কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনায় জড়িত অভিযোগে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের হাজির করা হয় ঢাকার সিএমএম আদালতে। পরে তাঁদের প্রিজন ভ্যানে করে কারাগারে নেওয়া হয়। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে সিএমএম কোর্ট প্রাঙ্গণে
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ ও সহিংসতার ঘটনায় জড়িত অভিযোগে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের হাজির করা হয় ঢাকার সিএমএম আদালতে। পরে তাঁদের প্রিজন ভ্যানে করে কারাগারে নেওয়া হয়। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে সিএমএম কোর্ট প্রাঙ্গণে

‘আমি আমার ছেলের সঙ্গে কথা বলতে চাই’

ঢাকার উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল্লাহ আল জুবায়ের পরিবারের সঙ্গে থাকেন টঙ্গীতে। চার দিন আগে ২৯ জুলাই দুপুর ১২টার সময় বাসা থেকে বের হন তিনি। বিকেলে জুবায়েরের এক বন্ধু ফোন করে তাঁর মাকে জানান, উত্তরা থেকে জুবায়েরকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। খবর পাওয়ার পর বিকেল চারটায় জুবায়েরের মা ফাতেমাতুজ জোহরাকে নিয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় যান তাঁর বাবা আজিজুল ইসলাম। থানা হেফাজতে জুবায়েরকে অসুস্থ অবস্থায় দেখতে পেয়ে ঘাবড়ে যান তাঁরা। এরপর স্বামী-স্ত্রী দুজন রাত চারটা পর্যন্ত থানার সামনে অপেক্ষা করেন। তবে জুবায়েরকে ছাড়াতে না পেরে দুজনে বাসায় চলে যান।

পরদিন ৩০ জুলাই আবার সকাল ১০টায় ঢাকার আদালত চত্বরে হাজির হন জুবায়েরের মা–বাবা। দুপুর ১২টার পর প্রিজন ভ্যানে করে যখন জুবায়েরকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে নেওয়া হচ্ছিল, তখন প্রিজন ভ্যানের ভেতরে একনজর ছেলেকে দেখতে পান মা–বাবা। এরপর জুবায়েরকে দেখার জন্য আদালতের হাজতখানার সামনে অপেক্ষা করতে থাকেন তাঁরা। পরে বিকেলে প্রিজন ভ্যানে করে জুবায়েরকে নিয়ে যাওয়া হয় কেরানীগঞ্জে অবস্থিত কেন্দ্রীয় কারাগারে। ছেলে কারাগারে যাওয়ার পর মা ফাতেমাতুজ জোহরার চোখে ঘুম নেই। তিনি বারবার স্বামীর কাছে জানতে চাচ্ছেন, কবে তাঁর ছেলে জুবায়ের কারাগার থেকে ছাড়া পাবে?

জুবায়েরের সঙ্গে দেখা করার জন্য টঙ্গী থেকে আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে যান মা–বাবা। কিন্তু কারা ফটকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কারা কর্মকর্তার মাধ্যমে জানতে পারেন, কারাবন্দীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ বন্ধ। ছেলেকে দেখতে না পেয়ে দুপুর ১২টার দিকে আবার আসেন ঢাকার সিএমএম আদালতে।

জুবায়েরের বাবা আজিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলে কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন। তাঁর জানামতে, তাঁর ছেলে কোনো সহিংস কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও জড়িত নন। তবু তাঁকে নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। জুবায়েরের আইনজীবী এস এম তাসমিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মামলার এজাহারে জুবায়েরের নাম ছিল না। সন্দেহের ভিত্তিতে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সিএমএম আদালতে তাঁর জামিন আবেদন নাকচ হয়েছে।

জামিন না হওয়ায় জুবায়েরের লেখাপড়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন মা ফাতেমাতুজ জোহরা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, স্বামী ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকেন। এ কারণে তিনি ছোটবেলা থেকেই জুবায়েরের লেখাপড়ার খোঁজখবর রাখেন। সেই ছেলে নাশকতার মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।

মোবাইলে কারাবন্দী ছেলে আবদুল্লাহ আল জুবায়েরের ছবি দেখাচ্ছেন মা ফাতেমাতুজ জোহরা। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ঢাকার আদালত চত্বরে

জুবায়ের যে মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাতে অভিযোগে বলা হয়, গত ১৯ জুলাই উত্তরার ১২ নম্বর সেক্টরের কদম চত্বরে উচ্ছৃঙ্খল ছাত্র–জনতা পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। পরে উচ্ছৃঙ্খল ছাত্র–জনতা সেখানে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায় এবং ট্রাফিক বক্সে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে গত ১৯ জুলাই বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করে। সেই মামলায় উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জুবায়েরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উত্তরা পশ্চিম থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো. মাঈন উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, সেদিনকার নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জুবায়েরের সংশ্লিষ্টতা ছিল বলেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

জুবায়েরের আইনজীবী এস এম তাসমিরুল ইসলাম বলেন, জুবায়েরের জামিন চেয়ে ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতে আবেদন করা হবে। জুবায়েরের মা বলেন, তাঁরা মামলা-মোকদ্দমার বিষয়ে কিছুই জানেন না। কিন্তু ছেলে এখন মামলার আসামি। তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন থানা-আদালতে ঘুরে দেখলাম, আমার ছেলের মতো আরও অনেক ছাত্র গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছে। আমরা আমাদের সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে পারছি না। আমি আমার ছেলের সঙ্গে কথা বলতে চাই।’

কেবল জুবায়েরের মা-বাবা নন, ১০ দিন ধরে কোনো কারাবন্দীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারছেন না তাঁদের অভিভাবকেরা। বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েক অভিভাবক প্রথম আলোর কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক সুভাষ কুমার ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, চলমান সহিংস পরিস্থিতির কারণে ১০ থেকে ১২ দিন ধরে কারাবন্দীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ বন্ধ রয়েছে। সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশ পাওয়ার পর আবার বন্দীরা তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ পাবেন।

তবে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপারসন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না প্রথম আলোকে বলেন, সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না বা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না বা কারও সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না। গ্রেপ্তার কারাবন্দীদের স্বজনেরা যদি সাক্ষাৎ না করতে পারেন কিংবা কারাবন্দী যদি আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ না করতে পারেন, সেটি হওয়া উচিত নয়। অবিলম্বে কারাবন্দীদের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়ার দাবি জানান তিনি।