আয়তনে বিশ্বে ৯৪তম দেশ হলেও বাংলাদেশ ফসল উৎপাদনে এগিয়ে। উৎপাদন বাড়ায় আমদানি কমেছে। বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হচ্ছে।
বাংলাদেশ ২২টি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে। এর মধ্যে চাল, মসুর ডাল, আলু, পেঁয়াজ, চায়ের মতো পণ্য যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ফল। গত এক দশকে কুমড়া, ফুলকপি ও সমজাতীয় সবজির মতো কিছু পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষ তালিকায় নতুন করে যুক্ত হয়েছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) দেশভিত্তিক কৃষিপণ্য উৎপাদনের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে চিত্রটি দেখা যায়। সংস্থাটি গত মার্চে এই পরিসংখ্যান হালনাগাদ করে। এতে তথ্য দেওয়া হয় ২০২১ সালের।
বাংলাদেশ আয়তনের দিক দিয়ে বিশ্বের ৯৪তম দেশ। তবে এফএওর হিসাবে দেখা যায়, প্রাথমিক কৃষিপণ্য (শুধু ফসল) উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ১৪তম। শীর্ষে রয়েছে চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, আয়তনে ছোট হলেও কৃষিপণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ ভালো।
এফএওর তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালে বাংলাদেশে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের মূল্য ছিল ৩ হাজার ৬১১ কোটি মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় চার লাখ কোটি টাকার সমান। উৎপাদনের পরিমাণ ৯ কোটি ৩৩ লাখ টন।
কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভৌগোলিক অবস্থান, আবহাওয়া ও ভূমির ধরনের কারণে আমাদের দেশে বেশির ভাগ ফসলের উৎপাদন বাড়ছে। সরকারও কৃষিতে ভর্তুকি দিচ্ছে। নতুন জাত উদ্ভাবন, সম্প্রসারণ ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণে জোর দেওয়া হয়েছে। এতে অনেকগুলো ফসল উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষ দশে জায়গা করে নেওয়ার মতো ফলাফল আমরা পাচ্ছি।’
অবশ্য সংরক্ষণের অভাবে আলু, সবজি ও ফলমূল নষ্ট হয়ে যায় উল্লেখ করে কৃষিমন্ত্রী বলেন, এ জন্য ফসল প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণে একটি বড় প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।
এফএওর হিসাবে, ২০০১ সালে ১১টি পণ্য উৎপাদনে শীর্ষ দশে ছিল বাংলাদেশ। ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭টিতে। এরপর বিভিন্ন বছরে যোগ হয় আরও পাঁচটি কৃষিপণ্য—পেঁয়াজ, কুমড়া, ফুলকপি ও ব্রকলি (ফুলকপির মতো সবজি), পাখির খাদ্য (বীজ) এবং অন্যান্য শ্রেণিভুক্ত শিমের বিচি। সব মিলিয়ে ২০২১ সালে ২২টি পণ্য উৎপাদনে শীর্ষ তালিকায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ।
এফএও মোট ১৬২টি প্রাথমিক কৃষিপণ্য উৎপাদনের হিসাব দিয়েছে। বাংলাদেশ ৬৮ ধরনের কৃষিপণ্য উৎপাদনের তালিকায় রয়েছে। এ তালিকায় যেমন একক পণ্য আছে, তেমনি সমজাতীয় ও মৌসুমভিত্তিক কয়েকটি পণ্য মিলিয়ে একটি শ্রেণি হিসেবে দেখানো হয়েছে।
এফএওর হিসাবে, ২০০১ সালে ১১টি পণ্য উৎপাদনে শীর্ষ দশে ছিল বাংলাদেশ। ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭টিতে। এরপর বিভিন্ন বছরে যোগ হয় আরও পাঁচটি কৃষিপণ্য—পেঁয়াজ, কুমড়া, ফুলকপি ও ব্রকলি (ফুলকপির মতো সবজি), পাখির খাদ্য (বীজ) এবং অন্যান্য শ্রেণিভুক্ত শিমের বিচি। সব মিলিয়ে ২০২১ সালে ২২টি পণ্য উৎপাদনে শীর্ষ তালিকায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ কোনো পণ্য উৎপাদনে প্রথম নয়। তবে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পাট, সুপারি ও শুকনা মরিচ উৎপাদনে। চাল, রসুন এবং অন্যান্য শ্রেণিভুক্ত চিনিজাতীয় ফসলে (যেমন জোয়ার) বাংলাদেশ তৃতীয়। জাম, বরই, করমচা, লটকন ইত্যাদি বেরিজাতীয় ফল এবং অন্যান্য শ্রেণিভুক্ত সুগন্ধি মসলায় চতুর্থ। মসুর ডাল ও গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফল (কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদি) উৎপাদনে বাংলাদেশ ষষ্ঠ। সপ্তম অবস্থানে রয়েছে পেঁয়াজ, আলু, আদা, বেগুন, শিমের বিচি ও নারকেলের ছোবড়া উৎপাদনে। চা ও কুমড়ায় বাংলাদেশ অষ্টম। আম, পেয়ারা ও গাবজাতীয় ফল, ফুলকপি ও ব্রকলি এবং মটরশুঁটি ও পাখির খাদ্য (বীজ) শ্রেণিতে বাংলাদেশের অবস্থান নবম।
