সন্দেহের তালিকায় একটি মন্ত্রণালয়সহ কিছু প্রতিষ্ঠান

কয়েক দিন ধরে স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল একটি টেলিগ্রাম চ্যানেলে।
প্রতীকী ছবি

নাগরিকদের স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) তথ্য বেহাত হওয়ার ঘটনায় দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সাংবিধানিক সংস্থাটি বলছে, তাদের তথ্যভান্ডার ‘হ্যাকড’ হয়নি। তবে তাদের কাছ থেকে এনআইডির তথ্য যাচাই–সংক্রান্ত সেবা নেয়, এমন এক বা একাধিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে তথ্য ফাঁস হয়ে থাকতে পারে। সন্দেহের তালিকায় থাকা সরকারের একটি মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে এনআইডির তথ্য যাচাইয়ের সেবা দেওয়া আপাতত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

কয়েক দিন ধরে স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল একটি টেলিগ্রাম চ্যানেলে। সেখানে এনআইডি নম্বর ও জন্মতারিখ দিলেই বেরিয়ে আসছিল মানুষের ব্যক্তিগত সব তথ্য। অবশ্য আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ওই চ্যানেলে এসব তথ্য আর পাওয়া যাচ্ছে না। উল্লেখ্য, টেলিগ্রাম ইন্টারনেটভিত্তিক একটি যোগাযোগমাধ্যম।

ইসির সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, সরকারের একটি মন্ত্রণালয় থেকেই তথ্য ফাঁসের ঘটনাটি ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তারা ইসির কাছ তথ্য যাচাই–সংক্রান্ত সেবা নিয়ে থাকে। ইতিমধ্যে তাদের এই সেবা সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিষয়টি তদন্ত করতে ওই মন্ত্রণালয়কে ইসি থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা যদি কারিগরি দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে না পারে এবং গোয়েন্দা ছাড়পত্র না পায়, তাহলে তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হতে পারে।

ব্যক্তিগত তথ্য বলতে সেসব তথ্যকে বোঝায়, যা দিয়ে মানুষকে শনাক্ত করা যায়। এ ধরনের তথ্য ব্যবহার করা হয় পরিচয় চুরির কাজে। একজনের ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে ভুয়া পরিচয় তৈরি করে প্রতারণা হতে পারে। ব্যক্তিগত তথ্য বেহাতের কারণে অপরাধের শিকার হতে পারেন সাধারণ মানুষ।

এর আগেও দেশে একাধিকবার ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস বা বেহাতের ঘটনা ঘটেছিল। গত জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনলাইন সংবাদমাধ্যম টেকক্রাঞ্চ বাংলাদেশের ‘লাখ লাখ’ মানুষের তথ্য ফাঁসের ঘটনা সামনে আনে।

তখন জানা যায়, রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কর্তৃপক্ষ থেকে তথ্য ফাঁস হয়। রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় এনআইডির তথ্য যাচাই-সংক্রান্ত সেবা নিত।

তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ তখন বলেছিলেন, সরকারি ওই ওয়েবসাইটে ন্যূনতম নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল না। এ ছাড়া গত সেপ্টেম্বর মাসে একটি শিক্ষা বোর্ডের ওয়েবসাইট থেকে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য ও নথি ফাঁসের ঘটনা ঘটে।

সর্বশেষ তথ্য বেহাত হওয়ার ঘটনায় ইসির জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক এ কে এম হুমায়ূন কবীর বৃহস্পতিবার বিকেলে সাংবাদিকদের জানান, গতকাল বুধবার রাত একটার দিকে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সেবা দেওয়া বন্ধ করা হয়। সকালেও কিছু সময় তথ্য পাওয়া গেছে, সেটা বোতলে যেমন পানি থাকে, ওই রকম। কতটি প্রতিষ্ঠান সন্দেহের মধ্যে রয়েছে, তা এখন বলা যাবে না। তবে ইসির কাছ থেকে সেবা নিচ্ছে, এমন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এর মধ্যে আছে।

মুঠোফোন নম্বরসহ ব্যক্তিগত প্রায় সব তথ্য টেলিগ্রামে পাওয়া যাচ্ছে, এটি কীভাবে সম্ভব—এমন প্রশ্নের জবাবে হুমায়ুন কবীর বলেন, ইন্টারনেটের যুগে সবকিছু সম্ভব। নানাজনের কাছে নানা তথ্য আছে। এসব জায়গা থেকে তথ্য নিয়ে এগুলো করা হতে পারে। মোবাইল কোম্পানি হয়তো নম্বর দিয়ে দিচ্ছে। মোবাইল অপারেটররাও জড়িত থাকতে পারে। তিনি বলেন, এই চক্র বের করার চেষ্টা চলছে। এ জন্য দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

তাহলে কি একেক প্রতিষ্ঠান থেকে একেক ধরনের তথ্য নিয়ে তা ফাঁস করা হচ্ছে—এমন প্রশ্নের জবাবে এনআইডির মহাপরিচালক এ কে এম হুমায়ূন কবীর বলেন, ‘আমি তো বলতে পারি না। তদন্ত করে দেখি। সন্দেহভাজনদের সেবা বন্ধ করা হয়েছে।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে হুমায়ূন কবীর জানান, ইসির কাছ থেকে যেসব প্রতিষ্ঠান সেবা নেয়, তাদের সবাই সব তথ্য পায় না। পুলিশ ১০-১২টা তথ্য পায়। ব্যাংকগুলোর কাছে ব্যক্তির নাম, পিতার নাম ও ঠিকানা আছে।

এনআইডির মহাপরিচালক বলেন, চুক্তি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবা ইসি পুরোপুরি বন্ধ করতে পারছে না। তদন্তে যে দোষী হবে, তাকে আইনের হাতে তুলে দেওয়া হবে। যারা সফটওয়্যার রক্ষণাবেক্ষণ করে, তাদের মাধ্যমে এটি হয়ে থাকলে তাদের কালো তালিকাভুক্ত করার সুপারিশ করা হবে, যেন দেশের কোথাও তারা কাজ না পায়। কারণ, তারা মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে।

সরকারের কোনো মন্ত্রণালয় থেকে এই তথ্য ফাঁস হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে হুমায়ূন কবীর বলেন, ‘আমরা তদন্ত করে দেখি। তারপর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর সবাইকে সব তথ্য শেয়ার করা হয় না।’

নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা থাকছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে এনআইডির মহাপরিচালক বলেন, ‘প্রাইভেসি (গোপনীয়তা) কোথায় আছে? এই পাবলিক সার্ভিস কমিশনে (সরকারি কর্ম কমিশন) আবেদন করেন, তখন প্রাইভেসি থাকে নাকি? যখন নিকাহ নিবন্ধন করেন, তখন কি প্রাইভেসি থাকে? তারপর ব্যাংকে, পাসপোর্টে ইয়ে দিচ্ছেন, তখন কি দেখে না ওরা! প্রাইভেসি বলতে পৃথিবীতে টেকনোলজির যুগে কিছু থাকে না। টেকনোলজির যুগে আপনার প্রাইভেসি, আপনার তথ্য—সবকিছু ইয়ে হয়ে যায়।’

তাহলে মানুষের প্রাইভেসি (ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা) বলতে কিছু থাকবে না? এমন প্রশ্নের জবাবে অবশ্য হুমায়ুন কবীর বলেন, প্রাইভেসি নেই, এ কথা তিনি বলেননি। ইসি কারও তথ্য ফাঁস করেনি।