‘পাবলিক কি এহন পকেটে পয়সা রাখে, এ ভাড়া দিবো কীভাবে’

ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

আবদুল্লাহপুর থেকে ফুলবাড়িয়া পর্যন্ত চলে এয়ারপোর্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ পরিবহন। রাজধানীর বিজয় সরণি সিগন্যালে আবদুল্লাহপুরমুখী এ বাস থামার পর তাতে উঠে পড়লাম। উঠে বাসচালকের সহকারীকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কাল তো বাসভাড়া কমানো হয়েছে, ভাড়া কত কমল?’

চালকের সহকারী এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই জনাতিনেক যাত্রী কথা বলে উঠলেন। তাঁদের সবার কথা, সামান্যও কমেনি বাসের ভাড়া। তাঁদের মধ্যে রমজান আলী নামের এক যাত্রী বলেন, তিনি উঠেছেন ফার্মগেট থেকে। যাবেন বনানী। আগে ভাড়া ছিল ১২ টাকা। আজও তা–ই দিয়েছেন।

যাত্রীর কথা শুনে চালকের সহকারী ইমাদুলের দাবি, আগে ছিল ১৪ টাকা ভাড়া; আজ ২ টাকা কম নিয়েছেন।

এ কথায় হা হা করে উঠলেন রমজান। বললেন, ‘ভাড়ার তালিকা নিয়্যা আসো দেহি। খালি মিছা কথা।’
এ কথায় অবশ্য চালকের সহকারী চুপ।

আরেক যাত্রী অঞ্জন সাহার কথা, ‘পাঁচ পয়সা ভাড়া কমাইছে, এরা কয় টাকা কমাবো কন? পাঁচ পয়সা কমাইয়্যা পাঁচ আনা লাভ হয় নাই।’

ডিজেলে চলাচলকারী বাস-মিনিবাসের ভাড়া কিলোমিটারে পাঁচ পয়সা কমানো হয়েছে গতকাল বুধবার। এতে যাত্রীদের কতটা লাভ হবে, প্রশ্ন তা নিয়েই।

সরকার গত সোমবার জ্বালানি তেলের দাম লিটারে পাঁচ টাকা কমিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতি কিলোমিটারে ৫ পয়সা ভাড়া কমানোর অর্থ—একজন যাত্রী ২০ কিলোমিটার চললে ১ টাকা ভাড়া কমবে। কিন্তু নগর পরিবহনে বেশির ভাগ যাত্রীই স্বল্প দূরত্বে চলাচল করেন। তাই কিলোমিটারে পাঁচ পয়সা ভাড়া কমায় কোনো প্রভাব দেখা গেল না। অনেকরেই হাতে খুচরা পয়সা নেই। ৩ থেকে ৪ কিলোমিটার দূরত্বে গেলে ১৫ থেকে ২০ পয়সা কমবে। এ ভাড়া যাত্রীরা কীভাবে দেবেন আর বাসের লোকজনই–বা কীভাবে নেবেন, সে প্রশ্ন করলেন ট্রাস্ট পরিবহনের চালক তারেক মোল্লা। তিনি যুক্তি দিলেন, কারওয়ান বাজার থেকে মিরপুর-১০–এর দূরত্ব ১৩ কিলোমিটার। সে ক্ষেত্রে ভাড়া কমাতে হয় ৬৫ পয়সা। এ ভাড়া তাঁরা বা যাত্রীরা কীভাবে লেনদেন করবেন? তারেক মোল্লার কথা, ‘পাবলিক কি এহন পকেটে পয়সা রাখে, এ ভাড়া দিবো কীভাবে?’

গত ৬ আগস্ট ডিজেলের দাম প্রতি লিটারে ৩৪ টাকা বাড়ানোর পর দূরপাল্লায় প্রতি কিলোমিটারে ৪০ পয়সা এবং নগর পরিবহনে ৩৫ পয়সা হারে ভাড়া বৃদ্ধির ঘোষণা দেয় সরকার। গতকালের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রাজধানীতে প্রতি কিলোমিটারে বাসভাড়া ২ টাকা ৪৫ পয়সা এবং দূরপাল্লার পথে ২ টাকা ১৫ পয়সা হবে। আজ বৃহস্পতিবার থেকে নতুন ভাড়ার হার কার্যকর হওয়ার কথা। কিন্তু সে বার্তা চালকের কাছে পৌঁছায়ওনি। এমনটা দাবি করলেন চিড়িয়াখানা থেকে সদরঘাট পর্যন্ত চলা তানজিল পরিবহনের চালক সুমন মিয়া। তিনি বলেন, ‘কাল কত ভাড়া কমাইছে, খবর পাই নাই। মালিক তো কিছু কয় নাই।’
সুমনের এ কথা শুনে তাঁর ঠিক পেছনে বসা যাত্রী রউফ গাজীর উক্তি, ‘তোমাগো জানাইয়া কী করবো, যে ভাড়া কমাইছে, হেরা তো কইতেও লজ্জা পাইছে।’

মালিকেরা লজ্জা পেয়ে তালিকা পাঠাননি বা কমানোর নির্দেশ দেননি কি না, তা জানা যায়নি। তবে ঢাকা শহরে এ ভাড়া কমানোয় যেকোনো প্রভাব পড়বে না, তা স্বীকার করেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আজ অনেক জায়গায় তালিকা যায়নি। দু–এক দিনের মধ্যে যাবে। কিন্তু তালিকা গেলেও ঢাকায় এর তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না। ঢাকা শহরে গাড়ি চলে পাঁচ হাজার। আর সারা দেশে লক্ষাধিক গাড়ি চলে।
এনায়েত উল্যাহর দাবি, দূরপাল্লার বাসে ভাড়া কমানোর প্রভাব পড়বে।

কিন্তু দূরপাল্লার বাসেই–বা কত ভাড়া কমবে? ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব ২৪২ কিলোমিটার। বিআরটিএ যেভাবে ব্যয় বিশ্লেষণ করেছে, তাতে একটি বাস একবার চট্টগ্রামে গেলে প্রায় ৪০০ টাকা জ্বালানি খরচ কমবে। এই পথের বেশির ভাগ বাস দিনে একবার করে যাওয়া-আসা করে। ফলে ৮০০ টাকা জ্বালানি খরচ বাঁচবে। এ পথে যাত্রীপ্রতি ভাড়া কমবে ১২ টাকা।

জ্বালানির দাম বাড়লে বাসের ভাড়া যত দ্রুত সম্ভব বাড়িয়ে ফেলা হয়। কিন্তু কমলে এর প্রভাব অনেক দেরিতে হয়; কখনো হয়ই না। এর আগে ২০১৬ সালে ডিজেলের দাম লিটারে ৩ টাকা কমানোর পর বাসভাড়া ৩ পয়সা কমানো হয়, যা মালিক-শ্রমিকেরা মানেননি।

মিরপুর থেকে যাত্রাবাড়ীতে চলা খাজাবাবা পরিবহনের ভাড়ার প্রসঙ্গে আসতেই যাত্রী ইব্রাহীম মণ্ডল বলেন, ‘এটাই তো হয়। তেলের দাম সন্ধ্যায় বাড়াইলে রাতেই ভাড়া বাড়ায়ে দেয়; কিন্তু কমালে খবর থাকে না।’