অধ্যাপক নুরুল ইসলাম

অর্থনীতিবিদ হিসেবে যে দুই শিক্ষা নিয়েছিলাম

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম আর নেই। সুদীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি শিক্ষকতা করেছেন, জড়িত ছিলেন বহু ধরনের গবেষণায়। ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) একটি বিশেষ প্রকাশনায় তাঁর ইংরেজি এই আত্মস্মৃতি ছাপা হয়েছিল। ত্রৈমাসিক প্রতিচিন্তায় ২০১৮ সালের ১৭ মে সংখ্যায় এর অনুবাদ প্রকাশিত হয়। অনুবাদ করেছেন খলিলউল্লাহ্। আজ লেখাটির দ্বিতীয় কিস্তি প্রকাশিত হলো—

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম
ছবি: খালেদ সরকার

পাকিস্তান উন্নয়ন অর্থনীতি ইনস্টিটিউট (পিআইডিই) ১০ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর পর ১৯৬৪ সালের শেষের দিকে করাচিতে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকসে (পিআইডিই) যোগ দিই। তখন পর্যন্ত এর পরিচালনার দায়িত্ব ছিল বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদদের হাতে। তাঁরা প্রধানত পাকিস্তান সরকারকে দেওয়া ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অনুদানের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের এবং ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ ছিলেন। ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অনুদানের শর্ত ছিল, ইনস্টিটিউটের নেতৃত্ব কোনো পাকিস্তানিকে গ্রহণ করতে হবে। এই ইনস্টিটিউটের নেতৃত্ব দিতে ইচ্ছুক, এমন কোনো উচ্চ প্রশিক্ষিত পশ্চিম পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ ছিলেন না। কারণ, এটা ছিল একটা আধা সরকারি ছোট গবেষণা ইনস্টিটিউট, যার প্রশাসন বা নীতিনির্ধারণে কোনো দৃশ্যমানতা ছিল না। যে কারণে একজন পূর্ব পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদকে বাছাই করা হলো, যিনি স্বনামধন্য মার্কিন অর্থনীতিবিদদের কাছেও সুপরিচিত ছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়জীবন থেকে পিআইডিই আলাদা ছিল। কারণ, এখানে কোনো পড়ানোর কাজ ছিল না, শুধুই গবেষণা। বাণিজ্য, বিদেশি বিনিয়োগ, সাহায্য ইত্যাদির মতো আমার আগ্রহের বিষয়ে গবেষণা করার জন্য পর্যাপ্ত রসদ আমার আওতাধীন ছিল।

আমার আগের বিদ্যায়তনিক পরিবেশের তুলনায় এখানকার পরিবেশ অনেক ভালো ছিল। এখানে নামীদামি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুই-তিন বছরের জন্য আবাসিক অর্থনীতিবিদেরা থাকতেন। তাঁদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করার ফলে এবং আমাদের পারস্পরিক আগ্রহের বিষয়ে দৈনন্দিন আলোচনা ও বিতর্ক থেকে আমি লাভবান হতে পারতাম। এ ছাড়া সেখানে স্বল্পমেয়াদি অনাবাসিক পণ্ডিতেরা আসতেন। তার বাইরে, কিছু স্বনামধন্য বিদেশি অর্থনীতিবিদ যেমন জ্যান টিনবারজেন, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্টিন রবিনসন, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের লয়েড রেইনল্ডস এবং অন্যদের সমন্বয়ে একটি বিদেশি উপদেষ্টা দল ছিল, যারা একটানা দুই সপ্তাহ পর্যন্ত এসে থাকত এবং আমাদের গবেষণা কর্মসূচি ও প্রকাশনার ওপর পর্যালোচনা, মন্তব্য ও পরামর্শ দিত।

একই সময়ে করাচিতে নীতিনির্ধারণ-বিষয়ক একটি অতিরিক্ত বিদেশি গবেষক দল ছিল, যার মধ্যে পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনে সংযুক্ত হার্ভার্ড উপদেষ্টা দল এবং যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য সাহায্য মিশনের বেশ কিছু অর্থনীতিবিদ ছিলেন। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়ননীতিতে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিল।

