‘চকবাজার শাহি জামে মসজিদ’। শায়েস্তা খানের করা সব মসজিদই তিন গম্বুজের, এটিও তাই। এই মসজিদ প্রায় ৩৪৭ বছর আগে নির্মিত হয়
‘চকবাজার শাহি জামে মসজিদ’।  শায়েস্তা খানের করা সব মসজিদই তিন গম্বুজের, এটিও তাই। এই মসজিদ প্রায় ৩৪৭ বছর আগে নির্মিত হয়

২১০ ফুট উঁচু মিনারের মসজিদটি ৩৪৭ বছর আগের

রাজধানীর চকবাজারের মসজিদটির নাম ‘চকবাজার শাহি জামে মসজিদ’। এর প্রতিষ্ঠাতা নবাব শায়েস্তা খান। মসজিদের শিলালিপি অনুযায়ী নির্মাণকাল ১০৮৬ হিজরিতে

চকবাজার মসজিদের চেয়ে এখন তার সামনের ইফতারির বাজারের খ্যাতি ও পরিচিতি ঢের বেশি। বলা যায়, দেশজোড়া এর সুনাম। প্রতিবছর রমজান মাসের শুরু থেকেই বেলা গড়ানোর পর চকবাজার মোড় থেকে মসজিদের সামনের পুরো রাস্তা যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দিয়ে বসে যায় হরেক রকমের ইফতারির পসরা।

এই ইফতারির পসরায় আস্ত ছাগল, মুরগি, কবুতর, কোয়েল পাখির কাবাব-রোস্ট থেকে শুরু করে মুড়ি–ছোলার ঘুগনি অবধি, ঝাল–মিষ্টি–অম্বলের চর্ব্য, চূষ্য, লেহ্য, পেয়, ঠান্ডা, গরম শতেক পদের খাদ্যের বিচিত্র সমাহার। সেসব কিনতে রোজাদারেরা ভিড় জমান। আর কেনাকাটার ছবি ও সংবাদ সংগ্রহের জন্য গণমাধ্যমকর্মীদের সমাগমও কম না। বহু বছর ধরে ফলাও করে প্রচারের কল্যাণে চকের ইফতারি খ্যাতির মধ্যগগনে। তবে এসব মিলিয়েই এখন চকবাজারের শাহি মসজিদ।

ইফতারির তুলনায় চকের মসজিদের পরিচিতি অনেকটাই কম। এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ঢাকার সুবাদার নবাব শায়েস্তা খান। ঢাকায় শায়েস্তা খান তাঁর সুবাদারিরকালে বেশ কয়েকটি মসজিদ ও স্থাপনা নির্মাণ করেছিলেন। এর মধ্যে এখন মিটফোর্ড হাসপাতালের জরুরি বিভাগের পেছনে তিন গম্বুজ মসজিদটি তাঁর নামানুসারে ‘শায়েস্তা খান মসজিদ’ নামে টিকে আছে। অন্য কোথাও তাঁর নাম নেই। চকবাজারের মসজিদের পরিচিতি এখন ‘চকবাজার শাহি জামে মসজিদ’ নামে।

আ ক ম যাকারিয়া ‘বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ বইতে লিখেছেন, বর্তমানকালে মসজিদে এত সংস্কারসাধন করা হয়েছে যে এর আদি রূপ সম্পর্কে কোনো ধারণা করাই কঠিন

বয়স হলো ৩৪৭ বছর

চকবাজার মসজিদের উৎকীর্ণ শিলালিপিটি অক্ষুণ্ন রয়েছে। সে অনুসারে মসজিদটির নির্মাণকাল ১০৮৬ হিজরি। এই শিলালিপির হুবহু অনুবাদ করেছেন মুনশী রহমান আলী তায়েশ তাঁর তাওয়ারিখে ঢাকা বইতে। অনুবাদটি এ রকম, ‘আল্লাহর পথের অনুসারী আমির-উল-উমারা শায়েস্তা খান আল্লাহর জন্য আন্তরিকতার সাথে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। অনুসন্ধানকারী প্রজ্ঞা থাকে যখনই নির্মাণের তারিখ অনুসন্ধান করল, আমি বললাম, আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহে ফরজ আদায় হলো। ১০৮৬ হিজরি।’ খ্রিষ্টীয় সাল ১৬৭৬। সে হিসাবে চকবাজার মসজিদের বয়স হলো এখন প্রায় ৩৪৭ বছর।

