রহনপুর ছিল বরেন্দ্র এলাকার প্রবেশদ্বার, তবে প্রয়োজন আরও গবেষণা

‘রহনপুর: বরেন্দ্রভূমির প্রবেশদ্বার’ শীর্ষক বিশেষ বক্তৃতার আয়োজনে গবেষণায় প্রাপ্ত নিদর্শন ও পদ্ধতি তুলে ধরা হয়। এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, ১১ মে
ছবি: সাজিদ হোসেন

চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর এলাকাটি ছিল প্রাচীনকালে বরেন্দ্র এলাকার একটি সমৃদ্ধ নগর। মূলত এই শহর ছিল বরেন্দ্র এলাকার প্রবেশদ্বার। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় প্রাপ্ত নিদর্শন থেকে এই অনুমান করছেন গবেষকেরা। এই এলাকা নিয়ে আরও নিবিড় ও ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন তাঁরা।

রাজধানীর নিমতলী এলাকায় এশিয়াটিক সোসাইটি আজ শনিবার বিকেলে তাদের মিলনায়তনে ‘রহনপুর: বরেন্দ্রভূমির প্রবেশদ্বার’ শীর্ষক বিশেষ বক্তৃতার আয়োজন করে। রহনপুর নিয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ও শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির প্রত্নতাত্ত্বিক দল গবেষণা করেছে। গবেষণায় প্রাপ্ত নিদর্শন ও পদ্ধতি তুলে ধরতেই এই আয়োজন করা হয়। এ উপলক্ষে মিলনায়তনের সামনের অঙ্গনে রহনপুরে প্রাপ্ত প্রত্ননিদর্শনগুলো প্রদর্শন করা হয়।

অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক হারুন অর রশিদ। স্বাগত বক্তব্য দেন অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান। অনুষ্ঠানে গবেষণা নিয়ে তিনটি আলাদা বিষয়ে উপস্থাপনা করা হয়।

গবেষক দলের প্রধান কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুহম্মদ সোহরাব উদ্দীন গবেষণাপদ্ধতি, এখানে প্রাপ্ত নিদর্শনগুলোর পরিচিতি ও তার গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি জানান, প্রত্নস্থানে উৎখনন এবং খনন না করে উপরিভাগের পর্যবেক্ষণ—এই দুই ভাবেই প্রত্নস্থান নিয়ে গবেষণা করা হয়। তাঁরা দ্বিতীয় পদ্ধতি অর্থাৎ খনন না করে মাঠ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তাঁদের গবেষণা ও অনুসন্ধান করছেন। প্রায় দুই বছর আগে এই কাজ শুরু করেছেন। এখানে যে মুদ্রা, সিলমোহর, পুঁতি, মূর্তি, মৃৎপাত্র এমন যে আদি ঐতিহাসিক নিদর্শনের সন্ধান পেয়েছেন, তাতে তাঁদের ধারণা, খ্রিষ্টপূর্ব ২০০ সালে এখানে একটি সমৃদ্ধ নগর গড়ে উঠেছিল। এখানে মূর্তি ও পুঁতি তৈরিসহ বিভিন্ন কারুশিল্পের বড় কারখানা ছিল। বরেন্দ্র এলাকার একটি বড় ব্যবসাবাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল এখানে।

শান্ত-মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ও স্থপতি ফারহানা নাজনীন এই প্রাচীন জনপদটির ভূমিবিন্যাসের বিবরণ তুলে ধরেন। তিনি দেখান, এখানে একটি উন্নত মানের পানি ব্যবস্থাপনা, জনপদের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের আবাসন, কৃষি, বাণিজ্য ও কারখানার আলাদা আলাদা স্থান নির্ধারিত ছিল। পরে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, গঙ্গা, মহানন্দা ও পুনর্ভবা নদীর সংযোগস্থলে এই রহনপুর এলাকাটিতে সেই সময় ঠিক কত বড় এলাকা নিয়ে শহরটি গড়ে উঠেছিল তার পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র তৈরি করা সম্ভব হয়নি। এর জন্য আরও বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন হবে। তবে নওগাঁর দিবর দিঘি থেকে খালের মাধ্যমে এই এলাকায় পানির প্রবাহ তৈরি করা হয়েছিল এবং সেই খাল পদ্মায় গিয়ে মিশেছে। এই খালগুলো এখনো টিকে আছে।

গবেষণায় প্রাপ্ত নিদর্শন তুলে ধরা হয় এশিয়াটিক সোসাইটির আয়োজনে। ঢাকা, ১১ মে

রহনপুরের সেই প্রাচীন জনপদের স্থাপনার বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নিয়ামুল হুদা। তিনি বলেন, প্রাচীন জনপদের স্থাপনার ক্ষেত্রে ইউরোপে ব্যক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। উপমহাদেশে প্রাধান্য দেওয়া হয় প্রকৃতির ওপরে। এখানে প্রকৃতি ছিল উপাস্য দেব–দেবী বা তাঁদের সমতুল্য। সে কারণে প্রাচীন গ্রন্থগুলোতে স্থাপনার যে বিবরণ দেওয়া হয়েছে, প্রত্নস্থান অনুসন্ধানের সময়ে সেই বিবরণগুলোর বাস্তবতার প্রমাণ পাওয়া যায়। রহনপুরের ক্ষেত্রেও তা–ই হয়েছে।

আলোচনা পর্বের পরে নিয়ামুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, গত দুই বছর ধরে তাঁরা প্রাথমিক পর্যায়ের অনুসন্ধান করেছেন। ধাপে ধাপে গবেষণা এগিয়ে নিতে হবে। আপাতত উৎখনন–পদ্ধতিতে না গিয়ে পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধানের মাধ্যমেই তাঁরা গবেষণা চালাবেন।

রহনপুরের বাসিন্দা কিশোর মাহির ইয়াসির কৌতূহলের বশে তাদের এলাকায় পুরোনো মৃৎপাত্র, ছোট ছোট মূর্তি, পুঁতি এসব সংগ্রহ করতে থাকে। এই নিদর্শনগুলো পরে এই গবেষক দলের কাছে অতিগুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হয়ে ওঠে। মাহিরও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল। তাকে এশিয়াটিক সোসাইটির পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানানো হয়। তাকে ভবিষ্যতে প্রত্ন–গবেষক হতে উৎসাহিত করা হয়।  

রহনপুরের প্রত্ন–গবেষক দলে আরও ছিলেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মাহমুদুল হাসান খান, সহকারী অধ্যাপক শারমিন রেজওয়ানা ও মুতাসিম বিল্লাহ।

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক হারুন অর রশীদ বলেন, ‘মহাস্থানগড়, পাহাড়পুর, ময়নামতি, উয়ারী–বটেশ্বরের মতো প্রত্নস্থানের সঙ্গে রহনপুরও আমাদের দেশের একটি প্রাচীন নগর হিসেবে যুক্ত হলো। এসব প্রত্নস্থান জাতি হিসেবে আমাদের প্রাচীন সমৃদ্ধি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরে। জাতি হিসেবে আমাদের গৌরবান্বিত করে।’ তিনি বলেন, এশিয়াটিক সোসাইটি বরাবরই এ ধরনের গবেষণা উৎসাহিত করে। এ ক্ষেত্রেও এশিয়াটিক সোসাইটি পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে যাবে।