আমার নতুন পেশাগত পরিবেশের এসব বৈশিষ্ট্যের ফলে আমি দেশের বাইরের উচ্চতর শিক্ষাকেন্দ্রে অর্থনৈতিক পেশায় নিজেকে ধরে রাখতে পেরেছিলাম। সরকারের দেওয়া সম্পদ ছিল অবাধ এবং বিশেষত্ব ও পাকিস্তানের নীতিবিষয়ক অগ্রাধিকার অনুযায়ী গবেষণার বিষয় নির্বাচন করতেন গবেষকেরাই; যার জন্য দীর্ঘমেয়াদি গবেষণা প্রয়োজন ছিল। ফোর্ড ফাউন্ডেশন ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কর্মসূচির মাধ্যমে বিদেশি উপদেষ্টা, লাইব্রেরি ও সরঞ্জামাদির জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অনুদান দিয়েছিল। এ ছাড়া অনেক বৃত্তি দিয়েছিল, যার মাধ্যমে ইনস্টিটিউট ও দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অর্থনীতিবিদদের প্রশিক্ষিত করার জন্য দেশের বাইরে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের বন্দোবস্ত করা যেত।

এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব ছিল পরিচালক ও তাঁর জ্যেষ্ঠ কর্মীদের হাতে। বিদ্যায়তনিক স্বাধীনতার নিশ্চয়তাও সরকারের ঘোষিত নীতি ছিল, যদিও পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের প্রধানেরাই পরিচালনা পর্ষদের প্রধান ছিলেন, যেখানে অর্থসচিবদের মতো পাকিস্তান সরকারের অর্থনৈতিক মহারথীরা থাকতেন। ফোর্ড ফাউন্ডেশনের সঙ্গে সরকারের চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পরিচালকের পেশাগত সিদ্ধান্তে বোর্ডের হস্তক্ষেপ না করার নীতি আংশিক কার্যকর ছিল। এখনকার প্রেক্ষাপটে অবাস্তব মনে হলেও সাহায্যের শর্তের মাধ্যমে এমন অতুলনীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত হওয়ায় সে সময়ের কিছু বিতর্কিত নীতির বিষয়েও আমরা গবেষণা করতে পেরেছিলাম, যা পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকদের ব্যাপারে সমালোচনামূলক ছিল। বাণিজ্য, সাহায্য ও বিনিয়োগের মতো আগ্রহের প্রাথমিক বিষয়ে আমি গবেষণা করার সুযোগ পেয়েছিলাম।

আমি দেশে-বিদেশে বেশ কিছু বিষয়ের ওপর নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলাম। এসব নিবন্ধের বিষয় ছিল কারখানাজাত শিল্পের তুলনামূলক ব্যয় এবং তাদের প্রতিযোগিতা, রপ্তানি প্রণোদনার যৌক্তিকতা ও কার্যকারিতা এবং রপ্তানি সক্ষমতা, বিভিন্ন রপ্তানির প্রতিযোগিতামূলক অভ্যন্তরীণ সম্পদ ব্যয় ইত্যাদি। পাকিস্তানের উন্নয়নে বিদেশি সাহায্যের সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রভাবের বিশ্লেষণসহ আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতার ওপর সাম্প্রতিক চিন্তাভাবনার মূল্যায়ন নিয়েও সে সময় আমি লিখেছি। সেই সময় লুইজের শ্রমের অসীম জোগান-তত্ত্ব এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর শ্রমবাজারে মজুরির সন্ধিক্ষণ ইত্যাদি বেশ আলোচিত হচ্ছিল। আমি এর সীমাবদ্ধতা, নীতিসংশ্লিষ্টতাসহ পুরো গবেষণাক্ষেত্রটির মূল্যায়ন করেছিলাম। আমার গবেষণার গুণগত মান এবং পরিমাণের দিক থেকে ইনস্টিটিউটের সময়কাল ছিল আমার পেশাগত জীবনের সবচেয়ে উত্পাদনশীল সময়।

কিছু গবেষণার ফলাফল ছিল খুবই বিতর্কিত

একই সময়ে পাকিস্তানের অর্থনীতির ওপর করা ইনস্টিটিউটের কিছু গবেষণার ফল ছিল খুবই বিতর্কিত। প্রথমবারের মতো পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয়ের হিসাব আলাদাভাবে প্রকাশ করা হয়। এর আগে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের আয়ের সঠিক হিসাব সর্বসাধারণের জন্য সহজলভ্য ছিল না। পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে আয়বৈষম্য রাজনৈতিকভাবে খুবই উত্তপ্ত বিষয় ছিল। কারণ, পূর্ব পাকিস্তান সে সময় পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি বন্ধে এবং পূর্ব পাকিস্তানে বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ ও নীতি প্রণোদনার উল্লেখযোগ্য পুনর্বণ্টনের দাবি জানাচ্ছিল। একই সময়ে, কৃষি ও শিল্পের তুলনামূলক কর্মক্ষমতা বিষয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান বৈষম্য নিয়ে ইনস্টিটিউট থেকে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এ ধরনের রাজনৈতিকভাবে বিস্ফোরণমূলক বিষয়ে গবেষণা স্বাভাবিকভাবেই তারা ভালোভাবে নেয়নি। কিন্তু নামীদামি বিদেশি বিদ্যায়তনিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে ভালো সংযোগ থাকায় ইনস্টিটিউট সুরক্ষিত ছিল, যার ফলে আমাদের উচ্চমানসম্পন্ন গবেষণা নিশ্চিত হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব এসব নিবন্ধ দ্বারা মোটেও ভীত ছিল না, কেননা এগুলো ছাপা হতো ইনস্টিটিউটের জার্নালের মতো বিদ্যায়তনিক জার্নালে, যা জনসাধারণের কাছে পৌঁছাত না। জনসাধারণ বা রাজনীতিবিদেরা এ ধরনের গবেষণা সম্পর্কে জানতেন না অথবা জানলেও তাঁরা সেগুলো পড়েননি। অধিকন্তু, এসব নিবন্ধ যদি কোনো কারণে রাজনৈতিক আলোচনায় জায়গা নেওয়ার মতো বিপর্যয়পূর্ণ অবস্থায় চলে যেত, তাহলে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা সামরিক-বেসামরিক নেতৃত্বের ছিল।

