মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র শাহজাদা আজম বাংলার সুবাদার হয়ে আসেন ১৬৭৮ সালে। তিনি ঢাকায় নির্মাণ করলেন ‘কিল্লা আওরঙ্গবাদ’, যা ‘লালবাগ কেল্লা’ নামে পরিচিত। কেল্লার ভেতরে ‘লালবাগ মসজিদ’ তিনিই নির্মাণ করেন
যার–তার মসজিদ নয়। শাহজাদার মসজিদ। যেনতেন প্রকারের শাহজাদা তিনি নন, ভারত সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র মোহাম্মদ আজম, মসজিদটি তৈরি করেছিলেন তিনি। প্রায় ৩৫০ বছরের পুরোনো এই শাহজাদার মসজিদে এখন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন আমজনতা। প্রতিবছরের মতো এবারেও খতম তারাবিহর জামাত হচ্ছে। প্রায় দেড় হাজার মুসল্লি তারাবিহর জামাতে অংশ নিচ্ছেন। মসজিদটি ‘লালবাগ মসজিদ’ নামে পরিচিত।
মোগল যুগের ঢাকার বিখ্যাত স্থাপনা— যাকে ঢাকার ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রতীকও বলা যেতে পারে, সেই লালবাগ কেল্লার ভেতরে মসজিদটির অবস্থান। লালবাগ কেল্লার ইতিহাস অনেকেরই জানা। সুবাদার শায়েস্তা খানের প্রথম দফা সুবাদারির পর সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁর তৃতীয় পুত্র শাহজাদা মোহাম্মদ আজমকে বাংলার সুবাদার করে পাঠান।
মুনতাসীর মামুন তাঁর ‘ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ বইতে লিখেছেন, শাহজাদা ঢাকা এসেছিলেন ১৬৭৮ সালের ২৯ জুলাই। তবে বাংলাপিডিয়ার মতে ২০ জুলাই। ঢাকায় তিনি বেশিকাল কাটাননি। ১৬৭৯ সালে তিনি চলে যান। তবে এই সময়ের মধ্যেই তিনি ঢাকার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে গেলেন এক অনন্য স্থাপনার জন্য। সেটি ‘কিল্লা আওরঙ্গবাদ’। পরে এই কিল্লা বা দুর্গটি এলাকার নামানুসারে ‘লালবাগ কেল্লা’ নামেই পরিচিত হয়ে ওঠে।
শাহজাদা আজম পিতার নামানুসারে এই দুর্গ নির্মাণ শুরু করলেও শেষ করতে পারেননি। তবে মসজিদটি তাঁর সময়ে নির্মিত হয়েছিল। শাহজাদা চলে যাওয়ার পরে শায়েস্তা খান ১৬৭৯ সালে দ্বিতীয় দফায় সুবাদার হয়ে ঢাকায় আসেন। তিনি এখানেই বসবাস ও তাঁর বিচারকাজ পরিচালনা করলেও দুর্গটির নির্মাণকাজ শেষ করেননি। এর পেছনের করুণ কাহিনিও অনেকের জানা। সুবাদারের পরমাসুন্দরী কন্যা ‘ইরান দুখত’ তথা বিবি পরীর বিয়ের ঠিকঠাক ছিল শাহজাদা আজমের সঙ্গে। কিন্তু দুর্গ নির্মাণকালেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। অনেকের অনুমান এ কারণে দুর্গটিকে সুবাদার শায়েস্তা খান ‘অপয়া’ মনে করতেন বলে এটি আর শেষ করা করেনি।
মোগলরীতি অনুসারে দুর্গ মসজিদটি তিন গম্বুজবিশিষ্ট। মাঝেরটি বড় আর পাশের দুটি একটু ছোট সম–আকারের। চার কোণে চারটি বুরুজ। গম্বুজগুলো মসজিদের ভেতরে অষ্টকৌণিক ড্রামের আকারে নির্মিত
সুবাদার শায়েস্তা খান লালবাগ দুর্গের কাজ শেষ করেননি বটে, কিন্তু প্রিয় কন্যার কবরের ওপর মোগলরীতির এক অনিন্দ্যসুন্দর সৌধ নির্মাণ করেন—যেটি এখন ‘পরী বিবির মাজার’ নামে পরিচিত। সৌধটি নির্মাণের জন্য সুবাদার সুদূর জয়পুর থেকে সাদা মার্বেল পাথর, রাজমহল থেকে বিশেষ ধরনের পাথর ও বর্তমান উত্তর প্রদেশের চুনার থেকে বেলে পাথর আনিয়েছিলেন। এর দরজা ছিল চন্দনকাঠের আর গম্বুজটি ছিল সোনায় মোড়ানো, সেসব বহু আগেই লুটপাট হয়ে গেছে।
