কেউ মারা গেলে অথবা কাউকে হত্যা করা হলে তার লাশ পাওয়া যায়। স্বজনদেরও ধীরে ধীরে কষ্ট কমতে থাকে। পরিবারের সদস্যরা সম্পদের উত্তরাধিকার লাভ করেন। তবে গুমের শিকার হলে ওই ব্যক্তির সম্পর্কে কোনো তথ্যই পাওয়া যায় না। ভুক্তভোগী বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে, শুধু এই তথ্যটুকু না পাওয়াটা প্রতিমুহূর্তে তাদের কুরে কুরে খায়। গুমের এমন ঘটনাগুলো খুনের চেয়েও খারাপ অপরাধ।
আজ শুক্রবার এশিয়ান ফেডারেশন অ্যাগেইনস্ট ইনভলান্টিয়ার ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সেসের (এএফএডি) অষ্টম কংগ্রেসে বক্তারা এসব কথা বলেন। রাজধানীর গুলশানের হোটেল বেঙ্গল ক্যানারি পার্কে মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের সহযোগিতায় এই কংগ্রেস আয়োজন করা হয়। অধিকারের সভাপতি অধ্যাপক সি আর আবরারের সভাপতিত্বে সভায় বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশের মানবাধিকারকর্মীরা অংশ নেন। গুমের শিকার ব্যক্তির স্বজনেরাও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
সভায় অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল স্বজনদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমি যখন গুম হওয়া মানুষগুলোর ছবির দিকে তাকাই, তখন আমি আপনাদের বেদনা বুঝতে পারি। আমরাও তো মানুষ। আপনারা যাঁরা স্বজনদের ছবি নিয়ে এসেছেন, আমি দেখি আর ভাবি, আমার বাচ্চাটা গুম থাকলে আমার কী অবস্থা হবে। আমি যদি গুম হই, আমার স্ত্রীর কী অবস্থা হবে, আমার মায়ের কী অবস্থা হবে।’
আসিফ নজরুল বলেন, ‘এগুলো চিন্তা করলে মনে হয়, যারা গুমের নির্দেশ দেয়, গুমের চিন্তা করে, আমার মনে হয় তাদের পরিবারগুলোকেও আমরা এমন অনুষ্ঠানগুলোতে নিয়ে আসি। তারা দেখুক, তাদের পিতা, সন্তান বা ভাইয়েরা কী করেছে। আমি এখনো বিশ্বাস করি, খুনের চেয়েও খারাপ অপরাধ গুম। একটা মানুষ মারা গেলে তো জানা যায়, তার মরদেহ পাওয়া যায়। কিন্তু এটা কী যে দুঃসহ যন্ত্রণা! একজন মানুষ জানে না যে তার স্বজন কি বেঁচে আছে নাকি নেই। আমরা গুম হওয়া পরিবারগুলোর পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের বিষয়ে অবশ্যই ভাবব।’
গুমসংক্রান্ত ঘটনাগুলোর তদন্তে সরকার খুব শক্তিশালী একটি কমিশন গঠন করেছে বলে জানান আইন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, এই কমিশন অপরাধের গভীরে যেতে এবং প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করছে। তিনি বলেন, ‘আমরা অবশ্যই এসব ঘটনায় জড়িতদের বিচারের বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কাজের ক্ষেত্রে সমন্বয় করতে পারে। গুমসংক্রান্ত কমিশনের মাধ্যমে পাওয়া তথ্যগুলো ট্রাইব্যুনালে বিচার পরিচালনার জন্য কার্যকরী হতে পারে।’
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১৫–১৬ বছরে সব অপরাধ হয়েছে বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, ‘যেই দলটি জোরপূর্বক গুম করেছে, দুর্নীতি করেছে অথবা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাদের শিকড় অনেক গভীরে। তাদের সঙ্গে লড়াই করা অনেক বড় কাজ, এটি সহজ নয়। তারা গত ১৫ বছর ধরে শক্তি সঞ্চয় করেছে। আর আমরা কয়েক সপ্তাহ ধরে এই শক্তির বিপরীতে কাজটি করছি। এ জন্য এই কঠিন লড়াইয়ে সফল হতে হয়তো কিছুটা সময় লাগবে।’
লড়াই চালিয়ে যাওয়া চ্যালেঞ্জের উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, ‘এখানে নির্বাচিত সরকার আসবে, আমরা দীর্ঘ সময়ের জন্য এখানে আসিনি। এটা নিশ্চিত করতে হবে, পরবর্তী নির্বাচিত সরকার এই লড়াই অব্যাহত রাখবে।’
