ইলিশের দাম এবার বেশি কেন

৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষে গত ২৩ জুলাই সাগরে মাছ ধরা শুরু হয়। নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। মৎস্যজীবীরাও তখন দল বেঁধে সাগরে ছুটতে থাকেন। মাছও ভালো মেলে। শুরুর দিকে  কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইলিশের উৎপাদন বেশি হয়েছিল। পরে ইলিশের ক্ষেত্র বৃহত্তর বরিশাল ও চাঁদপুর অঞ্চলেও মাছ ধরা পড়া শুরু করে। তবে এবার ইলিশের সবচেয়ে বড় মৌসুমের এ সময়ের শেষ প্রান্তে এসে দেখা যাচ্ছে, দাম অপেক্ষাকৃত বেশি।

মৎস্যজীবী, বিভিন্ন প্রান্তের আড়তদার, ঢাকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে। তাঁরা বলছেন, ইলিশের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে একাধিক কারণ আছে। এর মধ্যে একটি হলো কম বৃষ্টি হওয়া।

আর এ জন্য ইলিশ পাওয়া গেছে কম। আবার ইলিশ মৌসুমের বড় সময়ে সমুদ্র উত্তাল থাকায় মাছ ধরতে বাধা পাওয়ার কথা বলেছেন মৎস্যজীবীরা। ট্রলার ব্যবসায়ী ও আড়তদারেরা বলছেন, ইলিশ মৌসুমে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ইলিশ আহরণের খরচ অনেক বেড়ে গেছে । আবার এর পরিবহনের খরচেও প্রভাব পড়েছে। তাই দামও বেড়েছে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের সহসভাপতি এস এম নাজির হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, এবার ইলিশের দাম অপেক্ষাকৃত বেশি। আমাদের পর্যবেক্ষণে এমনটাই দেখা যাচ্ছে। ইলিশের আমদানি কম হওয়ার কথা বলেছেন এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। ব্যবসায়ীরা জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। এসব বিষয় অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের পাইকারি মাছের বাজারের সামনের রাস্তায় প্রায় দিনভর মাছের খুচরা বিকিকিনি চলে। এই বিকিকিনি বেশি জমে সন্ধ্যায়। অফিস থেকে ঘরে ফেরা মানুষ এসব দোকানে ঢুঁ মারেন।

গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাজারে গিয়ে বেশ ভিড় দেখা গেল। দোকানগুলোর প্রায় প্রতিটিতে ইলিশ মাছই বেশি বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতাদের আগ্রহও এই ‘রুপালি শস্যের’ দিকে। আর এক সপ্তাহ বাদে ইলিশ ধরা ও বেচাকেনা বন্ধ। বাজারের ভিড়ের কারণ হয়তো সে কারণেই বেশি।

একটি দোকানের সামনে ইলিশের দরদাম করছিলেন ইলিয়াস হোসেন। কারওয়ান বাজারের একটি বাণিজ্যিক অফিসের কর্মকর্তা। তাঁর ইচ্ছা, এক কেজি ওজনের ইলিশ নেবেন। দোকানি নুরু মোল্লা দাম হাঁকলেন, ১ হাজার ২০০ টাকা কেজি। বেশি নিলে ১ হাজার ১০০। এর কমে পারবেন না। শেষমেশ ১ হাজার ১২৫ টাকায় রফা হলো।

এবার শুরু থেকে ইলিশের দাম একই রয়েছে বলছেন ক্রেতারা

ইলিয়াস হোসেন বলছিলেন, এবার শুরু থেকে ইলিশের দাম প্রায় একই রকম থাকল। তবে মাঝে যে দাম বেড়েছিল, তা থেকে কিছুটা কমেছে। কিন্তু তারপরও গতবারের চেয়ে অনেক বেশি।

দোকানগুলোতে নানা ওজনের ইলিশ আছে। তবে আধা কেজির ইলিশের পরিমাণ কম। কিন্তু সেসব কেনার আগ্রহী ক্রেতার সংখ্যা কম নয়। রেহানা ইসলাম এসব ক্রেতার একজন। আধা কেজির এসব ইলিশের দাম সাড়ে ৬০০ টাকা চাইছিলেন ক্রেতা। মগবাজারের বাসিন্দা রেহানা দাম বললেন, পাঁচ শ টাকা কেজি।

