কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী (১৯২৭–২০০৭)।
কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী 
(১৯২৭–২০০৭)।

যেভাবে রচিত হয়েছিল একুশের প্রথম কবিতা

চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লা মোড় থেকে নবাব সিরাজউদ্দৌলা রোডের সরু গলি ধরে একটু এগোতেই রাস্তা লাগোয়া পুরোনো দোতলা দালান। দালানের নিচের দিকের দেয়ালে নামফলকে লেখা ‘কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস’। একটু সামনেই ভবনের মূল ফটক। ভেতরে অফসেট মেশিন ঘিরে শ্রমিকদের ব্যস্ততা। ঢুকতেই মুহূর্তের জন্য সবাই কাজ থামিয়ে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালেন। আসার কারণ ব্যাখ্যা করার পর একজন জানালেন, ‘হ্যাঁ, এটাই সেই ছাপাখানা।’

কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী রচিত একুশের প্রথম কবিতাগ্রন্থ কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি ছাপা হয়েছিল এই প্রেসেই। সে কথা তুলতেই এক কর্মকর্তা বললেন, ‘তখনকার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একজন ছাড়া তাঁদের কেউ আর বেঁচে নেই। যন্ত্রগুলোও বদলেছে। কেবল বদলায়নি ছাপাখানার কক্ষটা।’

একুশের প্রথম কবিতা রচনার পটভূমি, ছাপা হওয়া, সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ হওয়া, এরপর হারিয়ে যাওয়া এবং দীর্ঘ সাড়ে চার যুগ পর পুনরুদ্ধারের ঘটনা রহস্য-রোমাঞ্চের উপন্যাসের মতোই কৌতূহলোদ্দীপক। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আর কোনো কবিতা নিয়ে এমন সব কাণ্ড ঘটেছে কি না, জানা যায় না। আর এসবের সাক্ষী হিসেবে এখনো দাঁড়িয়ে আছে কোহিনূর প্রেস।

১৯৫২ সালের কথা। তখন চট্টগ্রামে হস্তচালিত টেলিফোন সেট ছিল হাতেগোনা কয়েকটি সরকারি কার্যালয়ে। লালদীঘির ময়দানে নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়েও একটি টেলিফোন সেট ছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি বিকেল নাগাদ সেই টেলিফোনেই একটি খবর আসে ওই কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে। কবি মাহবুব উল আলম তখন ছিলেন নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের ঠিক পাশে অবস্থিত তাঁর পৈতৃক প্রতিষ্ঠান খুরশীদ মহল প্রেক্ষাগৃহে। ঢাকায় ছাত্র-জনতার ভাষার মিছিলে গুলি চালানোর খবর যখন পান, তখন তাঁর শরীরে ১০৪ ডিগ্রি জ্বর। তবু এনায়েতবাজার বাটালি রোডের বাসায় ফিরে জ্বর নিয়েই বসলেন কবিতা রচনায়। প্রচণ্ড জ্বরের কারণে লেখার ক্ষমতা ছিল না। ঘোরগ্রস্তের মতো কবি বলছিলেন আর লিখছিলেন খুরশীদ মহলের কর্মচারী ও কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ননী ধর।

মাহবুব উল আলম চৌধুরীর কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি বইয়ের ভূমিকা, চৌধুরী জহুরুল হক রচিত প্রসঙ্গ: একুশের প্রথম কবিতা, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস রচিত, বাংলাভাষার বিরুদ্ধে আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত বইতে ও নানা সময়ে লেখা বিভিন্ন লেখকের প্রবন্ধে এই কবিতা রচনার মুহূর্ত ও তার পরবর্তী ঘটনার বিবরণ আছে।

প্রকাশ ও নিষেধাজ্ঞা  

১৯৫২ সালে ২৫ বছর বয়সী যুবক মাহবুব উল আলম ছিলেন চট্টগ্রামের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক। তাই কেন্দ্রীয় নেতাদেরও আনাগোনা ছিল তাঁর বাসায়। কবিতাটি রচনার পরপরই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস তাঁর বাসায় আসেন। একুশের প্রথম কবিতার পাঠক হওয়ার সৌভাগ্য হয় তাঁর। ২২ ফেব্রুয়ারি ইলিয়াস কবিতাটি ছাপার জন্য কোহিনূর প্রেসে নিয়ে যান। ছাপাখানাটির স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আবদুল খালেক ছিলেন ভাষা আন্দোলনের সমর্থক। তাই এমন একটি বিস্ফোরক কবিতা ছাপার ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করেননি। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ১/৮ ডিমাই আকারের আট পৃষ্ঠার পুস্তিকায় ছাপা হবে কবিতাটি। প্রকাশক হবেন কামাল উদ্দিন আহমদ বি.এ। ছাপা হবে পাঁচ হাজার কপি। দাম দুই আনা। রাতে ছাপার কাজ চলার সময় তৎকালীন পুলিশ সুপার আলমগীর কবিরের নেতৃত্বে একদল পুলিশ হানা দেয় প্রেসে। তখন ছাপাখানার কর্মীরা ভাষা আন্দোলনের সংগঠক ইলিয়াসকে গোপন স্থানে লুকিয়ে ফেলেন। সরিয়ে ফেলেন কবিতার সব কম্পোজ কপি। তাই পুলিশ তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছু পায়নি।