স্থাপত্যরীতি

শায়েস্তা খানের করা সব মসজিদই তিন গম্বুজের। চকবাজারেরটিও তাই। এই মসজিদের গম্বুজগুলো বিশাল আকারের। মাঝেরটি বড়। পাশের দুটি একটু ছোট। গম্বুজগুলো অষ্টকোণ ভিত্তির ওপরে তৈরি। উত্তর পাশে রয়েছে চারটি বুরুজ যুক্ত ৭০ ফুট লম্বা মিনার। এখন গম্বুজ আর পুরোনো মিনারে ‘চিনি টিকরি’রীতিতে সাদা চীনামাটির ফলকের টুকরা কাজ করা। ফলে মিনার গম্বুজ টিকে থাকলেও আদি অলংকরণ নেই। অদূরের চুড়িহাট্টা মসজিদের মতো সংস্কারের সময় পুরো ধ্বংস করে ফেলা হয়নি।

মূল পুরোনো মসজিদের আয়তন ছিল আড়াই হাজার বর্গফুট। প্রথম দফায় এর সংস্কার ও পরিবর্ধন করে সাড়ে ছয় হাজার বর্গফুট করা হয়। চকবাজার শাহি মসজিদের নতুন ভবন তৈরির কাজ শুরু হয়েছে ২০১৪ সালে

পুরোনো মসজিদটির বিবরণ ঐতিহাসিকেরা দিয়েছেন। বর্ণনা অনুসারে এই মসজিদটি ছিল ১০ ফুটের উঁচু একটি বেদির ওপর নির্মিত। বেদিসহ আয়তন দৈর্ঘ্য ৯৪ ফুট ও প্রস্থ ৮০ ফুট। মূল মসজিদের আয়তন ৫০ ফুট ও প্রস্থ ২৬ ফুট।

আহমদ হাসান দানী তাঁর ‘কালের সাক্ষী ঢাকা’ বইতে লিখেছেন, ‘মসজিদের পূর্ব দিকের বাইরের অংশটি ছিল প্যানেল দ্বারা সুসজ্জিত। মূল প্রবেশ পথের সম্মুখভাগ ছিল সুন্দর ও দর্শনীয়। মসজিদের কোনার মিনার এবং আজান দেওয়ার মিনার সার্বিক সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তোলে।’ তবে পুরোনো মসজিদটিকে এখন আলাদা করে চেনা কঠিন। আর গম্বুজগুলোও ছাদে না উঠলে দেখার উপায় নেই। অন্তত তিন দফা বড় রকমে সংস্কার ও সম্প্রসারণে চকবাজার মসজিটির আকার আয়তন এমনভাবে বেড়েছে যে ভেতরে এলে অনেকটা গোলকধাঁধার মতো মনে হয়। আ ক ম যাকারিয়া ‘বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ’ বইতে লিখেছেন, ‘বর্তমানকালে মসজিদে এত সংস্কারসাধন করা হয়েছে যে এর আদি রূপ সম্পর্কে কোনো ধারণা করাই কঠিন।’

এখন কেমন

চকবাজার মসজিদে এখন নতুন পুরোনো ভবন মিলিয়ে প্রায় আট হাজারের মতো মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন। তবে গতকাল শুক্রবার পবিত্র রমজান মাসের দ্বিতীয় জুমায় মসজিদে উপচে পড়া উপস্থিতি ছিল মুসল্লিদের। এখানে গত ২৮ বছর ধরে মোয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করছেন এবং গত বছর পর্যন্ত তারাবিহর জামাতে ইমামতি করেছেন হাফেজ মো. তাজুল ইসলাম। তিনি জানালেন, গতকাল নতুন-পুরোনো মসজিদের ভেতর, ছাদ, বারান্দা, সিঁড়ি, সামনের রাস্তা মিলিয়ে প্রায় দশ হাজার মুসল্লি জামাতে অংশ নিয়েছেন।

