এই কমিটি অযৌক্তিক’

এ ধরনের পুনর্মূল্যায়ন কমিটি করা পুরোপুরি অযৌক্তিক বলে মনে করেন সিন্ডিকেট সদস্য নঈম উদ্দিন হাছান আওরঙ্গজেব চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একটি উত্তরপত্র দুজন শিক্ষক আলাদাভাবে যাচাই করেন। নম্বরের ফারাক বেশি হলে উত্তরপত্র তৃতীয় শিক্ষকের মাধ্যমেও যাচাই হয়। এত লম্বা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উত্তরপত্র যাচাই হওয়ার কারণে পুনর্মূল্যায়নের সুযোগ বিশ্ববিদ্যালয়ে রাখা হয়নি। ফলে অযৌক্তিকভাবে পুনর্মূল্যায়নের কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই কমিটি পরীক্ষাবিষয়ক আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

সদস্য নঈম উদ্দিন হাছান আওরঙ্গজেব চৌধুরী বলেন, সিন্ডিকেট সর্বোচ্চ নির্বাহী পর্ষদ হিসেবে এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে সবচেয়ে আদর্শ চর্চা হলো, একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া। কারণ, একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অধ্যাপক ও বিভাগের সভাপতি উপস্থিত থাকেন। এটিই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। সিন্ডিকেটের সভায় এই পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটি গৃহীত হয়নি। তাই তিনি দ্বিমত পোষণ করেছেন।