নজরদারির অভাব ও আইনের বাস্তবায়ন না হওয়ায় সড়কে শৃঙ্খলা আসেনি।
নিরাপদ সড়কের জন্য চার বছর আগে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের দেশকাঁপানো আন্দোলনের পর সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে—এমন আশা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে সেটি ঘটেনি। দুর্ঘটনা রোধে সরকার নানা আশ্বাস দিলেও সড়কে বিশৃঙ্খলা আগের মতোই রয়েছে। বিশেষ করে বিদায়ী ২০২২ সাল ছিল গত চার বছরের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী। বিদায়ী বছরে সড়কে অন্তত সাড়ে ছয় হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছেন।
বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার পাশাপাশি সরকারের দিক থেকেও সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। আহত–নিহত ব্যক্তিদের সংখ্যা প্রকাশ করে পরিস্থিতির ভয়াবহতা প্রকাশেরও চেষ্টা থাকে। কিন্তু তাতে যে মা বা বাবা তাঁর সন্তানকে হারিয়েছেন অথবা যে সন্তান তাঁর বাবা বা মাকে হারিয়েছেন, তাঁদের অসহনীয় যন্ত্রণার কথা উঠে আসে না। সড়ক দুর্ঘটনার কারণে হঠাৎ করেই শত শত পরিবারে নেমে আসা বিপর্যয়ের বিষয়টি সংখ্যার ওই হিসাব কোনোভাবেই তুলে ধরতে পারে না।
বিদায়ী বছরের ফেব্রুয়ারিতে এক মায়ের জীবনে ভয়ংকর দুর্যোগ নিয়ে আসে অনিরাপদ সড়ক। গত ৮ ফেব্রুয়ারি ভোরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে পিকআপ ভ্যানের (ছোট ট্রাক) চাপায় তাঁর ছয় ছেলের মৃত্যু হয়। পরদিন পত্রিকায় ছয় ছেলের বিধবা স্ত্রীসহ মা মৃণালিনী সুশীলের সেই ছবি প্রকাশিত হওয়ার পর তা নাড়া দিয়েছিল দেশের মানুষকে। কক্সবাজারের চকরিয়ায় মৃণালিনী সুশীল গতকাল সোমবার রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মতো যাঁরা সন্তান হারিয়ে বেঁচে আছেন, তাঁরাই বুঝবেন জীবন কত কঠিন, কত কষ্টের। দেশে সবকিছুর আগে সড়ক নিরাপদ করা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
২০১৮ সালের ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। তাঁদের আন্দোলনের ফলে নতুন সড়ক পরিবহন আইন হয়েছে। এরপরও পরিস্থিতির পরিবর্তন না হওয়ায় গত বছরও নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থী। কিন্তু পরিস্থিতি আগের মতোই রয়ে গেছে।
নিরাপদ সড়ক নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, নজরদারির অভাব ও আইনের বাস্তবায়ন না হওয়ায় সড়কে শৃঙ্খলা আসেনি। আর সাম্প্রতিক সময়ে ভাড়ায় চালিত (রাইড শেয়ারিং) ও ব্যক্তিগত ব্যবহারের মোটরসাইকেলের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি সড়কে প্রাণহানি বেড়ে গেছে।
প্রাণহানি বাড়ছেই
নিরাপদ সড়কের দাবিতে কাজ করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নিয়মিত সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির হিসাব প্রকাশ করে। সংগঠনটির গত চার বছরের দুর্ঘটনার হিসাব অনুসারে, ২০১৯ সালে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৫ হাজার ২১১ জন। পরের বছর সংখ্যাটি বেড়ে হয় ৫ হাজার ৪৩১। ২০২১ সালে সড়কে নিহত হয়েছেন ৬ হাজার ২৮৪ জন। সর্বশেষ ২০২২ সালের ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সড়কে মৃত্যু হয়েছে ৬ হাজার ৫৪৮ জনের। এর মধ্যে গত জুলাইয়ে সর্বোচ্চ ৭৩৯ জন নিহত হন।
সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে যাত্রী কল্যাণ সমিতিও। তাদের প্রতিবেদনেও সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে গত বছর সর্বোচ্চ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটেছে। তাদের হিসাবে, ২০২১ সালের চেয়ে বিদায়ী ২০২২ সালে সড়কে দুর্ঘটনা ১৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ আর মৃত্যু বেড়েছে ২৭ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণ হচ্ছে—বছর বছর মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের সংখ্যা বৃদ্ধি, নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ছোট ও ধীরগতির যানবাহনের চলাচল দুর্ঘটনা বাড়াচ্ছে।
গতকাল সোমবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র তুলে ধরে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও গতি, বিপজ্জনক পাল্লাপাল্লি, সড়কের ত্রুটি, চলাচলের অনুপযোগী (ফিটনেসবিহীন) যানের অবাধে চলাচল, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে মোটরসাইকেল ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা গণপরিবহনব্যবস্থায় যুক্ত হয়ে প্রাণহানি বাড়িয়ে দিয়েছে।
অনিয়ন্ত্রিত মোটরসাইকেল, ঝুঁকি নিয়ে চলাচল
