১৯৭১ সালে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ ডিসেম্বর মাসে দ্রুত পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। বিজয়ের এই মাসে আমরা হাজির করছি তারিখ ধরে ধরে সেই দিনগুলোর ঘটনাধারা। ঈষৎ সংক্ষেপ করে লেখাটি নেওয়া হয়েছে প্রথমা প্রকাশনের প্রকাশিতব্য বই একাত্তরের দিনপঞ্জি: মুক্তিযুদ্ধের দৈনিক ঘটনালিপি থেকে।
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান বিমানবাহিনী বাংলাদেশ সময় বিকেল ৫টা ১৭ মিনিটে ভারতের অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, যোধপুর, আগ্রাসহ সাতটি স্থানে অতর্কিতে একযোগে হামলা চালায়। এরপর রাত ৮টায় জম্মু ও কাশ্মীরে দক্ষিণ-পশ্চিম ছামব ও পুঞ্চ সেক্টরে ব্যাপক স্থল অভিযান শুরু করে। বাংলাদেশের সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী স্থলে ও আকাশে আক্রমণ শুরু করায় ৩ ডিসেম্বর থেকে সর্বাত্মক যুদ্ধের সূচনা হয়।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ভারতে একতরফা আক্রমণের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী এবং মিত্র ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে গড়া যৌথ বাহিনী এই দিন থেকে সীমান্ত অতিক্রম করে সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশে অভিযান শুরু করে। যৌথ বাহিনী বাংলাদেশের পাকিস্তানি অবস্থানগুলো ঘিরে ফেলার জন্য সীমান্তের সাতটি এলাকা দিয়ে তীব্র আক্রমণ পরিচালনা করে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রাতে বেতার ভাষণে বলেন, এই যুদ্ধ বাংলাদেশের এবং একই সঙ্গে ভারতের।
ভারতবাসীকে তিনি দীর্ঘ কৃচ্ছ্রসাধন ও আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। তিনি বলেন, সারা বিশ্বের কাছে তিনি একটি জনগোষ্ঠীর উচ্ছেদ বন্ধ করার সমাধান চেয়েছিলেন। এ জনগোষ্ঠীর একমাত্র অপরাধ ছিল গণতান্ত্রিক উপায়ে ভোটদান। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শান্তি চাই, কিন্তু স্বাধীনতা ছাড়া শান্তি সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ এখন ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ।’
ভারতে বিমান হামলার মাধ্যমে পাকিস্তান আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু করার সময় ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন কলকাতায়। রাতেই দিল্লিতে ফিরে তিনি মন্ত্রিপরিষদের সদস্য এবং তিন বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। এরপর দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দেন।
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের অর্লি বিমানবন্দরে ৩ ডিসেম্বর সকালে জঁ ক্যা নামের এক ফরাসি যুবক পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের একটি যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করেন। ‘সিটি অব কুমিল্লা’ নামের বোয়িং-৭২০ বিমানটি ৩ ডিসেম্বর লন্ডন থেকে যাত্রা করে। প্যারিস, রোম ও কায়রো হয়ে বিমানটির করাচি যাওয়ার কথা ছিল। প্যারিস থেকে এটিতে পাঁচজন যাত্রী ওঠেন। নিরাপত্তাব্যূহ পেরিয়ে তাঁদের সঙ্গে ২৮ বছর বয়সী যুবক জঁ ক্যাও বিমানটিতে উঠে বসেন।
বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে পাইলট বিমান চালু করতেই জঁ ক্যা পিস্তল বের করে তাঁকে ইঞ্জিন বন্ধের নির্দেশ দিয়ে বলেন, নির্দেশ না মানলে বোমা দিয়ে বিমান উড়িয়ে দেওয়া হবে। এরপর তিনি বাংলাদেশের যুদ্ধরত ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং শরণার্থীদের জন্য বিমানটিতে ২০ টন ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী তুলে দেওয়ার জন্য বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন।
বিমানবন্দরে দুটি ওষুধভর্তি গাড়ি হাজির হয়। চারজন পুলিশ গাড়ির স্বেচ্ছাসেবকের পোশাকে বিমানে ঢুকে রাত আটটায় জঁ ক্যাকে আটক করে। ফরাসি লেখক আঁদ্রে মালরোর বক্তব্যে অনুপ্রাণিত জঁ ক্যা মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখার উপায় খুঁজতে গিয়ে জুন মাসে বিমান ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করেছিলেন।
মুজিবনগর, কলকাতা ও দিল্লিতে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে ভারত যেকোনো মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবে এবং একই সঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশ এক মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হবে।
বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বিতাড়নের জন্য ভারত সরকারের কাছে সাহায্য চেয়েছে। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধরসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন।
ভারতের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানের বিমান আক্রমণের খবরে সোভিয়েত ইউনিয়ন গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। এ কারণে সোভিয়েত নেতা ডেনমার্কে চলমান সফর সংক্ষিপ্ত করতে পারেন।
পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডিতে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পুরো ক্ষমতা দাবির শর্তে অসামরিক যৌথ মন্ত্রিসভায় বাঙালি প্রধানমন্ত্রীর অধীনে উপপ্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণে তিনি রাজি আছেন।
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ৪-৫ ডিসেম্বর ১৯৭১; ‘দুঃসাহসী সেই ফরাসি মুক্তিযোদ্ধার সন্ধানে’, ইফতেখার মাহমুদ, প্রথম আলো, ২ জানুয়ারি ২০১৬; আনন্দবাজার পত্রিকা, ভারত, ৪-৫ ডিসেম্বর ১৯৭১