সরকারের লোকসানি কারখানাটি যেভাবে লাভে ফিরল

ইস্টার্ন কেব্‌লস লিমিটেড
ইস্টার্ন কেব্‌লস লিমিটেড

টানা তিন বছর লোকসানের পর গত অর্থবছরে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (বিএসইসি) আওতাধীন বিভিন্ন বৈদ্যুতিক তার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন কেব্‌লস লিমিটেড লাভে ফিরেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮৫ লাখ টাকা লাভ করেছে সরকারি এ প্রতিষ্ঠান। এর আগের তিন বছরে প্রায় ৪০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

ঠিক উল্টো অবস্থা বিএসইসির আরেক প্রতিষ্ঠান গাজী ওয়্যারস লিমিটেডের। টানা তিন বছর লাভের পর গত অর্থবছরে লোকসান গুনেছে প্রতিষ্ঠানটি। কর্তৃপক্ষ বলেছে, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের মতো সরকারের বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাছ থেকে পণ্য কেনা বন্ধ করে দেওয়ায় এ লোকসান হয়েছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠান পণ্য কেনা বন্ধ করে দেওয়ার পরও লাভের মুখ দেখেছে ইস্টার্ন কেব্‌লস লিমিটেড।

প্রথমে প্রতিযোগীদের বিশ্লেষণ করেছি যে তারা কীভাবে ব্যবসা করছে। আমরা কেন পণ্য বিক্রি বাড়াতে পারছিলাম না। এ বিশ্লেষণই সবচেয়ে বড় অর্জন।
মো. আবুল কালাম আজাদ, ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইস্টার্ন কেব্‌লস

শিল্প মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিএসইসি বর্তমানে ৯টি কারখানা চালায়। এর মধ্যে লোকসানি কারখানার সংখ্যা বেড়েছে। গত অর্থবছরে পাঁচটি কারখানা লোকসান দিলেও আগের বছর লোকসানে ছিল চারটি। সর্বশেষ অর্থবছরে পাঁচটি লোকসানে ও চারটি লাভে ছিল। এ ছাড়া বিএসইসির তিনটি কারখানা যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হয়। করপোরেশনের আরও অন্তত ছয়টি কারখানা দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শুধু ইস্টার্ন কেব্‌লসই পণ্য রপ্তানি করছে।

চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় অবস্থিত ইস্টার্ন কেব্‌লস ডমেস্টিক কেব্‌ল, এলটি পাওয়ার কেব্‌ল, এইচটি পাওয়ার কেব্‌ল, এসি/এসিএসআর (বেয়ার) ও এএসি/এসিএসআরের (ইনসুলেটেড) বিভিন্ন আকারের বৈদ্যুতিক তার উৎপাদন করে থাকে।

যেভাবে লাভে ফিরল ইস্টার্ন কেব্‌লস

গত অর্থবছর থেকে কর্মপরিকল্পনায় বদল এনেছে ইস্টার্ন কেব্‌লস। তারা বাজার বিশ্লেষণ করে দেশের বাজারে সারা বছর যেসব বৈদ্যুতিক তার বিক্রি হয়, সেটার উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যতটা দাম বাড়িয়েছে, ইস্টার্ন কেব্‌লস ততটা বাড়ায়নি। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, বাজারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের তুলনায় তাদের পণ্যের দাম বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কম। এতে দেশের বাজারে তাদের বিক্রি বেড়েছে।

২০২১ সালের মে মাসে ইস্টার্ন কেব্‌লসে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দেন মো. আবুল কালাম আজাদ। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর গত অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি লাভের মুখ দেখেছে। আবুল কালাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথমে প্রতিযোগীদের বিশ্লেষণ করেছি, তারা কীভাবে ব্যবসা করছে। আমরা কেন পণ্য বিক্রি বাড়াতে পারছিলাম না। এই বিশ্লেষণই সবচেয়ে বড় অর্জন।’

দেশের বাজারে বেশি চাহিদার বৈদ্যুতিক তার উৎপাদন ও বিক্রি বাড়ানোর পাশাপাশি বিদেশেও পণ্য রপ্তানি করছে ইস্টার্ন কেব্‌লস।