পুরোনো মসজিদটির বিবরণ ঐতিহাসিকেরা দিয়েছেন। বর্ণনা অনুসারে, এই মসজিদটি ছিল ১০ ফুটের উঁচু একটি বেদির ওপর নির্মিত। বেদিসহ আয়তন—দৈর্ঘ্য ৯৪ ফুট ও প্রস্থ ৮০ ফুট। মূল মসজিদের আয়তন ৫০ ফুট ও প্রস্থ ২৬ ফুট

চকবাজার শাহি মসজিদের পরস্পর সংযুক্ত দুটি অংশ রয়েছে। পুরোনো মসজিদের অংশটি সংস্কার করে তিনতলা করা হয়েছিল। পরে এর পেছনে অর্থাৎ পশ্চিম দিকে সাড় ১৪ কাঠা জায়াগার নতুন আটতলা ভবন করা হয়েছে। মোয়াজ্জিন জানালেন, নতুন ভবনের প্রথম থেকে তিনতলা পর্যন্ত মার্কেট এবং চতুর্থ থেকে মসজিদ এবং ওপরে অফিস ইত্যাদি। নতুন ভবনের সম্প্রসারণ উপলক্ষে প্রকাশিত স্মরণিকা থকে জানা গেল, মূল পুরোনো মসজিদের আয়তন ছিল আড়াই হাজার বর্গফুট।

এবার রমজানের প্রথম দিনেই চকবাজারের ইফতার বাজারে ছিল ক্রেতাদের ভিড়। ২৪ মার্চ, ঢাকা

পাকিস্তান আমলে প্রথম দফায় এর সংস্কার ও পরিবর্ধন করে সাড়ে ছয় হাজার বর্গফুট করা হয়।
চকবাজার শাহি মসজিদের নতুন ভবন তৈরির কাজ শুরু হয়েছে ২০১৪ সালে। মসজিদের পশ্চিম পাশে পাড়া সাড়ে ১৪ কাঠা জায়গা পতিত ছিল। সেখানেই স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের দানে আটতলা ভবন নির্মাণ শুরু হয়। এখন পর্যন্ত এর ছয়তলা পর্যন্ত নির্মিত হয়েছে। নির্মাণ ও অলংকরণের কাজ এখনো চলছে।

মসজিদের অফিস সূত্রে জানা গেল, এখন ইমাম, মোয়াজ্জিন, খাদেমসহ মসজিদের লোকবল ২৫ জন। পুরো মসজিদটি সিসি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রিত। নতুন ভবনটির দুটি ভূগর্ভস্থ তলাসহ মোট আটতলা। এর তিনটি তলায় রয়েছে মার্কেট এবং বাকি অংশে মসজিদ। প্রবেশপথ পাঁচটি। লিফট আছে দুটি। প্রতিটি পাঁচ টনের এসি আছে ২৯টি। নিজস্ব দুটি জেনারেটর আর ১০০০ কিলোওয়াটের সাবস্টেশন রয়েছে। পুরোনো মসজিদের নিচের তলার দক্ষিণ পাশে রয়েছে হজরত মাওলানা শাহ হাফেজ আহমদ সিদ্দিকী জৈনপুরী (রহ.)–এর মাজার। চকবাজার শাহি মসজিদের নিচের তলার মার্কেট ছাড়াও পোস্তা এলাকায় পাঁচ কাঠা জমি রয়েছে। এর আয় এবং দাতাদের সহায়তায় অর্থেই চলে সুবিশাল এই মসজিদ।

এখন রমজান মাসে চকবাজারের সুস্বাদু ইফতারির ঘ্রাণ পড়ন্ত বিকেলের হাওয়ায় ভেসে যায় চকের সরু অলিগলিময় জমজমাট বাণিজ্যিক এলাকায়। আর সন্ধ্যায় মসজিদের ২১০ ফুট উঁচু নতুন মিনার থেকে যখন ছড়িয়ে পড়ে মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি, তখন রোজাদারেরা পরম করুণাময় আল্লাহর অনুগ্রহ কামনা করে ইফতারি শুরু করেন প্রিয়জনদের সঙ্গে।