আগে ছিল ‘গায়েবি’ মামলা, এখন ‘ইচ্ছেমতো’ আসামি

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে দুই ব্যক্তি নিহত হওয়ার ঘটনায় দুটি মামলা করা হয় ২ সেপ্টেম্বর। মামলা দুটিতে আসামিদের তালিকায় নাম দেওয়া হয়েছে ঢাকা জেলা প্রশাসনের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের একজন পরিচালক, একজন উপপরিচালক ও একজন সহকারী পরিচালককে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মামলাটির পেছনে রয়েছেন বিএনপির একজন নেতা ও তাঁর জামাতা। জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের আসামি হওয়া কর্মকর্তারা বিএনপি নেতার জামাতার অনুমোদনহীন হিমাগারে অভিযান ও মামলা করেছিলেন। আবার পরিবেশ অধিদপ্তরের যে পরিচালককে আসামি করা হয়েছে, তিনি ওই বিএনপি নেতার আরেক জামাতা ছিলেন। তাঁদের বিচ্ছেদ হয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দেশজুড়ে মামলা হচ্ছে। এর মধ্যে পূর্বশত্রুতা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করা এবং চাঁদাবাজি ও হয়রানি করতে অনেককে আসামির করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। মামলায় কাদের আসামি করা হবে, তা অনেক ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার বিএনপি বা দলটির অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ‘গায়েবি’ মামলা দিত পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতারা। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, হত্যা মামলায় ‘ইচ্ছেমতো’ আসামি করা হচ্ছে।

যাচাই-বাছাই না করে মিথ্যা বা ভুয়া মামলা দিয়ে নিরপরাধ মানুষকে হয়রানি না করার অনুরোধ এসেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে। গত সোমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দায়েরের মাধ্যমে যাঁরা অপতৎপরতা চালাচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

হিমাগারে অভিযান চালিয়ে এখন আসামি

গত ১৮ ও ১৯ জুলাই যাত্রাবাড়ীর কাজলায় মো. সাকিব হাসান (২২) ও জাহাঙ্গীর আলম (৫০) নিহতের ঘটনায় করা মামলায় ঢাকা জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের আসামি করা হয়। মামলা করেছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ৬৩ নম্বর ওয়ার্ডের আহ্বায়ক আবু বক্কর। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, তাঁর পেছনে রয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক নবী উল্লাহ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২০ সালে ঢাকা জেলা প্রশাসকের সই জালিয়াতি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না নিয়ে মাতুয়াইলে হিমাগার (কোল্ড স্টোরেজ) চালু করেছিলেন নবী উল্লাহর জামাতা সিরাজউদ্দৌলা। এ ঘটনায় ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কর্মচারী মোশারফ হোসেন বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন। ওই মামলার সাক্ষী হন জেলা প্রশাসনের কর্মচারী নজরুল ইসলাম ও জাফর সিকদার। হিমাগারটিতে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রফিকুল হক। অভিযানে সিরাজউদ্দৌলাকে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

জালিয়াতির বিষয়টি ঢাকা জেলা প্রশাসনকে জানিয়েছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। তখন পরিবেশ অধিদপ্তরে কর্মরত ছিলেন উপপরিচালক ইলিয়াস মাহমুদ ও সহকারী পরিচালক মোক্তাদির হাসান। নবী উল্লাহর আরেক মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মাসুদ হাসান পাটোয়ারীর। ২০১৮ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়।

সাকিব ও জাহাঙ্গীর হত্যা মামলার এজাহার বিশ্লেষণে দেখা যায়, সিরাজউদ্দৌলার হিমাগারে অভিযান পরিচালনা করা ও মামলায় সাক্ষী হওয়া জেলা প্রশাসনের কর্মী এবং হিমাগারটিকে ছাড়পত্র না দেওয়া পরিবেশ অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের আসামি করা হয়েছে। সঙ্গে আসামি করা হয় মাসুদ হাসান পাটওয়ারীকেও।

এই সরকারি কর্মকর্তাদের দাবি, ব্যক্তিগত আক্রোশে তাঁদের আসামি করা হয়েছে। নিজের অনুসারী আবু বক্করকে দিয়ে কাজটি করিয়েছেন নবী উল্লাহ।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মাসুদ হাসান পাটওয়ারী প্রথম আলোকে জানান, হিমাগারের ঘটনার সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন না। ওই ঘটনার এক বছর পর অর্থাৎ ২০২১ সালে তিনি পরিবেশ অধিদপ্তরে যোগ দেন। তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে নবী উল্লাহর মেয়ের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের কারণে।

তবে নবী উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলা সম্পর্কে আমি জানি না। এগুলো জিগাইয়েন না। যাগো নামে মামলা হইছে, তারা আমাগো নামে বিভিন্ন অপপ্রচার করতাছে।’

মামলা দুটির বাদী আবু বক্করের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, তিনি দুই মামলায় কতজনকে আসামি করেছেন? জবাব না দিয়ে তিনি ক্ষুব্ধকণ্ঠে বলেন, ‘মাঠে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি, তখন কোথায় ছিলেন?’

এজাহার বলছে, ৪৪২ জন করে দুই মামলায় মোট ৮৮৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামির তালিকায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তাঁর দলের নেতা-কর্মী এবং সাবেক ও বর্তমান পুলিশ কর্মকর্তাদের নামও রয়েছে। দুই মামলার আসামির তালিকা একই।

বাদীকে ‘খরচা’ দিয়ে ইচ্ছেমতো আসামি

ঢাকার মিরপুর মডেল থানা–সংলগ্ন মিরপুর শপিং কমপ্লেক্সের সামনে ৫ আগস্ট গুলিতে আহত হয়ে পরে মারা যায় রিতা আক্তার (১৭)। এ ঘটনায় করা মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও পুলিশসহ ৩৯৫ জনকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে মিরপুর-১ নম্বরের মুক্তবাংলা শপিং কমপ্লেক্সের ব্যবসায়ী আফরোজ উদ্দিন ও শাহ আলী থানার ডি ব্লকের বাসিন্দা কাজী জয়নালের নামও রয়েছে।

ব্যবসায়ী আফরোজ উদ্দিনের দাবি, তাঁকে ফাঁসানো হয় তাঁর ভাইয়ের হত্যা মামলা তুলে না নেওয়ার কারণে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৫ সালে চাঁদার জন্য শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদতের নেতৃত্বে দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীরা তাঁর বড় ভাই ব্যবসায়ী আফতাব উদ্দিনকে গুলি করে হত্যা করে। ভাইয়ের হত্যা মামলার আসামিরাই তাঁকে রিতা হত্যা মামলায় ফাঁসিয়েছে।

মামলার বাদী রিতার বাবা মো. আশরাফ আলী। তিনি পেশায় রিকশাচালক। থাকেন মিরপুর–২ নম্বর সেকশনে। গ্রামের বাড়ি জয়পুরহাটের কালাইয়ে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির লোকেরা থানায় ছিলেন। তাঁরা আসামির তালিকা ঠিক করেছেন। তাঁর ভাষ্য, ‘আমাকে সই করতে বলেছে, তখন আমি সই করেছি। আসামি যে কতজন হয়েছে, তা আমি সঠিকভাবে বলতে পারব না।’

আসামির তালিকায় থাকা আফরোজ ও কাজী জয়নালকে চেনেন কি না, আশরাফ বলেন, ‘আমি চিনব কীভাবে। বিএনপির লোকজন আমাকে কিছু টাকাপয়সা দিছিল, তারাই তো মামলায় নাম ঢুকাইছে। ভালো–মন্দ সবাই মামলায় ঢুইক্যা গ্যাছে। হামি সাক্ষ্য দিয়ে নির্দোষ লোকদের বাঁচাতে চাই।’

থাকেন কক্সবাজারে, আসামি ঢাকার মামলায়

মিরপুর-১০ নম্বরের শাহ আলী প্লাজা এলাকায় গত ৪ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইকরামুল হক। ৭ সেপ্টেম্বর ইকরামুলের বাবা মো. জিয়াউল হক বাদী হয়ে ৭৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন, যার মধ্যে চারজন কক্সবাজারের বাসিন্দা। তাঁরা হলেন মিজানুর রহমান মাতবর, তাঁর চাচাতো ভাই জিয়াউর রহমান এবং তাঁদের ভাতিজা মো. কামাল ও নাজমুল হোসাইন সিদ্দিকী।

মিজানুর রহমান ও জিয়াউর রহমান প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, তাঁরা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এ কারণে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তারেক বিন সিদ্দিকী ১৬ বছর আগে তাঁদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়ে এলাকাছাড়া করেন। তাঁরা কক্সবাজারেই অন্য এলাকায় থাকেন। কখনো ঢাকায় থাকেননি। তাঁদের ভাষ্য, আওয়ামী লীগ নেতা তারেক বিন সিদ্দিক বাদী জিয়াউল হককে দিয়ে কাফরুল থানার হত্যা মামলায় তাঁদের আসামি করিয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মো. জিয়াউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি কিছুই বলব না।’

মিরপুর–১০ নম্বরে ১৮ জুলাই নিহত হন সিয়াম সরদার। এই ঘটনায় করা মামলায় অন্যান্যদের সঙ্গে আসামি করা হয়েছে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সহসভাপতি সৈয়দ দেলোয়ার হোসেনকেও। তিনি বলেন, রাজনীতিতে তাঁকে পিছিয়ে রাখতে নিজ দলেরই কেউ তাঁর নাম আসামির তালিকায় দিয়েছে।

ধানমন্ডিতে ১৯ জুলাই নিহত হন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো. শুভ। এ মামলায় আসামি করা হয়েছে ঘটনার আগে থেকে (২৮ জুন থেকে) অস্ট্রেলিয়ায় থাকা মিজানুর রহমান নামের এক ব্যবসায়ীকে। কী কারণে তাঁকে আসামি করা হলো, তা তাঁর স্বজনেরা বুঝতে পারছেন না।

মিরপুর–১০ নম্বরে ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে আসিফ ইকবাল নিহত হওয়ার ঘটনায় করা মামলায় আসামি করা হয় ব্যবসায়ী মো. জালালকে। তিনি দাবি করেন, মিরপুরে একটি বিপণিবিতানের কমিটির বিরোধকে কেন্দ্র তাঁকে ফাঁসানোর চেষ্টা হচ্ছে।

এভাবে আসামি করার উদাহরণ আরও আছে। হত্যা মামলায় আসামি করা হলে সহজে জামিন পাওয়া যায় না। তাই আসামিদের গ্রেপ্তারের আগে সঠিক তদন্তের ওপর জোর দেন ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার নাইম আহমেদ।

‘শত্রুতামূলক মামলা’

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও পরবর্তী সময়ে ৭৬৬ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এসব ঘটনায় ঢাকাসহ জেলায় জেলায় মামলা হচ্ছে। একেক মামলায় শত শত ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এখনো মামলা করা হচ্ছে। ঢাকার আশপাশের শিল্প এলাকায় কোনো কোনো মামলায় আসামি করা হয়েছে রাজনীতিতে যুক্ত না থাকা ব্যবসায়ীদেরও। কোনো কোনো মামলায় আসামি করা হয়েছে সাংবাদিক, শিল্পী, খেলোয়াড় ও নাগরিক আন্দোলনকর্মীসহ নানা পেশার মানুষকে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা করার উদ্দেশ্য চাঁদাবাজি। আর ‘ফ্যাসিবাদীদের’ ঘনিষ্ঠদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ যেসব অভিযোগ রয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা না নিয়ে হত্যা মামলায় নাম ঢুকিয়ে মামলাগুলোকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে।

বিএনপির নেতা-কর্মীরা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ‘গায়েবি’ মামলায় ভুক্তভোগী। তখন গায়েবি মামলা নিয়ে নাগরিক সমাজ ও দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলো প্রশ্ন তুলেছিল। এখন নতুন প্রবণতা ‘ইচ্ছেমতো’ আসামি করা। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না প্রথম আলোকে বলেন, শত্রুতামূলক ও হয়রানি করতে যে এসব মামলা করা হচ্ছে, এটা বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়া লাগে না।