ছাপা হয়ে বইটি বের হওয়ার পরদিন ২৪ ফেব্রুয়ারি লালদীঘির প্রতিবাদ সভায় কবিতাটি পাঠ করেন চৌধুরী হারুনর রশীদ। আর সেদিনই পাকিস্তান সরকার কবিতাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী, চৌধুরী হারুনর রশীদ, প্রকাশক কামাল উদ্দিন আহমদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। গ্রেপ্তার হন চৌধুরী হারুনর রশীদ ও প্রেস ম্যানেজার দবির আহমদ চৌধুরী। প্রায় আট মাস কারাভোগের পর ২৩ অক্টোবর খালাস পান তাঁরা।

নিষেধাজ্ঞার ফলে দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর আড়ালে থাকায় একসময় কবিতাটি হারিয়েই যায়। ১৯৮২ সালে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম কবির স্মৃতি থেকে কবিতাটি উদ্ধারের চেষ্টা করেন এবং উদ্ধার করা অংশটুকু তাঁর ভাষা আন্দোলন ও শহীদ মিনার বইতে ছাপেন। এর কয়েক বছর পর বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে একুশের প্রথম কবিতাটি হারিয়ে যাওয়ার কথা জানান কবি মাহবুব উল আলম।

কবির স্বহস্তে লেখা ‘কাঁদতে আসিনি ফঁাসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতার পাণ্ডুলিপি

হারিয়ে যাওয়া কবিতা পুনরুদ্ধার

মাহবুব উল আলমের টেলিভিশনে সাক্ষাৎকারটি দেখেছিলেন প্রকাশক মফিদুল হকের ফুফু মীর মঞ্জুরা বেগম। দেখে আবাক হয়েছিলেন তিনি । ৩৬ বছর ধরে তো এই কবিতা তাঁর কাছেই আছে। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস এলেই ভাই-বোন সবাই মিলে পড়েন কবিতাটি। কী করে তাঁর হাতে কবিতাটি এল সে প্রসঙ্গটি উল্লেখ আছে মীর মঞ্জুরা বেগমের ‘আমার স্মৃতিতে একুশের প্রথম কবিতা’ শিরোনামের স্মৃতিকথায়। সেখানে তিনি লেখেন, তাঁর বড় ভাই মীর আশরাফুল ছিলেন সে সময়কার পুলিশের কর্মকর্তা। ভাষা আন্দোলনের পরে তিনি সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এস এম হল তল্লাশি করতে গিয়ে কিছু কাগজপত্রের সঙ্গে উদ্ধার করেন মাহবুব উল আলম চৌধুরীর পুস্তিকাটি। ভাইয়ের হাত ঘুরে মঞ্জুরা বেগমদের ঢাকার নাজিরাবাজারের বাসায় এসে পৌঁছায় সেই কবিতা। তখন দশম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন মঞ্জুরা। কবিতাটি লাল কালিতে ডায়েরি টুকে নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৮৮ সালে টেলিভিশনে মাহবুব উল আলম চৌধুরীর সাক্ষাৎকার প্রচারিত হওয়ার পর অধ্যাপক মাহবুবুল হকের মাধ্যমে কবিতাটি তিনি কবির কাছে পঠিয়ে দেন। তবে হাতে লেখা এই কবিতা থেকে কিছু অংশ বাদ পড়েছিল। পরে সেই ঘাটতি পূরণ করতে এগিয়ে আসেন গবেষক অধ্যাপক চৌধুরী জহুরুল হক। কোহিনূর প্রেসের সেই সময়কার তত্ত্বাবধায়ক আবু মোহাম্মদ তবিবুল আলমের কাছে জহুরুল হক পুস্তিকাটির একটি কপি পেয়ে যান ১৯৯২ সালে। সেই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদীর বিশেষ সংখ্যায় ছাপা হয় কবিতাটির পূর্ণাঙ্গ এবং আদি সংস্করণ।

১৯৮৮ সালে দীর্ঘ ৩৬ বছর পর মঞ্জুরা বেগমের কাছ থেকে কবিতার হাতে লেখা অনুলিপি পেয়ে হারানো সন্তান ফিরে পাওয়ার অনুভূতি হয়েছিল মাহবুব উল আলম চৌধুরীর। সেটা ছিল ফেব্রুয়ারি মাসের কোনো একদিন। প্রথম আলোয় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কবির স্ত্রী জওশন আরা রহমান বলেছিলেন, ‘সেদিন কী একটা কাজে বাইরে গিয়েছিলাম। ঘরে ঢুকেই দেখি, তিনি গভীর ভাবনায় নিমগ্ন। কাছে গিয়ে বসতেই বললেন, হারানো সন্তানকে ফিরে পেয়েছেন। এটা তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।’