রেহানা বলছিলেন, ‘আমাদের মতো মানুষের কাছে ইলিশ এবার অধরা প্রায়। বাচ্চাদের জন্যই কষ্ট করে হলেও কিনতে হচ্ছে। কিন্তু দ্যাখেন হাফ কেজির ইলিশের দাম চায় কত।’

দোকানি আমির হোসেনের কথা, ‘মৌসুমের শ্যাষে এবার দাম কমছে। শুরুতে বেশি আছিল। মাস শেষে লোকজন বেতন পাইছে। বেচা বন্ধ হওয়ার আগে আগে আরও দাম বাড়ব।’

ক্যাব বছরব্যাপী ইলিশের দামের মূল্যায়ন করে। তারা মূলত রাজধানীর ১৪টি খুচরা বাজারে ইলিশের দামের চিত্র তুলে ধরে। সেই হিসাবে দেখা যায়, গত বছর ৫০০ গ্রামের ইলিশের দাম ছিল ৭২৩ টাকা। আর এক থেকে দুই কেজি ওজনের ইলিশের দাম ছিল ১ হাজার ২২৭ টাকা।

ক্যাবের এই দামের মধ্যে দুই কেজির ইলিশও আছে। এর দাম এবার কেজিতে ১ হাজার ৪০০ টাকার নিচে কখনো মেলেনি বলে ক্যাব সূত্র জানিয়েছে। এবার ভরা মৌসুমে ইলিশের দামের একটি তুলনামূলক চিত্র দিলেন কারওয়ান বাজারের কিচেন মার্কেটের নিচের মাছের বাজারের ব্যবসায়ী মিন্টু পোদ্দার। জানালেন, এবার বছরজুড়ে এক কেজির ইলিশ কখনোই ১ হাজার ১০০ টাকার নিচে নামেনি।

গত বছর এর দাম সাড়ে নয় শ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে ছিল। সাত শ গ্রাম থেকে কিছু বড় মাপের ইলিশের দাম আট শ থেকে সাড়ে আট শ টাকার মধ্যে আছে। এর দাম সাত শ টাকার ওপরে ওঠেইনি গেল বছর।

মিন্টু পোদ্দার বলছিলেন, ‘এবার আমদানিই কম। হেরপর ত্যালের দাম। দাম কমব কীভাবে?’ পটুয়াখালীর কলাপাড়ার শিববাড়িয়া নদীর পাড়ে মহীপুর মাছের আড়ত। এ আড়ত বিখ্যাত ইলিশের জন্য। সাগর থেকে মৎস্যজীবীদের দল মাছ ধরে এখানে আনে। চলে বিকিকিনি।

বেশি দামের জন্য ইলিশের আমদানি কম হওয়াকে কারণ হিসেবে মনে করছেন বিক্রেতারা

প্রতিবছর বিশেষ করে জুলাই থেকে অক্টোবরের ইলিশের মূল মৌসুমে গমগম করে এ আড়ত। এবার কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্ন। মহীপুর মৎস্য আড়তদার সমবায় সমিতির সভাপতি দিদার উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, ‘এবার ইলিশ ধরা পড়েছে কম। আমরা গবেষক না। কিন্তু একটা বিষয় মনে হয়, এবার এত অল্প বৃষ্টি হয়েছে যে ইলিশ বেশি আসতে পারে নাই।’

গত ৫ আগস্ট থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সরকার। ডিজেলের দাম লিটারে ৩৪ টাকা, অকটেনের দাম লিটারে ৪৬ টাকা আর পেট্রলের দাম লিটারে ৪৪ টাকা বাড়ানো হয়। পরে অবশ্য লিটার প্রতি ৫ টাকা করে কমানো হয় সেই দাম। ইলিশ ধরতে সমুদ্রে বা নদীতে যাওয়ার বাহন যে ট্রলার তার জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়াকে ইলিশের মূল্যবৃদ্ধির একটি কারণ বলে মনে করেন মহীপুর আড়তের ব্যবসায়ী ফজলু গাজী। তিনি বলেন, একটি বড় ট্রলার সমুদ্র গেলে এর পেছনে সাড়ে তিন লাখ থেকে চার লাখ টাকা খরচ আছে।

