হাইকোর্ট
হাইকোর্ট

পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী কাঠামো প্রবর্তন

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে কর্তৃত্ববাদী কাঠামো প্রবর্তন করা হয়। ফলে অটো পাস, মিডনাইট ভোট ও ডামি নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচন কেড়ে নেওয়া হয়, ভোট কেড়ে নেওয়া হয়। সার্বিকভাবে নির্বাচনপ্রক্রিয়া ধ্বংস করা হয়েছে। অথচ জনগণ সব ক্ষমতার মালিক এবং অবাধ–সুষ্ঠু নির্বাচন সংবিধানের মৌলিক কাঠামো।

পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এই কাঠামো ধ্বংস করা হয়েছে। বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপসহ বেশ কিছু বিষয়ে আনা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী প্রশ্নে রুল শুনানিতে রিট আবেদনকারীদের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া এসব কথা বলেন।

বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ বুধবার দ্বিতীয় দিনের মতো শুনানি গ্রহণ করেন। শুনানি নিয়ে আদালত আগামীকাল বৃহস্পতিবার শুনানির পরবর্তী দিন রেখেছেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১১ সালে সংবিধানের ওই সংশোধনী আনা হয়। পঞ্চদশ সংশোধনী আইন ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পাস হয়। ২০১১ সালের ৩ জুলাই এ-সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয়। পঞ্চদশ সংশোধনী আইন চ্যালেঞ্জ করে গত ১৮ আগস্ট সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি রিটটি করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট গত ১৯ আগস্ট রুল দেন। রুলে পঞ্চদশ সংশোধনী আইন কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। গত ৩০ অক্টোবর রিট আবেদনকারীদের আইনজীবীর বক্তব্য উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে রুলের ওপর শুনানি শুরু হয়। সেদিন শুনানি নিয়ে আদালত ৬ নভেম্বর দিন রাখেন।

ইতিমধ্যে রুলে ইন্টারভেনার (আদালতকে সহায়তা করতে) হিসেবে বিএনপি, গণফোরাম, জামায়াতে ইসলামী ও আইনজীবী মোস্তফা আসগর শরিফী প্রমুখ যুক্ত হয়েছেন।

আগের ধারাবাহিকতায় আজ বেলা পৌনে ১১টা থেকে মাঝে এক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে বিকেল চারটা পর্যন্ত শুনানি হয়। আদালতে রিট আবেদনকারীদের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরীফ ভূইয়া শুনানি করেন। তাঁকে সহায়তা করেন আইনজীবী রিদুয়ানুল করিম।

বিভিন্ন নজির তুলে ধরে শরীফ ভূইয়া বলেন, শর্টকাট প্রক্রিয়ায় পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়, যা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংশোধনী। এ ক্ষেত্রে জনগণের মতামত নেওয়া হয়নি। জাতীয় সংসদের বিশেষ কমিটি গঠন করা হলেও তাঁদের মতামত বাইরে গিয়ে ওই সংশোধনী আনা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে কমিটি নির্বাচনের সুপারিশ নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি তা বাদ দিয়ে দেন। ফলে দলীয় সরকারের অধীন ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে নির্বাচন হয়, যা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

সব রাজনৈতিক দল ও জনমতের ভিত্তিতে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু হয়েছিল বলে উল্লেখ করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরীফ ভূইয়া। তিনি বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্ববধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়। আপিল বিভাগের (ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত) সংক্ষিপ্ত আদেশে দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনের কথা বলা হয়। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়। যখন সংশোধনী আনা হয়, তখন সংক্ষিপ্ত আদেশ বহাল ছিল। দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা রাখার বিষয়ে আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশ লঙ্ঘন করেই সংসদ পঞ্চদশ সংশোধনী আনে। এই সংশোধন প্রক্রিয়াও যথাযথ হয়নি।

‘সংশোধনের পুরো প্রক্রিয়াই দুর্নীতিগ্রস্ত’