অনুষ্ঠানে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, যে মানুষগুলো গুম হয়, তাদের ব্যাংক হিসাবে অনেক অর্থ থাকলেও তাঁদের ছেলেমেয়েদের হয়তো নিঃস্ব জীবনযাপন করতে হয়। তাঁরা হয়তো সামাজিক অবস্থানের কারণে মানুষের কাছে হাত পাততেও পারেন না। এভাবে তাঁরাও প্রতিমুহূর্তে ভেতরে ভেতরে মারা যান।
এই সমস্যার সমাধানে কিছু অর্ডিন্যান্স (অধ্যাদেশ) প্রয়োজন উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘যাতে ভুক্তভোগীদের পরিবারগুলো দ্রুততম সময়ে সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতে পারে। ভুক্তভোগী স্বজনের সঙ্গে পরিবারের সাত বছর বা এ ধরনের সময় ধরে যোগাযোগ নেই অথবা নিখোঁজ, এমন কিছু প্রমাণের প্রয়োজন না হয়। কারণ, তারা এটা পারবে না।’
আইন উপদেষ্টার কাছে অনুরোধ জানিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এমন একটি অধ্যাদেশ প্রণয়ন ও প্রবর্তনের জন্য অনুরোধ করছি, যার মাধ্যমে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। যাতে ভবিষ্যতে কেউ এই ধরনের অপরাধ করার সাহস না পায়।’
আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমরা অবশ্যই এ বিষয়ে আইন করার উদ্যোগ নেব। সেখানে ক্ষতিপূরণসহ আইনি যে সমস্যাগুলো রয়েছে, সেগুলো নিয়েও কাজ করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের আন্তরিকতা নিয়ে কোনো সন্দেহ রাখবেন না। হয়তো আমাদের সক্ষমতার ঘাটতি থাকতে পারে। কিন্তু আন্তরিকতা ও সাহসের কোনো অভাব নেই। আমরা এর শেষ দেখে ছাড়ব।’
সভায় ২০১৯ সালে গুমের শিকার ইসমাইল হোসেন নামের এক বিএনপি নেতার স্ত্রী নাসরিন জাহান (স্মৃতি) পরিবার নিয়ে তাঁদের যন্ত্রণার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামীকে গুম করা হয়েছে। প্রতিটা মুহূর্তে, মিনিটে, সেকেন্ডে আমরা মারা যাচ্ছি। আমরা আর কতবার মরব?’
বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থায় একজন নারী হয়ে শিশুসন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের অর্থনৈতিক প্রয়োজন মেটানো খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে উল্লেখ করেন নাসরিন জাহান। তিনি বলেন, ‘আপনারা আমাদের অন্তত একটা সন্ধান দিন যে আমার স্বামী আছে নাকি নাই। নামাজের বিছানায় বসে যেন কিছু অন্তত বলতে পারি। আর কত? আমরা আর পারতেছি না। আমাদেরকে সাহায্য করুন।’
ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকার বলে উল্লেখ করেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। তিনি বলেন, এই অগ্রাধিকার শুধু ভুক্তভোগী গুমের শিকার ব্যক্তিদের জন্যই নয়, এটা সাড়ে ১৫ বছরের বর্বর ও ফ্যাসিস্ট শাসনামলের দেশের সব ভুক্তভোগী মানুষের জন্যই অগ্রাধিকার।
আদিলুর রহমান খান আরও বলেন, ‘আমরা একত্রিত হয়ে দাঁড়িয়েছি, একত্র হয়ে ফ্যাসিস্টের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। আমরা দৃঢ়সংকল্প ব্যক্ত করতে চাই যে আমরা ন্যায়বিচার নিশ্চিত না করে এই লড়াই শেষ হতে দেব না।’
অধ্যাপক সি আর আবরার বলেন, এই ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়া সহজ নয়। এখানে অনেক ধরনের অনিশ্চয়তা রয়েছে। পতিত সরকারের অনেক বেশি ক্ষমতা ছিল, অনেক বেশি কর্তৃত্ব ছিল, তাদের সবাই চলে যায়নি। অনেকেই এখনো আছেন। তাদের অনেক সম্পদও রয়েছে। তারা এই জনসমর্থিত সরকারের কর্তৃত্ব খর্ব করার চেষ্টা করবে। এ জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।