ডিসি ও ইউএনওদের জন্য ২৬১টি গাড়ি কেনার প্রস্তাব। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ও গাড়ি কিনতে চায়।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার’ জন্য জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) নতুন গাড়ি দিতে চায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ২৬১টি গাড়ি কেনার একটি প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
গাড়ি কিনতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয় এবং ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরও। তিন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার পক্ষ থেকে মোট ২৭১টি গাড়ি কেনার প্রস্তাব সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রস্তাবগুলো পর্যালোচনা করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
এদিকে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য আরও দামি গাড়ি কেনার সুযোগ করে দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ১ আগস্ট মন্ত্রণালয় থেকে নিবন্ধন (রেজিস্ট্রেশন) ও শুল্ক-করসহ গাড়ির দাম নির্ধারণ করে নতুন নির্দেশনা জারি হয়। এই নির্দেশনা অনুযায়ী, সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য এখন সর্বোচ্চ ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা দামের গাড়ি কেনা যাবে। আগে সর্বোচ্চ ব্যয়ের সীমা ছিল ৯৪ লাখ টাকা। এর বাইরে বিভিন্ন ধাপে গাড়ির দামবাবদ ব্যয়সীমা বাড়ানো হয়েছে।
সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের পরিবহন কমিশনার আবুল হাছানাত হুমায়ুন কবীর প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের সময় জেলা প্রশাসকেরা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ইউএনওরা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। নির্বাচনে তাঁদের দৌড়ঝাঁপ বাড়বে। সে জন্য নতুন গাড়ি চাওয়া হয়েছে।
ডিসি ও ইউএনওদের জন্য ২৬১টি নতুন গাড়ি চেয়ে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তাঁদের জন্য স্পোর্ট ইউটিলিটি ভেহিক্যাল (এসইউভি, যা জিপ নামে পরিচিত) কেনার কথা বলা হয়। প্রস্তাবিত গাড়ির মডেল মিতসুবিশি পাজেরো স্পোর্ট কিউ এক্স। ডিসিদের জন্য ৬১টি ও ইউএনওদের জন্য ২০০টি এসইউভি দরকার বলে উল্লেখ করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
একেকটি গাড়ির দাম ধরা হয়েছে ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। মোট ব্যয় হবে ৩৮০ কোটি টাকা।
গাড়ি কেনার যৌক্তিকতা তুলে ধরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলছে, জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে শেষ করা, ভ্রাম্যমাণ আদালত (মোবাইল কোর্ট) পরিচালনা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসহ মাঠ পর্যায়ে নিরবচ্ছিন্ন পরিবহন সেবা নিশ্চিতে নতুন গাড়ি প্রয়োজন। যেসব গাড়ির আয়ুষ্কাল ১৩ বছর বা তদূর্ধ্ব, সেখানে নতুন গাড়ি দেওয়া জরুরি।
জাতীয় নির্বাচনের সময় জেলা প্রশাসকেরা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ইউএনওরা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। নির্বাচনে তাঁদের দৌড়ঝাঁপ বাড়বে। সে জন্য নতুন গাড়ি চাওয়া হয়েছে।সরকারি যানবাহন অধিদপ্তরের পরিবহন কমিশনার আবুল হাছানাত হুমায়ুন কবীর
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, যানবাহন কেনাকাটায় চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বরাদ্দ আছে ৬০ কোটি টাকা। কিন্তু দরকার ৩৮০ কোটি টাকা। তাই অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে বাড়তি ৩২০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে।
ডিসি ও ইউএনওদের জন্য নতুন গাড়ির চাহিদা ছিল আরও বেশি। চিঠি বলছে, প্রথমে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের জন্য ৯৬টি ও ইউএনওদের জন্য ৩৬৫টি গাড়ি চাওয়া হয়। সব মিলিয়ে ৪৬১টি গাড়ির জন্য ৬১২ কোটি টাকা চেয়েছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তবে দেশে আর্থিক সংকটের কারণে এত টাকা বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। পরে প্রস্তাব সংশোধন করে গাড়ির সংখ্যা কমানো হয়।
বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তারা কোটি টাকা দামের গাড়ি ব্যবহার করেন। এটা অপচয়।বারভিডার সাবেক সভাপতি আবদুল হক
পুরোনো গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিডার সাবেক সভাপতি আবদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ডিসি ও ইউএনওদের যে গাড়ি দেওয়া হয়, তা ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করলে ২৫ বছর পর্যন্ত চালানো যায়। এখন কঠিন সময়। তাই আরও সাশ্রয়ী হওয়ার দরকার।
ভারতে সরকারি কর্মকর্তারা অনেক কম দামি গাড়ি ব্যবহার করেন উল্লেখ করে আবদুল হক বলেন, বাংলাদেশে সরকারি কর্মকর্তারা কোটি টাকা দামের গাড়ি ব্যবহার করেন। এটা অপচয়।
জাতীয় নির্বাচনের জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম ও টাঙ্গাইল কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের জন্য গাড়ি কেনার প্রস্তাব দিয়েছে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়। গত ২৫ জুলাই এ-সংক্রান্ত একটি চিঠি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়, নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের আওতাধীন মাঠ পর্যায়ে কার্যালয়গুলোর আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা এবং জ্যেষ্ঠ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা যেসব গাড়ি ব্যবহার করছেন, সেগুলো ব্যবহারে প্রায় অনুপযোগী।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয় যেসব গাড়ির আয়ুষ্কাল ১০ বছর পার হয়েছে, সেখানে নতুন গাড়ি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। কত দামের গাড়ি কেনা হবে, কত ব্যয় হবে, তা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়নি।
ইসি সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি পাওয়া গেলে নির্বাচনের আগে নতুন গাড়ি কেনা হবে।
এদিকে ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তর জরিপ কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সাতটি গাড়ি কেনার অনুমতি চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। সংস্থাটি বলছে, সাতটি মিতসুবিশি এএসএক্স মডেলের এসইউভি কিনতে তাদের ব্যয় হবে ৫ কোটি টাকা। গত ১৬ জুলাই অর্থ বিভাগের সম্মতি চেয়ে চিঠি দেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আব্দুল বারিক।
কৃচ্ছ্রসাধনের অংশ হিসেবে গত ২ জুলাই অর্থ মন্ত্রণালয় গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করে একটি পরিপত্র জারি করে। এতে বলা হয়, সব ধরনের মোটরযান কেনায় অর্থ ব্যয় বন্ধ থাকবে। তবে ১০ বছরের অধিক পুরোনো মোটরযান প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের অনুমোদন নিয়ে ব্যয় করা যাবে।
কৃচ্ছ্রসাধনে সরকারের যে সিদ্ধান্ত, সেটি অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ, এখনো বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ বাড়ছে, মজুত কমছেই।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমছে, তেমনি অর্থ মন্ত্রণালয়ও টাকার সংকটে রয়েছে। টাকার অভাবে বিদ্যুৎ বিভাগের ভর্তুকি পুরোপুরি ছাড় করা হচ্ছে না। কৃষি মন্ত্রণালয় ভর্তুকির অর্থ না পেয়ে সারের টাকা দিতে পারছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, কৃচ্ছ্রসাধনে সরকারের যে সিদ্ধান্ত, সেটি অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ, এখনো বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ বাড়ছে, মজুত কমছেই। তাই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য নতুন গাড়ি কেনা কিছুতেই ঠিক হবে না। তিনি বলেন, এমন তো নয়, তাদের গাড়ি নেই। যেটা আছে, সেটিকে মেরামত করতে পারে। দেশের আর্থিক অবস্থা যখন ভালো হবে, তখন নতুন গাড়ি কেনা যাবে।