সব রাজনৈতিক দল ও জনমতের ভিত্তিতে ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু হয়েছিল উল্লেখ করে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরীফ ভূইয়া বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়। আপিল বিভাগের (ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত) সংক্ষিপ্ত আদেশে দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনের কথা বলা হয়। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়। যখন সংশোধনী আনা হয়, তখন সংক্ষিপ্ত আদেশ বহাল ছিল। দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা রাখার বিষয়ে আপিল বিভাগের সংক্ষিপ্ত আদেশ লঙ্ঘন করেই জাতীয় সংসদ পঞ্চদশ সংশোধনী আনে। এই সংশোধন প্রক্রিয়াও যথাযথ হয়নি। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে অনুসারে, সংশোধনীর জন্য আনা কোনো বিলের সম্পূর্ণ শিরোনামায় এই সংবিধানের কোন বিধান সংশোধন করা হবে, তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর বিলের ক্ষেত্রে কতিপয় বিধানের কথা বলা হলেও সুনির্দিষ্টভাবে বিধানগুলো উল্লেখ করা হয়নি। এমনকি সম্পূর্ণ শিরোনামা অনুপস্থিত। অথচ সম্পূর্ণ শিরোনামা ও কোন বিধান সংশোধন করা হবে, তা স্পষ্ট উল্লেখ করা না থাকলে বিলটি বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা যাবে না ওই অনুচ্ছেদেই বলা আছে। সংশোধনের পুরো প্রক্রিয়াই দুর্নীতিগ্রস্ত, যে কারণে পঞ্চদশ সংশোধনী অসাংবিধানিক ঘোষণার যোগ্য।

‘পাইকারিভাবে পুনর্লিখন করা হয়েছে’

পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান পাইকারিভাবে পুনর্লিখন করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরীফ ভূইয়া। শুনানিতে তিনি বলেন, এই সংশোধনী আইনে ৫৫টি ধারা আছে। এর ৫৪টি ধারাই সংশোধনীর উদ্দেশ্যে। প্রায় ৭০টি স্থানে সংশোধনী আনা হয়েছে। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ অনুসারে প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ। জনগণ সার্বভৌম, যা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো—অষ্টম সংশোধনী মামলার রায়েও বলা হয়েছে। অথচ পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জনগণকে ক্ষমতাহীন করা হয়েছে।  

পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিদ্যমান সংবিধানের ৭(ক) অনুচ্ছেদে সংবিধান বাতিল, স্থগিতকরণ ইত্যাদি অপরাধ বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। অনুচ্ছেদটির বিভিন্ন দিক তুলে ধরে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরীফ ভূইয়া বলেন, এখানে অসাংবিধানিক পন্থা ও উদ্যোগ গ্রহণ বা ষড়যন্ত্র করলে বলা রয়েছে, যা অস্পষ্ট। দোষী ব্যক্তি প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ডে দণ্ডিত হবেন বলা হয়েছে। অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড। এখানে পরিষ্কার করে বলা হয়নি। এমনকি কোন আদালতে বিচার হবে, তা বলা হয়নি। মধ্যরাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দরজা নক করার মতো, ভয় প্রতিষ্ঠা করার জন্যই এ ধরনের অস্পষ্ট বিধান যুক্ত করা হয়। যা সংবিধানের মৌলিক অধিকারসহ মৌলিক কাঠামোকে আঘাত করে।  

পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিদ্যমান সংবিধানের বিদ্যমান ৭(খ) অনুচ্ছেদে সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য বিষয়ে বলা রয়েছে। এই অনুচ্ছেদ সম্পর্কে শুনানিতে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শরীফ ভূইয়া বলেন, ৭(খ) মাধ্যমে এক–তৃতীয়াংশের বেশি অংশকে সংশোধন–অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে জনগণর কাছ থেকে রাষ্ট্রের মালিকানা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। অনুচ্ছেদটির মাধ্যমে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা এবং জাতীয় সংসদের মাধ্যমে সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগ করে সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধনের ক্ষমতা ধ্বংস করা হয়েছে। আজ দ্বিতীয় দিনে প্রায় চার ঘণ্টা শুনানির মধ্য দিয়ে আপাতত বক্তব্য উপস্থাপন শেষ করেন রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী।

আদালতে বিএনপির পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও আইনজীবী ফারজানা শারমিন, জামায়াতের পক্ষে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির ও আইনজীবী মোস্তফা আসগর শরিফী উপস্থিত ছিলেন। অন্যতম রিট আবেদনকারী বদিউল আলম মজুমদার শুনানির সময় উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তানিম খান, আবদুল্লাহ আল মাহমুদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপের পাশাপাশি জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত নারী আসন ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়। অসাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকে রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে দোষী করে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধানও যুক্ত করা হয়। আগে মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনে নির্বাচন করার বিধান থাকলেও ওই সংশোধনীতে পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিষয়টি সংযোজন করা হয়।