বর্তমানে আবাসিক বাসাবাড়িতে এক ইউনিট বা এক হাজার লিটার পানির দাম পড়ছে ১৮ টাকা। সেটি ২৩ টাকা ৪০ পয়সা করার সুপারিশ।
চট্টগ্রাম ওয়াসার পানির দাম আরেক দফা বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু হয়েছে। গত ২৭ মার্চ পানির দাম বাড়ানোর জন্য ওয়াসা বোর্ড একটি কমিটি গঠন করে। গত মঙ্গলবার ৮০তম বোর্ড সভায় কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আবাসিকে পানির দাম ৩০ শতাংশ ও অনাবাসিকে ৫০ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করে কমিটি।
বর্তমানে আবাসিক বাসাবাড়িতে এক ইউনিট বা এক হাজার লিটার পানির দাম পড়ছে ১৮ টাকা। অনাবাসিক বা বাণিজ্যিক গ্রাহকদের এক ইউনিট পানির জন্য গুনতে হচ্ছে ৩৭ টাকা। সে হিসাবে কমিটির সুপারিশ হলো, আবাসিকে পানির দাম ২৩ টাকা ৪০ পয়সা ও অনাবাসিকে ৫৫ টাকা ৫০ পয়সা করা যেতে পারে।
প্রায় এক বছর ধরেই পানির দাম বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা চলছে ওয়াসায়। এ বিষয়ে বোর্ডেও আলোচনা হয়েছিল। এ নিয়ে সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে কমিটি গঠন করা হয়। নথি অনুযায়ী, ৭ সদস্যের কমিটিতে আহ্বায়ক হিসেবে আছেন বোর্ড সদস্য সিদ্ধার্থ বড়ুয়া। সদস্য হিসেবে আছেন প্রকৌশলী মোহাম্মদ হারুন, ওয়ার্ড কাউন্সিলর আফরোজা কালাম, সাংবাদিক শহীদ-উল-আলম, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি শেখ মোহাম্মদ শফিউল আজম, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের সদস্য জাফর আহমেদ ও ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক কাজী শহিদুল ইসলাম।
কমিটির আহ্বায়ক সিদ্ধার্থ বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছর কর্তৃপক্ষ ৫ শতাংশ করে পানির দাম বাড়াতে পারে। সর্বশেষ ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বাড়ানো হয়। এরপর আর বাড়ানো হয়নি। এ সময়ে পানির উৎপাদন খরচও বেড়েছে। পানির পরিশোধনে ব্যবহৃত রাসায়নিক, বিদ্যুৎ বিল, জনবলের বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন বিষয় উৎপাদন খরচের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ ছাড়া পানি সরবরাহে ঋণের টাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হচ্ছে। এসব বিষয় মাথায় রেখে দাম বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
সিদ্ধার্থ বড়ুয়া জানান, বর্তমানে উৎপাদন খরচ পড়ছে অন্তত ৩২ টাকা। আর আবাসিকে পানির দাম পড়ছে ১৮ টাকা। ফলে ১৪ টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কমিটি মনে করে, পানির দাম বাড়ানো উচিত।
অবশ্য আইন অনুযায়ী প্রতিবছর পানির দাম ৫ শতাংশ বাড়াতে পারে কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে বোর্ড সদস্যদের অনুমোদন নিতে হয়। আর ৫ শতাংশের বেশি বাড়াতে চাইলে নিতে হয় সরকারের অনুমোদন।
কমিটির সদস্যরা জানান, কমিটির প্রতিবেদন বোর্ড সভায় সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে চূড়ান্ত প্রস্তাব পাঠানো হবে। সেখান থেকে পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব যাবে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে। এরপরই মূলত দাম বাড়ানোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। কমিটির সদস্য প্রকৌশলী হারুন প্রথম আলোকে বলেন, মন্ত্রণালয় ওয়াসার প্রস্তাবের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। এ ক্ষেত্রে দাম আরও কমতেও পারে।
বর্তমানে ওয়াসার আবাসিক গ্রাহক সংযোগ আছে ৭৮ হাজার ৫৪২টি ও বাণিজ্যিক সংযোগের সংখ্যা ৭ হাজার ৭৬৭টি।
গত এক দশকে প্রায় প্রতিবছর পানির দাম বাড়িয়েছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। মাঝখানে ২০২১ সালে করোনা মহামারির কারণে পানির দাম বাড়ানো হয়নি। কিন্তু এরপরের বছরই দুই দফা দাম বাড়ানো হয়। ২০২২ সালের আগস্টে সর্বশেষ পানির দাম বাড়ানো হয়েছিল। তখন প্রতি ইউনিটের জন্য আবাসিক গ্রাহকের পানির দাম ১৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮ টাকা ও বাণিজ্যিকে ৩১ টাকা ৮২ পয়সা থেকে ৩৭ টাকা করা হচ্ছে। সেই হিসাবে আবাসিকে পানির দাম এক লাফে বাড়ে ৩৮ শতাংশ আর বাণিজ্যিকে ১৬ শতাংশ। এবার আবাসিকে ৩০ শতাংশ ও বাণিজ্যিকে ৫০ শতাংশ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে কমিটি।
ওয়াসার হিসাবে, ২০০৯ সালে আবাসিকে প্রতি ইউনিট পানির দাম ছিল ৫ টাকা ৪১ পয়সা, বাণিজ্যিকে ১৫ টাকা ৩২ পয়সা। পাঁচ বছর পর, অর্থাৎ ২০১৪ সালে আবাসিকে পানির দাম হয় ৬ টাকা ৯০ পয়সা, বাণিজ্যিকে ১৯ টাকা ৫৯ পয়সা। আর ২০২০ সালে এসে আবাসিকে পানির দাম দাঁড়ায় ১২ টাকা ৪০ পয়সা আর বাণিজ্যিকে ৩০ টাকা ৩০ পয়সা। এরপর ২০২২ সালের জানুয়ারিতে করা হয় আবাসিকে ১৩ টাকা ও বাণিজ্যিকে ৩১ টাকা ৮২ পয়সা।
নথি অনুযায়ী, বর্তমানে ওয়াসার উৎপাদিত ৩০ শতাংশ পানির কোনো বিল আদায় হয় না। কাগজে-কলমে এটিকে সিস্টেম লস বা কারিগরি অপচয় বলা হয়। ৩০ শতাংশের মধ্যে ৫ শতাংশ ফুটোর কারণে নষ্ট হয়। বাকি ২৫ শতাংশ চুরি, অবৈধ সংযোগ, মিটারে কারসাজির মাধ্যমে নষ্ট হয় বলে দাবি করেছেন ওয়াসার প্রকৌশলীরা। দেশে ঢাকা, রাজশাহী ও খুলনা ওয়াসায় ‘সিস্টেম লস’ চট্টগ্রামের চেয়ে কম। ঢাকা ওয়াসার সিস্টেম লস ২০ শতাংশ, রাজশাহী ওয়াসায় ২৯ শতাংশ ও খুলনা ওয়াসায় ২৪ শতাংশ।
পানির দাম বাড়ানোর পাশাপাশি কারিগরি অপচয়ও কমানো উচিত বলে মনে করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ও পরিকল্পনা অনুষদের ডিন মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পানির দাম বাড়ানো যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে কারিগরি অপচয়ও কমাতে হবে। পাইপের ফুটোর কারণে হাজার কোটি লিটার পানি নষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি অবৈধ সংযোগ, পানি চুরি, মিটারে কারসাজির মতো ঘটনা তো আছেই। কারিগরি অপচয় না কমিয়ে পানির দাম বাড়ানোর মাধ্যমে গ্রাহকেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।