প্রকৃতপক্ষে সময়ের আবর্তে এসব গবেষণার ফল বিভিন্ন সভায় আলোচনা হতো, যা গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করার ফলে পাকিস্তানের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে পরিচিতি পেয়েছিল। আমাদের জীবনে এর কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বৈরী প্রভাব পড়েনি। আমার মনে হয়, ক্ষমতাসীন এলিটদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং নিরাপত্তাহীনতা ছিল না, যার ফলে তারা আমাদের মতো একাডেমিকদের দমন করতে চায়নি—অন্তত যত দিন পর্যন্ত না আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রামে গতিবেগ আসার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছি।

প্রথম বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন

১৯৭০ সালের শেষের দিকে পিআইডিইর প্রধান কার্যালয় ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। আমি ১৯৬৯ সালের মার্চের পর থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলনের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলাম, এমনকি যখন আমি পিআইডিইর পরিচালক ছিলাম, তখনো। তত দিনে বিদ্যায়তনিক নিরপেক্ষতার রেখা অতিক্রম করে রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হয়ে গিয়েছিলাম। ফলে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বর্বরতা শুরু হওয়ার পর থেকে ডিসেম্বরে স্বাধীনতার আগপর্যন্ত নির্বাসনে ছিলাম। ১৯৭২ সালের শুরুর দিকে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের সহকারী চেয়ারম্যান নিযুক্ত হই। গবেষণাপ্রতিষ্ঠান থেকে পরিকল্পনা কমিশনে নিযুক্তি খুবই তাত্পর্যপূর্ণ ছিল, যেখানে আমার কাজ ছিল নীতিনির্ধারণ এবং রাজনীতিবিদদের পরামর্শ দেওয়া। এই কাজ দ্বিগুণ কঠিন ছিল, যেহেতু আমি একটি নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরিতে যুক্ত ছিলাম, যেমন পরিকল্পনা কমিশনকে সরকারের অংশ করা। আমরা প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা তৈরি করেছিলাম এবং ইনপুট-আউটপুট কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে অর্থনীতির জন্য সামষ্টিক অর্থনৈতিক নমুনা নির্মাণ করেছিলাম। সহকারী চেয়ারম্যান হিসেবে সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামো এবং এর পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সংশ্লিষ্ট প্রক্ষেপণ ও নীতি সুপারিশ বিষয়ে আমাকে তদারকির দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের মাধ্যম হিসেবে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় তার অনুসরণ ছিল একটি দীর্ঘমেয়াদি পরামর্শ-প্রক্রিয়া। এই পরামর্শ-প্রক্রিয়া শুধু অভ্যন্তরীণ সম্পদ সমাবেশের দায়িত্বপ্রাপ্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে করলেই হতো না, বরং খাতভিত্তিক কর্মসূচি ও নীতি বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও করতে হতো। নির্দিষ্ট কর্মসূচি ও নীতি বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে বিস্তর দর-কষাকষি ও আলোচনার ভার ছিল কমিশনের সদস্যদের ওপর।