অল্প জায়গা নিয়ে উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দশে অনেকগুলো ফসল স্থান পাওয়া ভালো খবর। তবে এই খবরে বেশি আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই। মাথাপিছু ভোগের হিসাবে চাল ও আলু ছাড়া অন্যান্য ফসলে আমরা বেশ পিছিয়ে আছি।মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম, অধ্যাপক, কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
প্রধান কিছু ফসল উৎপাদনে বাংলাদেশের অগ্রগতি বেশ ভালো। যেমন আলু। দুই দশক আগে আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ ছিল ২০তম দেশ। এরপর কানাডা, তুরস্ক, পোল্যান্ডের মতো ১৩টি দেশকে একে একে পেছনে ফেলে ৭ নম্বরে উঠে এসেছে বাংলাদেশ। এফএওর তথ্য বলছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশে আলু উৎপাদিত হয়েছে ৯৮ লাখ টন।
মরিচ (শুকনা) উৎপাদনে ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। এক দশকে চীন ও থাইল্যান্ডকে পেছনে ফেলে মরিচ উৎপাদনে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠেছে বাংলাদেশ।
চাল বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্য। চার দশকের বেশি সময় ধরে চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ ছিল চতুর্থ অবস্থানে। ২০২০ সালে ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে তৃতীয় অবস্থানে ওঠে বাংলাদেশ। শীর্ষে রয়েছে চীন ও ভারত।
স্বাধীনতার পর মসুর ডালের উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষ দশে ছিল। পরে বাংলাদেশ পিছিয়ে যায়। অবশ্য এখন যুক্তরাষ্ট্র, ইথিওপিয়া, রাশিয়া ও চীনকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ ষষ্ঠ অবস্থানে উঠেছে।
ভৌগোলিক অবস্থান, আবহাওয়া ও ভূমির ধরনের কারণে আমাদের দেশে বেশির ভাগ ফসলের উৎপাদন বাড়ছে। সরকারও কৃষিতে ভর্তুকি দিচ্ছে।কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক
উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক পণ্য আমদানিতে বাংলাদেশের ব্যয় কমেছে। এ ক্ষেত্রে পেঁয়াজের উদাহরণ দেওয়া যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, ২০২১-২২ অর্থবছরে মসলাজাতীয় এই পণ্যের উৎপাদন ২৫ লাখ টন ছাড়িয়েছে, যা ছয় অর্থবছর আগের তুলনায় ৪৫ শতাংশ বেশি। পেঁয়াজ ও সমজাতীয় পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে সপ্তম। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, ২০১৮ সালে দেশে প্রায় ১২ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি হয়। তবে উৎপাদন বাড়তে থাকায় আমদানি কমেছে। এখন বছরে সাত লাখ টনের মতো পেঁয়াজ আমদানি হয়।
পেঁয়াজ আমদানি কমায় বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হচ্ছে। বিপরীতে সয়াবিন বীজ, আখ ও তুলার মতো পণ্য উৎপাদন কম হওয়ায় আমদানিতে বিপুল ব্যয় করতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে শুধু ভোজ্যতেল ও চিনি আমদানিতেই বাংলাদেশকে ৪১৭ কোটি ডলার ব্যয় করতে হয়েছে। তুলা আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৪৪৪ কোটি ডলার। ডলার-সংকটের কারণে এখন কিছু পণ্যের আমদানি ব্যাহতও হচ্ছে।
কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ও করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে, ২০২১-২২ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানিতে আয় হয়েছে প্রায় ১১৩ কোটি মার্কিন ডলার। সবজি, শুকনা খাবার, মসলা, সুগন্ধি চাল ইত্যাদি কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ১১৬ কোটি ডলারের বেশি।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে সামগ্রিক অর্থনীতির মতো কৃষিতেও রূপান্তর ঘটছে। অল্প জায়গা নিয়ে উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দশে অনেকগুলো ফসল স্থান পাওয়া ভালো খবর। তবে এই খবরে বেশি আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই। মাথাপিছু ভোগের হিসাবে চাল ও আলু ছাড়া অন্যান্য ফসলে আমরা বেশ পিছিয়ে আছি।’
জাহাঙ্গীর আলম আরও বলেন, ‘সরকার পাঁচ বছর মেয়াদি যে উদ্যোগ (আমদানিনির্ভরতা কমাতে বড় প্রকল্প) নিয়েছে, তা গুরুত্বের সঙ্গে বাস্তবায়ন করতে হবে। এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে আরও অনেক ফসলে মাথাপিছু ভোগের হিসাবেও শীর্ষ দশে যেতে পারব আমরা। সে জন্য চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।’