র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে। পাশাপাশি তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ সরকারের পক্ষ থেকে যথাযথ ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছে সংস্থাটি।
র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনায় আজ বুধবার রাজধানীর লালমাটিয়ায় আসকের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির পক্ষ থেকে এ কথা বলা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান আসকের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়কারী আবু আহমেদ ফয়জুল কবির। লিখিত বক্তব্যে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর পরপরই তাঁর ছেলে শাহেদ হোসেনকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে রাজশাহী র্যাব ক্যাম্পে কেন নেওয়া হয়েছিল এবং কোন পর্যায়ের কর্মকর্তারা তাঁকে কী বার্তা দিয়েছিলেন তা খুঁজে বের করা, র্যাবের পক্ষ থেকে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর পর থেকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগের নামে কার্যত চাপ প্রয়োগের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
সুলতানা জেসমিন নওগাঁ সদর উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়ন ভূমি কার্যালয়ে অফিস সহকারী পদে চাকরি করতেন। ২২ মার্চ সকালে নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড় এলাকা থেকে তাঁকে আটক করে র্যাব। আটক অবস্থায় র্যাব সুলতানা জেসমিনকে প্রথমে নওগাঁ সদর হাসপাতাল এবং অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে র্যাব পাহারায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। ২৪ মার্চ তিনি মারা যান। অন্যদিকে ২৩ মার্চ রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের পরিচালক (স্থানীয় সরকার) মো. এনামুল হক জেসমিন সুলতানার বিরুদ্ধে রাজপাড়া থানায় একটি মামলা করেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, এ ঘটনায় আসক তথ্যানুসন্ধান করছে। আটক একজন ব্যক্তিকে যেখানে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে উপস্থাপনের আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে, সেখানে সুলতানা জেসমিনকে আটকের ৩০ ঘণ্টার বেশি সময় পর আসামি করে মামলা করার বিষয়টি লিখিত বক্তব্যে তুলে ধরা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে আসকের নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান বলেন, সুলতানা জেসমিনের আটকের বিষয়টাই আইনের বড় ধরনের ব্যত্যয়। ঘটনাটি পরম্পরায় সাজালে যে কেউ বুঝতে পারবেন যে তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলাটি সাজানো। শুধু সুলতানা জেসমিন নন, এর আগেও লিমনসহ বিভিন্ন ঘটনায় র্যাবের পক্ষ থেকে ঘটনা আড়াল করার যে চেষ্টা, তাতে শুধু ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, পুরো বাহিনী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিভিন্ন প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দিচ্ছে।
দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়ে নূর খান বলেন, দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ব্যাপক হারে ঘটছে। সুলতানা জেসমিনের ঘটনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন দেরিতে হলেও সক্রিয় হয়েছে। আসকের তথ্যানুসন্ধান শেষে তা জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে জানানো হবে।
সংবাদ সম্মেলনে নূর খান বলেন, র্যাবের প্রহরাধীন অবস্থায় সুলতানা জেসমিনের চিকিৎসা চলে। তাঁর সন্তান হাসপাতালে গিয়েও মাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পাননি। মায়ের মৃত্যুর পর ছেলেকে র্যাবের কার্যালয়ে নেওয়া হয়। এটা চূড়ান্ত অর্থেই হুমকি। এগুলো নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
নূর খান বলেন, সুলতানা জেসমিনের (৪৫) মৃত্যুর ঘটনায় র্যাব তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেদের তদন্ত নিজেরা করতে গেলে মানুষের আস্থার বিষয়টি সামনে আসে। বর্তমানে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তাতে র্যাব যাতে সুলতানা জেসমিনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ না করে, সে আহ্বান জানিয়ে নূর খান বলেন, মনস্তাত্ত্বিকভাবে তাঁর পরিবারের সদস্যদের র্যাবের প্রতি আস্থা নেই। ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
সুলতানা জেসমিনের স্বজনেরা অভিযোগ করেছেন, র্যাব হেফাজতে সুলতানা জেসমিনকে নির্যাতন করা হয়েছে। এর ফলে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তবে র্যাবের পক্ষ থেকে সুলতানা জেসমিনকে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। সুলতানা জেসমিনকে র্যাবের আটকের বিষয়ে নওগাঁ সদর থানা অবহিত ছিল না, সুরতহাল প্রতিবেদন, ফরেনসিক চিকিৎসকের বক্তব্য অনুযায়ী, সুলতানা জেসমিনের ডান হাতের কনুইয়ের কাছে আঘাতের চিহ্ন ছিল, মৃত্যুর পর স্বজনদের শুধু মুখ ছাড়া শরীরের অন্য কোনো জায়গা দেখতে না দেওয়াসহ বিভিন্ন বিষয় প্রশ্ন ও সন্দেহের জন্ম দিয়েছে বলে উল্লেখ করেন নূর খান। এগুলোকে তিনি আইনের ব্যত্যয় হিসেবে উল্লেখ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে আসকের পরিচালক নীনা গোস্বামী ও সমন্বয়কারী দিলীপ পাল উপস্থিত ছিলেন।