প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, চীনের সরকারি প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল টেকনিক্যাল ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনের (সিএনটিআইসি) কাছে ২০২২ সালের মে মাসে ৫ লাখ ২৪ হাজার ডলারের পণ্য রপ্তানি করে ইস্টার্ন কেব্‌লস। পণ্যের মান ভালো হওয়ায় এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সিএনটিআইসি গত বছরের জুলাইয়ে ৪২ লাখ ডলারের রপ্তানি চুক্তি সই করে। সাড়ে ১০ লাখ ডলারের সেই চুক্তির প্রথম চালান গত ডিসেম্বরে সরবরাহ করা হয়েছে। এখন দ্বিতীয় চালান দিতে উৎপাদন কার্যক্রম চলছে।

সিএনটিআইসি ছাড়া আরও একটি বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে জানিয়ে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘বৈদ্যুতিক তার রপ্তানি করে লোকসানের বড় অংশ কাটিয়ে ফেলেছি।’

ব্যবস্থাপনায় সংস্কারসহ বিভিন্ন পর্যায়ে ইস্টার্ন কেব্‌লসের খরচও কমেছে। আগে ১০টি মেশিনের মধ্যে ৫টিতে উৎপাদন হলেও সব কটিই চালু থাকত। এখন পাঁচটি চললে বাকি পাঁচটি বন্ধ রাখা হচ্ছে। এভাবে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হচ্ছে।

আবুল কালাম বলেন, এভাবে গত অর্থবছরে প্রায় ৪৬ লাখ টাকার বিদ্যুৎ খরচ সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে। চলতি অর্থবছরেও এখনো তাঁরা লাভে আছেন। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প ও বিদ্যুৎ বিভাগের প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কাছ থেকে পণ্য নিলে প্রতিষ্ঠানটি বছরে ২০ কোটি টাকার বেশি লাভে থাকতে পারবে বলে আশা তাঁদের।

গাজী ওয়্যারসের কর্মকর্তা যা বলছেন
বিএসইসির ৯টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শুধু ইস্টার্ন কেব্‌লসই পণ্য রপ্তানি করছে। বিএসইসির আওতাধীন আরেক সরকারি তার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গাজী ওয়্যারস তিন বছর লাভের পর গত অর্থবছরে লোকসানে পড়েছে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন বিএসইসির প্রতিষ্ঠান গাজী ওয়্যারস ১৯৬৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিদু৵তের তার উৎপাদন করে কয়েক বছর ধরে তারা লাভে ছিল। শিল্প মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে এসে তারা তিন কোটি টাকার বেশি লোকসান দিয়েছে।

লাভজনক প্রতিষ্ঠান হঠাৎ কেন লোকসানে পড়ল, এমন প্রশ্নে গাজী ওয়্যারসের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মনিরুজ্জামান খান সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, আগে তাঁদের প্রধান গ্রাহক ছিল বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি)। মান ভালো বলে তাঁদের পণ্যের দাম বেশি পড়ে। অল্প লাভে তাদের কাছে মাল বিক্রি করা যেত। এখন বিআরইবি বাজার থেকে কম দামে নিম্ন মানের তার কিনছে। এতে তাঁরা লোকসানে পড়েছেন।

বিকল্প বাজার খোঁজার চেষ্টা করছেন কি না, জানতে চাইলে মনিরুজ্জামান খান বলেন, ‘আমাদের এখন প্রধান ক্রেতা বেসরকারি বড় বড় প্রতিষ্ঠান, তবে তাদের চাহিদা কম। সাধারণ মানুষ আমাদের পণ্যের মূল্য বোঝে না। আবার অর্থের অভাবে গ্রাহক আকৃষ্ট করতে বেশি প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারছি না।’

বিএসইসির চেয়ারম্যান মো. শহীদুল হক ভূঞা প্রথম আলোকে বলেন, একটি কারখানার লাভ-লোকসান ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সক্রিয়তা ও কর্মদক্ষতার ওপর নির্ভর করে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকেরা যখন আরও সক্রিয় হবেন, তখন আরও রপ্তানি করা সম্ভব হবে।