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, ২০১০ সালে দেশি নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছিল সাড়ে সাত লাখের মতো। এরপর ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে লাখখানেক মোটরসাইকেল যুক্ত হয়। কিন্তু ২০১৫ সাল থেকে মোটরসাইকেলের নিবন্ধন উচ্চ হারে বাড়তে থাকে। গত বছর পাঁচ লাখের বেশি নতুন মোটরসাইকেলের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৫৫ লাখের মতো। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৪০ লাখের বেশি।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, ২০১৮ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ছিল ৯৪৫ জন; যা ২০২২ এসে ২ হাজার ৫৩৩ জনে দাঁড়িয়েছে।
মোটরসাইকেলে মৃত্যুর দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশ শীর্ষে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ২০২১ সালে মোটরসাইকেল বেশি চলাচল করে, এমন ১৬টি দেশের (বাংলাদেশসহ) ওপর সড়ক নিরাপত্তাসংক্রান্ত একটি গবেষণা করে বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)। এতে বলা হয়েছে, প্রতিবছর দেশে প্রতি ১০ হাজার মোটরসাইকেলের বিপরীতে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন ২৮ দশমিক ৪ জন। তাঁদের প্রায় ৪০ শতাংশেরই বয়স ২৪ থেকে ৩০ বছর। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর এই হার সারা বিশ্বে সর্বোচ্চ। যদিও মাথাপিছু মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীর হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান পেছনের (১৬ দেশের মধ্যে) দিকে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এ আই মাহবুব উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বেপরোয়া গতি এবং চালকদের অনিরাপদ জীবনযাপন দুর্ঘটনার অন্যতম বড় কারণ। ফিটনেস ছাড়া যানবাহন সড়কে চললেও প্রশাসনের নজরদারি নেই। বাংলাদেশে অকার্যকর ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা চলে আসছে বছরের বছর ধরে। ফলে সড়কে প্রাণহানি কমার আশা করার কারণ নেই। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, লাইসেন্স ও নিবন্ধন ছাড়াই মোটরসাইকেল নিয়ে মানুষ সড়কে উঠে যাচ্ছে। এসব বন্ধ না হলে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে না।
প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে
সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, তাঁদের মধ্যে কর্মক্ষম ব্যক্তির সংখ্যা বেশি। এর প্রভাব পড়ছে দেশের অর্থনীতিতে। দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত ব্যক্তি এবং তাঁদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের আর্থসামাজিক যে ক্ষতি হচ্ছে, তার হিসাব তৈরি করেছে বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)। প্রতিষ্ঠানটির হিসাব বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় এমন ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার কোটি টাকা।
পুলিশের তথ্যভান্ডার বিশ্লেষণ করে এআরআই বলছে, গত এক দশকে দেশের সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের ৫৪ শতাংশের বয়স ১৬ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। আর দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের সাড়ে ১৮ শতাংশ শিশু। এদের বয়স ১৫ বছরের নিচে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের সড়ক দুর্ঘটনাসংক্রান্ত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, সড়ক দুর্ঘটনায় সারা বিশ্বে বছরে সাড়ে ১৩ লাখ মানুষ মারা যান। এর মধ্যে ৩০ শতাংশের বয়স ২৫ বছরের কম। বিশ্বে তরুণেরা যেসব কারণে বেশি হতাহত হন, এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা শীর্ষে। এ প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর প্রাণহানি হয় ২৫ হাজার মানুষের।
সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর বিশ্লেষণ অনুসারে, কর্মক্ষম যাঁদের বলা হচ্ছে, এর একটা অংশ আবার শিক্ষার্থী। আর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার বিশ্লেষণে দেখা যায়, হতাহতের শিকার ব্যক্তিদের বড় অংশই বয়সে তরুণ, শিক্ষার্থী। বিষয়টি এমন যে সহপাঠী কিংবা বন্ধুরা একসঙ্গে একই মোটরসাইকেলে চলাচলের সময় দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছেন।
বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সড়কে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ মোটরসাইকেলের সংখ্যা বৃদ্ধি—এটা বলতে কোনো দ্বিধা নেই। এ ছাড়া সড়কের শৃঙ্খলার অভাব তো আছেই। তিনি বলেন, ‘সড়ক খাতে শাসন বলে কিছু নেই। দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমাতে হলে আগে শৃঙ্খলা ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু কথা দিয়ে তো সড়ক নিরাপদ হবে না।’
* তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রথম আলোর চকরিয়া প্রতিনিধি