যে দুই শিক্ষা নিয়েছিলাম

পরবর্তী কাজে আমাকে প্রথমে যে শিক্ষাটা নিতে হয়েছে, তা হলো, রাজনীতিবিদদের উপযোগী ভাষায় অর্থনৈতিক ও নীতিসম্পর্কিত বিষয়গুলো ব্যাখ্যা ও আলোচনা করার কৌশল রপ্ত করা। এটা খুব কঠিন কাজ হলেও আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। আমার মনে হয়, নির্দিষ্ট নীতিনির্ধারণী বিষয়ে আলোচনা করার কাজে আমি ধীরে ধীরে উন্নতি করেছি। সব সময় প্রতিটি মন্ত্রণালয় তাদের উন্নয়ন কর্মসূচির জন্য আরও বেশি সম্পদ দাবি করত। তবে সব মন্ত্রণালয়ের সম্পদের দাবি একত্র করলে আয়ত্তগত সামষ্টিক সম্পদের যোগফলকে অতিক্রম করে যেত। কিন্তু তারা কর রাজস্ব বাড়াতে আগ্রহী ছিল না। মন্ত্রিপরিষদে দর-কষাকষির প্রক্রিয়া সব সময় সুখকর ছিল না।

প্রকৃতপক্ষে, আলোচনা ও দর-কষাকষি সাপেক্ষে সম্পদের বরাদ্দ বিষয়ে একমত হওয়ার পরিবর্তে বেশির ভাগ সময়ে মন্ত্রীরা তাঁদের দ্বান্দ্বিক দাবির ভিত্তিতে সম্পদ পুনর্বরাদ্দের দায়িত্ব পরিকল্পনা কমিশন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের ওপর চাপিয়ে দিতেন। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের জন্য এটা সহজ রাস্তা ছিল। কারণ, এর ফলে তাঁরা সহজেই তাঁদের নির্বাচনী এলাকার বিভিন্ন গোষ্ঠীর অপূর্ণ দাবিদাওয়া মোকাবিলায় বলির পাঁঠা খুঁজে বের করতে পারতেন।

আমার জন্য দ্বিতীয় শিক্ষা ছিল এটা বোঝা যে নীতিনির্ধারণীতে যেটা একজন অর্থনীতিবিদের জন্য যৌক্তিক ও অকপট পছন্দ বলে মনে হতো, সেটা রাজনীতিবিদদের জন্য ততটা অকপট ছিল না। একজন অর্থনীতিবিদ যখন কোনো সমস্যার সমাধান দেন বা নীতি সুপারিশ করেন, তখন তিনি তাঁর নীতিবিধানের রাজনৈতিক সম্ভাব্যতা বিবেচনা করেন না। যাহোক, রাজনৈতিক সম্ভাব্যতা বিবেচনা না করে কোনো অর্থনীতিবিদ পরামর্শ দিলে প্রতিবন্ধকতাগুলোকে সম্ভবত গ্রহণ করা হয় না। উদাহরণস্বরূপ সারে ভর্তুকির কথা বলা যায়। কৃষকদের মধ্যে এই পদক্ষেপ খুবই জনপ্রিয় ছিল। ক্ষমতাসীন দল মধ্যস্বত্বভোগী কৃষকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল, যারা দীর্ঘ সময় ধরে সারে ভর্তুকি পেয়ে আসছিল। সরকারনিয়ন্ত্রিত বিতরণব্যবস্থার বাইরে বিক্রির মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য সার বাইরে চলে যাচ্ছিল এবং ভর্তুকি বেশির ভাগ সময়েই ক্ষুদ্র কৃষকের পরিবর্তে বড় কৃষকদের কাছে যেত। এটা প্রমাণিত হওয়ার পরও রাজনীতিবিদেরা এই নীতি চলমান রেখেছিলেন। অধিকন্তু সার ভর্তুকির মতো স্বল্প ব্যয়ের ইনপুট নীতির অনুপস্থিতিতে খাদ্য উত্পাদন লাভজনক রাখতে ভর্তুকি যখন চালু করা হয়, সে সময়ের চেয়ে খাদ্যমূল্য বেশি ছিল। একই সঙ্গে, সাপ্লাই চেইনের বেশির ভাগ ব্যবসায়ীই সরকারের মূল সমর্থক ছিলেন। ভর্তুকিতে এত বেশি বিনিয়োগ করার ফলে কৃষির অন্যান্য খাত যেমন সেচ বা সম্প্রসারণসেবায় বিনিয়োগ কমে গেছে, এ যুক্তি দেওয়ার পরও সরকার তার সিদ্ধান্ত থেকে নড়েনি। তারা ভীত ছিল এই ভেবে যে ভর্তুকি বন্ধ করে দিলে খাদ্যের জোগানে ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এ ধরনের ঝুঁকি নিতে তারা আগ্রহী ছিল না। তারা ধীরে ধীরে ভর্তুকি কমিয়ে আনতে চাইছিল। যেমন ভর্তুকি এমন সময় কমানো, যখন অন্যান্য আধুনিক কৃষি উপাদান যেমন উচ্চফলনশীল বীজ, ক্ষুদ্র কৃষকসহ সব কৃষকের জন্য কৃষিঋণের ব্যবস্থাসহ সারের জোগান উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাবে।