রাষ্ট্রপতি পদ লাভজনক নাকি লাভজনক নয়—এখন নতুন করে এই বিতর্ক দেখা দিয়েছে। দেশের নতুন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন একসময় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনার ছিলেন। দুদক আইনে বলা আছে, দুদকের কোনো কমিশনার অবসর নেওয়ার পর প্রজাতন্ত্রের কোনো লাভজনক পদে নিয়োগের যোগ্য হবেন না। মো. সাহাবুদ্দিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর দুদক আইনের সূত্র ধরে রাষ্ট্রপতি পদ লাভজনক কি না, এই প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ।
সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও এই প্রশ্নে সবাই একমত হতে পারছেন না। তাঁদের কেউ কেউ মনে করেন, রাষ্ট্রপতি পদ অলাভজনক। তাঁদের বক্তব্য হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি একটি সাংবিধানিক পদ এবং এটি লাভজনক পদ নয়। তবে ভিন্নমতও রয়েছে কারও কারও।
রাষ্ট্রপতির পদ লাভজনক অথবা লাভজনক নয়, এমন কিছু সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা নেই। সে কারণেই বিষয়টি নিয়ে দেশে বিভিন্ন সময় বিতর্ক হয়েছে। এখন সেই বিতর্কই নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা ও অযোগ্যতা সম্পর্কে বলা রয়েছে। সেই অনুচ্ছেদ অনুসারে, ‘কোন ব্যক্তি কেবল রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী হইবার কারণে প্রজাতন্ত্রের কর্মে কোন লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত বলিয়া গণ্য হইবেন না।’
এই ধারার ব্যাখ্যায় সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক মনে করেন, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য যে পদগুলোকে লাভজনক নয় বলা হয়েছে, তা শুধু সংসদ নির্বাচনের জন্য প্রযোজ্য হয়। তিনি মনে করেন, রাষ্ট্রপতি পদে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অতীতে অনেকে সংসদ নির্বাচন করেছেন। সে কারণে সংসদ নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতার শর্তের ক্ষেত্রে সংবিধানে এই বিধান আনা হয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিকের মত হচ্ছে, সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতার প্রশ্নে সংবিধানের ওই বিধানে যখন বলা হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি ও অন্য পদগুলো লাভজনক পদ বলে গণ্য হবে না, তখন এর অর্থ দাঁড়ায়, রাষ্ট্রপতির পদ লাভজনক পদ। কিন্তু তা সংসদ নির্বাচনে গণ্য হবে না বলে প্রথম আলোকে বলেছেন তিনি।
তবে এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত নন আরেকজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ প্রবীর নিয়োগী। তাঁর সঙ্গেও কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি মনে করেন, সংবিধানে ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতির পদ লাভজনক নয় বলেই বিবেচনা করতে হবে।
একই ধরনের মত দিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খোরশেদ আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সংবিধান এই বিধানই স্পষ্ট করে দিয়েছে যে রাষ্ট্রপতির পদ লাভজনক নয়। ফলে দুদক আইন অনুযায়ী, দুদক কমিশনারের পদ থেকে অবসর নেওয়ার পর প্রজতন্ত্রের কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত হওয়া যাবে না বলে যা বলা হচ্ছে, সেটি সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি পদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না বলেই তিনি মনে করেন।
রাষ্ট্রপতি পদ লাভজনক কি না, তা একবার আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। এ নিয়ে ১৯৯৬ সালে হাইকোর্টে একটি রিট মামলা হয়েছিল। ওই সময় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে প্রথম দফায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছিল। তখন হাইকোর্টে রিট মামলায় অভিযোগ করা হয়েছিল, প্রধান বিচারপতি থেকে অবসর নিয়ে রাষ্ট্রের কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত হওয়া যায় না। ফলে সাহাবুদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন করতে পারেন না। রিট মামলার সেই অভিযোগের শুনানি শেষে সে সময় হাইকোর্ট রাষ্ট্রপতির পদ লাভজনক নয় বলে রায় দিয়েছিলেন।
হাইকোর্টে যে দুজন বিচারপতি সেই রায় দিয়েছিলেন, তাঁদের একজন বিচারপতি আব্দুল মতিন এখন অবসর জীবনে রয়েছেন। গত রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মামলার শুনানি যুক্তি ও প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে ওই রায় দিয়েছিলেন তাঁরা।
রাষ্ট্রপতির পদ অলাভজনক হওয়ার পরও অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি প্রথম আলোকে বলেন, উচ্চ আদালতের রায়েও বিষয়টি এসেছে। এর বাইরেও সংবিধানের ১৪৭ অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা আছে যে রাষ্ট্রপতি পদ লাভজনক নয়।
কিন্তু শাহদীন মালিক মনে করেন, সংবিধানের ওই বিধানেও রাষ্ট্রপতির পদ লাভজনক নয় বলে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি।
ফলে এই নিয়ে বিতর্ক থাকছেই। এর বাইরে আইন বিশেষজ্ঞরা আরেকটি প্রশ্ন তুলেছেন। প্রবীর নিয়োগী উল্লেখ করেছেন, ১৯৭২ সালের সংবিধানে সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের যোগ্যতার প্রশ্নে স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের পদ লাভজনক নয় বলে গণ্য করার কথা উল্লেখ করেছিল। কিন্তু ২০১১ সালে সংবিধানে যে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়, তাতে ওই বিধানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পদকেও অলাভজনক গণ্য করার বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে।
পঞ্চদশ সংশোধনীতে এই বিষয়টি যুক্ত করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক চিন্তা কাজ করেছে বলে মনে করেন আইনজীবী শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে এবং নতুন সংসদ নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত পুরোনো সংসদ বহাল রাখার বিধান সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর পদে থেকেই সংসদ নির্বাচন যাতে করা যায়, সেটাই ওই সংশোধনীর মূল লক্ষ্য ছিল বলে তিনি মনে করেন।
তবে শাহদীন মালিকের এই মতের সঙ্গে একমত নন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেছেন, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে বিতর্ক তোলার সুযোগ নেই।