বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী, চাহিদার চেয়ে বাজারে স্যালাইনের সরবরাহ কম

ডেঙ্গু রোগী বাড়তে থাকায় স্যালাইনের চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ কম। ঘাটতি পূরণে দ্রুত পদক্ষেপ জরুরি।

রক্তের তারল্য ঠিক রাখতে ও রক্তচাপ স্থিতিশীল রাখতে ডেঙ্গু রোগীকে স্যালাইন দিতে হয়। রাজধানীতে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে স্যালাইনের চাহিদা। কিন্তু বাজারে চাহিদার তুলনায় নেই সরবরাহ। গতকাল মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে

বাজারে শিরায় দেওয়া স্যালাইনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় স্যালাইনের চাহিদা বেড়েছে, সেই তুলনায় সরবরাহ নেই। সরকারি কর্মকর্তা, চিকিৎসক ও ওষুধের দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে স্যালাইনের এই সংকটের কথা জানা গেছে।

শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিলে, ডায়রিয়া বা কলেরা হলে অথবা কখনো কখনো রক্তচাপ স্থিতিশীল রাখার জন্য শিরায় দেওয়া স্যালাইন ব্যবহারের পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। হঠাৎ ডায়রিয়া বা কলেরা বাড়লে স্যালাইনের চাহিদা কিছুটা বেড়ে যায়। ডেঙ্গু রোগীদেরও নিয়মিত স্যালাইন দিতে হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) হেমাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সালাউদ্দিন শাহ গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তের জলীয় অংশ কমে যায়। এতে রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রক্তচাপ কমে যায়।

রক্তের তারল্য ঠিক রাখতে ও রক্তচাপ স্থিতিশীল রাখতে রোগীকে স্যালাইন দিতে হয়। তিনি বলেন, একজন রোগীকে দিনে এক থেকে দুই লিটার স্যালাইন দিতে হয়, কোনো কোনো রোগীর এর বেশি প্রয়োজন হতে পারে।

আর কয়েক মাসের মধ্যে ইডিসিএলের গোপালগঞ্জ কারখানায় স্যালাইন উৎপাদন শুরু হবে।
এহসানুল কবির, ইডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক

এ বছর এ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ৫৯ হাজারের বেশি ডেঙ্গু রোগী। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, এসব রোগী গড়ে তিন দিন হাসপাতালে থাকছেন। হাসপাতালের বাইরে অনেক রোগী চিকিৎসকের পরামর্শে বাড়িতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাঁদেরও স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। ওষুধ কোম্পানিগুলো এই অবস্থার জন্য প্রস্তুত ছিল না।

প্রধানত শিরায় দেওয়া স্যালাইন চার ধরনের। এর মধ্যে সাধারণ বা নরমাল স্যালাইন ডেঙ্গু চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। কিছু স্যালাইন থাকে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য। অন্য এক ধরনের স্যালাইনকে বলে গ্লুকোজ স্যালাইন। আবার কলেরার চিকিৎসার জন্য ভিন্ন ধরনের স্যালাইন আছে।

উৎপাদন বন্ধ, ইডিসিএল কিনছে

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান একসময় শিরায় দেওয়া স্যালাইন উৎপাদন করত। এই স্যালাইন সরকারি হাসপাতালে ব্যবহৃত হতো। তিন-চার বছর আগে বিকল্প ব্যবস্থা না করেই উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন বলা হয়েছিল, সরকারের একমাত্র ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগ কোম্পানি লিমিডেট (ইডিসিএল) শিরায় দেওয়া স্যালাইন উৎপাদন করবে। গতকাল ইডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অধ্যাপক এহসানুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, আর কয়েক মাসের মধ্যে ইডিসিএলের গোপালগঞ্জ কারখানায় স্যালাইন উৎপাদন শুরু হবে।

সরকারি হাসপাতালে রোগীরা বিনা মূল্যে স্যালাইন পান। বর্তমানে ইডিসিএল বেসরকারি ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে স্যালাইন কিনে সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করে বলে ইডিসিএলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। বেক্সিমকো, স্কয়ার, এক্‌মি, পপুলার, ওরিয়ন, লিব্রা ও অপসোনিন—এই সাতটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ইডিসিএল স্যালাইন কেনে।

‘হাসপাতালের পরিচালক আমাদের বলেছেন, স্যালাইনের কিছু টানাটানি আছে।’
অধ্যাপক সালাউদ্দিন শাহ, বিএসএমএমইউর হোমাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান

ইডিসিএলের মহাব্যবস্থাপক (বিপণন) মোহাম্মদ জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সরকারি হাসপাতালে স্যালাইন সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছি। কিছু ক্ষেত্রে রেশনিং করা হচ্ছে। হাসপাতালগুলোকে বলা হয়েছে, কারও স্যালাইন কম পড়লে তারা যেন নিজের টাকা দিয়ে কিনে নেয়।’

গত বছর ইডিসিএল সরকারি হাসপাতালে ৬০ লাখ স্যালাইন সরবরাহ করেছিল। মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, এ বছর স্যালাইনের সংখ্যা কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে।

রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা ৫০০। গত মাসের কোনো কোনো দিন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি করা হয় ছয় শর বেশি। এ ছাড়া অন্য রোগীও ছিল। হাসপাতালে ওষুধ, স্যালাইন, খাবার—সবকিছুর চাহিদা বেড়ে যায়। তখন গণমাধ্যমে খবর এসেছিল যে রোগীর স্বজনকে হাসপাতালের বাইরের ওষুধের দোকান থেকে স্যালাইন কিনতে দেখা গেছে। গতকাল ওই হাসপাতালের নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালে এখন পর্যাপ্ত স্যালাইন মজুত আছে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের স্যালাইনের যে মজুত আছে, তাতে এক সপ্তাহ চলবে।

এদিকে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইলিয়াস চৌধুরী প্রথম আলোর চট্টগ্রাম প্রতিনিধিকে বলেছেন, ‘বিভিন্ন মাধ্যম থেকে জানতে পেরেছি, স্যালাইন–সংকট চলছে। আমি বিষয়টি জেলা প্রশাসন ও ঔষধ প্রশাসনকে জানিয়েছি। তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। কেউ অসাধু পথে মজুত করছে কি না, তা–ও দেখছে জেলা প্রশাসন।’

হঠাৎ ডেঙ্গু রোগী বাড়েনি। আগেই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। ওষুধ কোম্পানিগুলোকে স্যালাইনের উৎপাদন বাড়াতে হবে।
অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ, সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক জনস্বাস্থ্যবিদ

সরেজমিন

গতকাল বেলা একটায় রাজধানীর কাঁঠালবাগানের এক ওষুধের দোকানি এই প্রতিবেদককে বলেন, দোকানে শিরায় দেওয়া স্যালাইন নেই এক সপ্তাহের বেশি। চারটি ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি ওই দোকানে স্যালাইন দেয়। কিন্তু তাদের সরবরাহ এখন বন্ধ।

বেলা দেড়টা থেকে দুইটার মধ্যে এই প্রতিবেদক রাজধানীর শাহবাগ এলাকার চারটি দোকানে স্যালাইনের সরবরাহ পরিস্থিতি জানার জন্য দোকানিদের সঙ্গে কথা বলেন। একটি দোকানের মালিক বলেছেন, তাঁর দোকানে স্যালাইন নেই। একটি দোকানের মালিক বলেছেন, স্যালাইনের সরবরাহ কম। একটি বড় দোকানের পুরোনো এক কর্মচারী বলেছেন, তাঁদের দোকানে স্যালাইন নেই। সংকট চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। শুধু একটি দোকানের মালিক বলেছেন, তাঁর দোকানে স্যালাইন আছে। স্যালাইন সরবরাহের সংকটে তিনি পড়েননি।

বিএসএমএমইউর এফ ব্লকের দোতলায় ডেঙ্গু রোগীদের জন্য ওয়ার্ড চালু করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। গতকাল দুপুরে ওই ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় শতভাগ রোগীর হাতে স্যালাইন লাগানো। বিএসএমএমইউর হোমাটোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সালাউদ্দিন শাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাসপাতালের পরিচালক আমাদের বলেছেন, স্যালাইনের কিছু টানাটানি আছে।’

রাজধানীর গ্রিন রোডের একটি বেসরকারি হাসপাতালের একজন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেন, বেশ কয়েকজন রোগীর কাছ থেকে জানা যায় যে তাঁরা দোকানে সাধারণ স্যালাইন পাচ্ছেন না। তখন হাসপাতাল থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সাধারণ শিরায় দেওয়া স্যালাইন শুধু ডেঙ্গু রোগীদের দেওয়া হবে। অন্য রোগীরা সাধারণ স্যালাইন পাবেন না।

গতকাল বিকেলে রাজধানীর মিরপুর ১২, মিরপুর ১১, মিরপুর ১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁওয়ের ১১টি ওষুধের দোকানে কোনো স্যালাইন পাওয়া যায়নি।

কেউ জানে না কত দরকার

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর কেউই জানে না বছরে শিরায় দেওয়া স্যালাইনের চাহিদা কত। ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে, ডায়রিয়া বা ডেঙ্গুর মতো ব্যাধির প্রকোপ দেখা দিলে চাহিদা বাড়ে। তবে সঠিক সংখ্যা বলতে পারবেন হাসপাতালের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) হাবিবুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, স্যালাইনের চাহিদা কত, তা ওষুধ কোম্পানি বা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর জানতে পারে।

গতকাল একাধিক ওষুধ কোম্পানি বলেছে, তারা উৎপাদন ঠিক রেখেছে। তা হলে স্যালাইনের সংকট কেন হচ্ছে—এমন প্রশ্নের উত্তরে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মো. সালাহউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্যালাইনের কোনো সংকট নেই, ডেঙ্গুর কারণে স্যালাইনের চাহিদা বেড়েছে। আমরা গত সপ্তাহে ওষুধ কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সভা করে বলেছি, তারা যেন উৎপাদন অব্যাহত রাখে, বেশি উৎপাদনের উদ্যোগ নেয়। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সহায়তা সরকার তাদের করবে।’

একাধিক চিকিৎসক ও ওষুধের দোকানি বলেছেন, সরকার দ্রুত বড় ধরনের উদ্যোগ না নিলে পরিস্থিতি খারাপ হওয়ার ঝুঁকি আছে।

এ ব্যাপারে সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, হঠাৎ ডেঙ্গু রোগী বাড়েনি। আগেই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। ওষুধ কোম্পানিগুলোকে স্যালাইনের উৎপাদন বাড়াতে হবে। কোনো কারণে হাসপাতালে স্যালাইনের সংকট দেখা দিলে রোগী ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে পড়বে, ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়বে।