নয়াদিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বৈঠকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এসেছে।
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে আলোচনায় প্রত্যাশিতভাবে উঠে এল নির্বাচনমুখী বাংলাদেশের প্রসঙ্গ। বৈঠকে ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের চিন্তাভাবনার কথা আরেকবার যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়ে দেওয়া হয়। সেই ধারণার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবের অমিলের বিষয়টি আরও একবার স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
দুই দেশের নেতাদের মধ্যে বৈঠকে বাংলাদেশ প্রসঙ্গের অবতারণার কথা গতকাল শুক্রবার সাংবাদিকদের জানান ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রা। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেন, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি ভারত শ্রদ্ধাশীল। বাংলাদেশের নির্বাচন দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনের সঙ্গে ওই বৈঠকে অংশ নেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং।
বৈঠকের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, পঞ্চম যুক্তরাষ্ট্র-ভারত (২+২) মন্ত্রী পর্যায়ের এই সংলাপে আস্থা ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুই দেশের অগ্রগতির বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের অংশীদারত্বের গুরুত্ব পুনর্ব্যক্ত করেন তাঁরা। চার দেশীয় জোট কোয়াডের মতো বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একটি অবাধ, মুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল নিশ্চিতে নিজেদের জোরালো অবস্থানের কথাও উল্লেখ করেন দুই দেশের মন্ত্রীরা। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য, ইউক্রেন ও আফগানিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়। ইসরায়েলে সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা এবং গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের জন্য মানবিক ত্রাণসহায়তা পৌঁছাতে ওই অঞ্চলের অংশীদারদের সঙ্গে কার্যক্রম অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন তাঁরা।
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রা সংবাদ সম্মেলনে জানান, ওই বৈঠকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়েও দুই দেশের নেতারা আলোচনা করেছেন।
বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ হতে পারে, সে জন্য যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহ প্রকাশের পাশাপাশি যথেষ্ট চাপও সৃষ্টি করে চলেছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র কিছুদিন আগে বাংলাদেশের জন্য তাদের নতুন ভিসা নীতিও ঘোষণা করে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তারা যথেষ্ট সক্রিয়ও। সেই সক্রিয়তার কারণে বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে কিছুটা টানাপোড়েনও সৃষ্টি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ওই সক্রিয়তা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে পারে বলে ভারতের আশঙ্কা। কারণ, ভারত মনে করে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হলে মৌলবাদী শক্তি মাথাচাড়া দেবে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাবও মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে যাবে, যা ভারতের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই ব্যাখ্যা ভারত আগেই যুক্তরাষ্ট্রকে নানাভাবে জানিয়েছে। গতকাল দুই দেশের বৈঠকেও তা নতুন করে জানানো হলো।
সংবাদ সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রসচিবকে সরাসরি এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, বাংলাদেশসহ আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
বিনয় কোয়াত্রা বলেন, ‘বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের অবস্থানের কথা পরিষ্কারভাবে আমরা জানিয়েছি। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যত্র আঞ্চলিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারতের মনোভাবের কথা ওদের (যুক্তরাষ্ট্র) স্পষ্টভাবে জানানো হয়েছে।’
সেই ধারণা কী, বিনয় কোয়াত্রা তা-ও জানাতে দ্বিধা করেননি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন কেমন হবে, নির্বাচন কেমন হবে, তা সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের জনগণই তা ঠিক করবেন। তাঁরাই তাঁদের দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবেন। বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভারত। সে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি ভারত শ্রদ্ধাশীল। বাংলাদেশকে স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধিশালী করে তুলতে সে দেশের দৃষ্টিভঙ্গিকে ভারত বরাবর সমর্থন করে আসছে। সেই সমর্থন অব্যাহত থাকবে।
ভারতের এই মনোভাবের কথা গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়েও জানিয়েছিলেন মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি। কিন্তু একই কথা ২+২ বৈঠকের পর জানানোর অর্থ, বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির সঙ্গে ভারত এখনো সহমত নয়।
পাশাপাশি ভারত আরেকবার বুঝিয়ে দিল, নির্বাচনমুখী বাংলাদেশের পাশে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটেনি। যুক্তরাষ্ট্রকেও গতকাল সেই বার্তা আরেকবার দেওয়া হলো।
বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব কেমন ছিল, সে ব্যাপারে কোনো আভাস অবশ্য পররাষ্ট্রসচিব দেননি। তিনি শুধু বলেন, তৃতীয় কোনো দেশের নীতি নিয়ে মন্তব্য ভারত সমীচীন মনে করে না।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের অবস্থানে কখনো পরিবর্তন আসেনি। এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এবার যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর যে চাপ সৃষ্টি করছে, তা ভারত পছন্দ করছে না। ভারতের মনোভাব, ভারত কী চায়, তা এর আগেও যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হয়েছে। শুক্রবারও স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া হলো। বুঝিয়ে দেওয়া হলো, একটা গণতান্ত্রিক দেশের ওপর এভাবে চাপ সৃষ্টি করা ভারত অনুমোদন করে না।
পিনাক রঞ্জন বলেন, বারবার সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের কথা বলার মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ধরে নিচ্ছে বাংলাদেশের নির্বাচন ঠিকমতো হবে না। তাই নানা রকম নিষেধাজ্ঞা চাপাচ্ছে ও চাপানোর হুমকি দিচ্ছে। ভারত এই বাইরের হস্তক্ষেপ বা এক্সটার্নাল ইন্টারফিয়ারেন্সও অনুমোদন করে না। বিশেষত সেই হুমকি যখন বাংলাদেশের মতো ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও বিশ্বস্ত প্রতিবেশীকে দেওয়া হচ্ছে। ভারতের কাছে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষা জরুরি। সে কথাও যুক্তরাষ্ট্রকে জানানোর মধ্য দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে, এত বাড়াবাড়ির প্রয়োজন নেই।