ভালো মাছ পেলে তা পুষিয়ে যায়। কিন্তু এবার তো তেমন ইলিশ মেলেনি। ফজলু গাজীর দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, এবার এক কেজির ইলিশের দাম ছিল ৪৪ থেকে ৪৫ হাজার টাকা মণ। আবার ৬০০ থেকে ৮০০ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৩৪ থেকে ৩৫ হাজার টাকা মণ। গত বছর কেজির ইলিশ ৪০ হাজার এবং ৬০০ বা এর বেশি গ্রামের ইলিশ ২৮ থেকে ৩০ হাজারে বিক্রি হয়েছে।

কারওয়ান বাজারে মাছের দামের তালিকা

এবার আগস্টের শেষ দিক থেকে সেপ্টেম্বর মাসে বার চারেক সাগরে লঘুচাপ দেখা যায়। সে সময় তিন বন্দরে ৩ নম্বর সতর্কসংকেত দেখায় আবহাওয়া অধিদপ্তর। এর ফলে অন্তত ২০ দিন সমুদ্রে ইলিশর সন্ধানে নৌযানগুলো যেতে পারেনি বলে দাবি করেন দিদার উদ্দিন আহমেদ।

প্রজনন-সফলতার অপেক্ষাকৃত বেশি হার দেখার পর ইলিশ-সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা এবার ভালো মৌসুমের আশা করেছিলেন। ইলিশের ডিম ছাড়ার হার হলো প্রজনন-সফলতা। মৌসুমের শেষে অক্টোবর মাসে এই হার দেখা হয়। গত বছরের প্রজনন-সফলতার হার ছিল ৫১ দশমিক ৭৬।

আগের বছর এ হার ছিল ৫১ দশমিক ২। এবার প্রথম দিকে ইলিশ ধরাও পড়ে যথেষ্ট। কিন্তু দিন যতই যেতে থাকে, বৃষ্টির পরিমাণ কমে আসে। আর ইলিশের উৎপাদনও কমতে থাকে। পরে সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে নিম্নচাপ হওয়ার পর প্রচুর বৃষ্টি হয়। ইলিশের সরবরাহ বাড়তে থাকে। তবে তা আশানুরূপ বলছেন না ব্যবসায়ীরা।

কক্সবাজারের ব্যবসায়ী শফি আলম দীর্ঘদিন ধরে ইলিশ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। তাঁর কথা, টালমাটাল আবহাওয়ার কারণেই সম্ভবত এবার ইলিশ কম হয়েছে। প্রথমে ভালো ইলিশ পাওয়া গেলেও কম বৃষ্টিতে ইলিশের সরবরাহ কমে আসে। পরে বৃষ্টি হলেও যতটুকু পাওয়া যাচ্ছে, তা অন্তত আগের বারের চেয়ে বেশি না।

এবার ইলিশ কম পাওয়া যাচ্ছে, তার সঙ্গে অবশ্য একমত নন মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশ শাখার প্রধান মাসুদ আরা মমি। তবে দাম যে এবার কিছু বেড়েছে, তা স্বীকার করেন তিনি। মাসুদ আরা মমি বলছিলেন, ‘জ্বালানিসহ সবকিছুর দাম বেড়েছে। ইলিশের দাম যে কিছু বেড়েছে, তা অস্বীকার করতে পারি না। আর এটাই স্বাভাবিক ছিল।’

প্রধান প্রজনন মৌসুমে ইলিশ মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। মা ইলিশের প্রজনন নিরাপদ রাখার লক্ষ্যে আগামী ৭ থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন সারা দেশে ইলিশ ধরা বন্ধ থাকবে। এ সময়ে পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়, মজুত ও বিনিময় নিষিদ্ধ থাকবে।  

এরপর ইলিশ অপেক্ষাকৃত বেশি ধরা পড়বে বলে আশা করেন বরিশালের মৎস্য অফিসের মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাস। তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞার পর ইলিশ ভালো ধরা পড়বে। এর ফলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে আমরা আশা করতে পারি।’