লালবাগ দুর্গের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এর ভেতরের প্রধান তিনটি স্থাপনা মাঝখানে একই সরল রেখা বরাবর। পূর্ব প্রান্তে দ্বিতল দিওয়ান ও হাম্মামখানা, মাঝখানে পরী বিবির মাজার ও পশ্চিম প্রান্তে দুর্গ মসজিদ। আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তাঁর বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ বইতে উল্লেখ করেছেন শাহজাদা আজম বাংলার সুবাদার থাকাকালে ১৬৭৮-৭৯ খ্রিষ্টাব্দে এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন বলে বলা হয়ে থাকে। তবে এ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
এ এইচ দানি তাঁর ‘কালের সাক্ষী: ঢাকা’ বইয়ে লিখেছেন, কথিত আছে শাহজাদা মোহাম্মদ আজম এই মসজিদ তৈরি করেছিলেন। মসজিদের নির্মাণ কৌশল থেকে এ সত্য প্রমাণিত হয়। বাংলাপিডিয়াতেও বলা হয়েছে, শাহজাদা আজম দুর্গ অভ্যন্তরে দু–একটি সুন্দর মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন।
মোগলরীতি অনুসারে দুর্গ মসজিদটি তিন গম্বুজবিশিষ্ট। মাঝেরটি বড় আর পাশের দুটি একটু ছোট সম–আকারের। চার কোণে চারটি বুরুজ। গম্বুজগুলো মসজিদের ভেতরে অষ্টকৌণিক ড্রামের আকারে নির্মিত। ভেতরে পাতার নকশা করা। দেয়ালগুলোতে খিলান এবং আয়ত ও বর্গক্ষেত্রের নকশায় অলংকৃত। পশ্চিমে দেয়ালে তিনটি মেহরাব। উত্তর ও দক্ষিণের দরজা দুটি নকশা করা লোহার জাল দিয়ে এখন বন্ধ করা। পূর্বদিকে তিনটি দরজা। বড় দরজাটি মূল মেহরাব বরাবর। দরজা ও মেহরাব নকশা করা খিলানযুক্ত অর্ধগম্বুজ আকারের। পূর্ব ও পশ্চিমের দেয়ালে তিনটি করে রয়েছে ছয়টি কুলুঙ্গি। পুরো মসজিদের সামনে এবং দুই পাশের দেয়াল ‘বন্ধ খিলান’ নকশায় অলংকৃত।
মূল মসজিদের দৈর্ঘ্য ৬৫ ফুট এবং প্রস্থ ৩২ ফুট। মঙ্গলবার দুপুরে জোহরের নামাজের পর মসজিদের ইমাম হাফেজ মুফতি মাওলানা মো. জোবায়ের আহমদ, মোয়াজ্জিন মো.রফিকুল ইসলাম ও মসজিদ পরিচালনা কমিটির সহসভাপতি আবদুস সালামের সঙ্গে কথা হলো। শেষোক্ত দুজন ২০ বছরের বেশি সময় দায়িত্ব পালন করছেন। প্রথম আলোকে তাঁরা জানান, পুরোনো মসজিদের ভেতরে চারটি কাতার হয়। প্রতি কাতারে ৩০ জন করে প্রায় ১২০ জনের মতো মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। এ ছাড়া মসজিদের সামনে পুরোনো বারান্দায় সাতটি কাতার হয়। মসজিদের দুই পাশে এবং বারান্দার সামনে অনেকখানি জায়গায় সিরামিক ইট বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুক্রবারে জুমা ও তারাবিহতে এখানে জামাত হয়। সব মিলিয়ে প্রায় দুই হাজার মুসল্লি শাহজাদা আজমের এই মসজিদে নামাজ আদায় করতে পারেন।
মসজিদের খরচ চলে দানের অর্থে
এই মসজিদ লালবাগ কেল্লার মূল প্রাচীরের ভেতরে এবং কেল্লার একটি অংশ হলেও এর পরিচালনার খরচ বহন করে মসজিদ পরিচালনা কমিটি। মসজিদের সামনে লোহার গ্রিল দিয়ে কেল্লার মূল মাঠ থেকে পৃথক করে রাখা এবং মুসল্লিদের প্রবেশের জন্য দক্ষিণ প্রান্তে লাল সিরামিকের ইট পাতা সরুপথ রয়েছে। প্রতি ওয়াক্ত নামাজের ১৫ মিনিট আগে এই পথের দরজা খুলে দেওয়া হয় ও নামাজের ১৫ মিনিট পর আবার বন্ধ করা হয়। তবে রমজান মাসে অনেক মুসল্লি দীর্ঘ সময় মসজিদে বসে ইবাদত ও কোরান পাঠ করতে পছন্দ করেন। সে কারণে জোহরের নামাজের আগে দরজা খুলে দেওয়া হয়। বন্ধ হয় তারাবিহর জামায়াতের প্রায় ১৫ মিনিট পর। তারাবিহর জন্য সামনে ও উভয় পাশে ত্রিপলের ছাউনি ও লোহার শক্তপোক্ত কাঠামো তৈরি করে বৈদ্যুতিক পাখা টাঙানো হয়েছে। প্রতি সন্ধ্যায় এখানে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ জনের মতো ইফতারির ব্যবস্থা থাকে।
মসজিদ পরিচালনা কমিটির সহসভাপতি প্রবীণ ব্যবসায়ী আবদুস সালামের বাড়ি মসজিদের অপর পাশেই। তিনি প্রথম আলোকে জানান, মসজিদের খতিব, ইমাম, মোয়াজ্জিনসহ স্টাফ পাঁচজন। পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন করার লোক আছে আলাদা। মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সম্পদ হলেও তারা বিদ্যুৎ ও পানির বিল ছাড়া আর কোনো ব্যয় করে না। শুধু স্টাফ বেতনই আসে ৭০ হাজার টাকার ওপরে। এ ছাড়া আনুষঙ্গিক অনেক খরচ আছে। মসজিদ পরিচালনায় মাসে প্রায় লাখ টাকার মতো খরচ হয়। তারাবিহর এই ছাউনিতেই তিন লাখ টাকা খরচ হয়েছে। দুই ঈদে স্টাফ বেতনের সঙ্গে বোনাস আছে। এই ব্যয়ের জন্য তাঁরা স্থানীয় বাসিন্দাদের দানের ওপরেই নির্ভর করেন।
আরও জানালেন, একটি অনন্য উদ্যোগ তাঁরা নিয়েছিলেন। সবার সহযোগিতায় লালবাগ কেল্লার কাছেই চারতলা একটি ভবন কিনে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এত দিন ৬৫ হাজার টাকা ভাড়া আসত, চলতি মাস থেকে ভাড়া বৃদ্ধি হয়ে ৮০ হাজারে উঠেছে। মূলত এই আয় আর শুক্রবারে মুসল্লিরা বাক্সে যা দান করেন, তা দিয়েই চলছে মোগল শাহজাদার নির্মিত এই মসজিদ। সেই অর্থে তো বলাই যায় আমিরের মসজিদ চলছে গরিবের দানে!
মসজিদটির ভেতর আর বাইরে বিরাট ফারাক। ভেতরে সফেদ রং করা। বাইরের পাটকিলে রং ময়লা ঝুলকালিতে মলিন। মোয়াজ্জিন জানান, স্থানীয় এক রং ব্যবসায়ী মুসল্লি প্রতিবছর রমজানের শুরুতেই ভেতরে রং করে দেন। এর জন্য অনুমতি আছে। কিন্তু বাইরে কোনো কিছু করতে হলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের বিশেষ অনুমতি নিতে হয়। ফলে বাইরের দেয়ালে তারা হাত দিতে পারেন না।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের একটি কার্যালয় রয়েছে কেল্লার পাশেই। সেখানে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা জানান, মসজিদ পরিচালনার জন্য তাঁদের কোনো তহবিল দেওয়া হয় না। ছোটখাটো সংস্কারের প্রয়োজন হলে তাঁরা নিজস্ব বরাদ্দ থেকে সেরে নেন। কিন্তু বড় সংস্কারের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পনা ও বরাদ্দের প্রয়োজন। বরাদ্দ এলে নির্দেশ মোতাবেক সংস্কার করা হয়। নামাজিরা সেই বরাদ্দের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেননি । মসজিদের বহিরাবরণ মলিন হলেও তারা ভেতরটা পরিচ্ছন্ন করে রেখে চলেছেন দিনের পর দিন।