প্রাক্-বর্ষা, বর্ষা ও বর্ষা-পরবর্তী—বছরে তিনবার মশা জরিপ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা। এবার প্রাক্-বর্ষা জরিপ শেষ হওয়ার আগেই ঢাকায় বসতবাড়িতে এডিস মশার শূককীট বা লার্ভা বেশি পাওয়া গেছে।
তখনই আশঙ্কা করা হয়েছিল, এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ মারাত্মক হতে পারে। হয়েছেও তা–ই। মানুষের স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ক্ষতি কমাতে মশার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা খুব জরুরি।
ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে কীভাবে? এ ব্যাপারে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মো. সাইফুল্লাহ বলেন, ‘যেসব স্থানে মশা ডিম পাড়ে বা শূককীট বেড়ে ওঠে, সেগুলোকে ধ্বংস করতে হবে। তাই বাড়ির আঙিনা ও ঘরের ভেতরে যেকোনো পাত্রে জমে থাকা পানি তিন দিন অন্তর ফেলে দিতে হবে।’
ডা. মো. সাইফুল্লাহ বলেন, ‘প্লাস্টিকের নানা ধরনের পাত্র, কোমল পানীয়ের বোতল, কলাপসিবল গেটের নিচের অংশ, ফেলে দেওয়া টায়ারের অংশ, দইয়ের ফেলে দেওয়া পাত্র, ছাদবাগানের ফুলের টব, পানির মিটারের কাছের গর্ত, ডাবের খোসা, অব্যবহৃত কর্কশিট, সিরামিকের পাত্র, সিঁড়ির পাশের ভাঙা হাতল, যানবাহনের অংশ, গাড়ির গ্যারেজসহ অনেক কিছুতেই ডেঙ্গু মশার লার্ভা থাকে। এসব জায়গায় জমে থাকা পানি পরিষ্কার করা জরুরি।’
মশার সংক্রমণ থেকে রেহাই পেতে কিছু ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপায় সম্পর্কে বলেছেন আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পুষ্টিবিদ ইসরাত জাহান। সেগুলো হচ্ছে—
কিছু সুগন্ধ মশার একেবারেই অপছন্দ। বাজারে নানা রকম সুগন্ধি তেল পাওয়া যায়। এসবের মধ্যে ল্যাভেন্ডার, ইউক্যালিপটাস, লেমনগ্রাস ও পিপারমিন্টের গন্ধ মশা সহ্য করতে পারে না। ঘরে এসব সুগন্ধ ব্যবহার করলে মশা দূরে থাকবে। এ ক্ষেত্রে নিমের তেল বেশ কার্যকর।
মশার যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে ঘুমানোর সময় ঘরের জানালা একেবারে বন্ধ করলে ঘরে বাতাস চলাচল ব্যাহত হয়। তাই সমাধান হিসেবে জানালায় লাগানোর জন্য নানা মাপের মশার জাল কিনে নেওয়া যেতে পারে।
মশা আমাদের ঘামের গন্ধ অনুসরণ করে কামড় বসায়। তাই রাতে ঘুমানোর আগে গোসল করে নিলে ঘামের গন্ধ দূর হয় এবং মশার কামড় খাওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। এ ছাড়া বিছানার চাদর, বালিশ ইত্যাদিও গন্ধমুক্ত রাখতে হবে।
ভেষজ কিছু গাছ আছে, যেগুলো ঘরে টবের মধ্যে সাজিয়ে রাখলে মশার আনাগোনা কমে। যেমন রোজমেরি, পুদিনা, ভুঁইতুলসী, ক্যাটনিপ, রসুনগাছ ইত্যাদি।
ঘুমের আগে আলসেমি লাগলেও মশারি টানিয়ে নিন। শিশু ও বৃদ্ধদের বিছানায় মশারি টানাতে ভুলবেন না।
এ সময় ডেঙ্গু প্রতিরোধে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতাও বাড়াতে হবে। এ জন্য স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মেনে চলার বিকল্প নেই। কারণ, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা শক্তিশালী হলে সব ধরনের রোগ থেকে নিস্তার পাবেন। তাই বিভিন্ন রঙের মৌসুমি ফল, শাকসবজি নিয়মিত খেলে ডেঙ্গুসহ নানা রোগ শরীরে বাসা বাঁধতে পারবে না।
বাজারে মশা তাড়ানোর জন্য বিভিন্ন উপকরণ পাওয়া যায়। যেমন মশার কয়েল, স্প্রে, ত্বকে লাগানোর লোশন, কীটনাশক, পাওয়ার গার্ড মেশিন, কিলার ব্যাট, ম্যাজিক মশারি, কিলিং ল্যাম্প ইত্যাদি। তবে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. মো. সাইফুল্লাহর মতে, এসব ব্যবহারে থাকতে হবে সতর্ক। কারণ, মশা তাড়াতে ব্যবহৃত বেশির ভাগ অ্যারোসল স্প্রেতে পাইরিথোয়েড নামের রাসায়নিক উপাদান থাকে। এটা বাষ্পীভূত হয়ে বাতাসে মেশে ও মশা তাড়ায়।
এমনিতে এর খুব ক্ষতিকর প্রভাব না থাকলেও একাধিক গবেষণায় দেখা যায়, এ ধরনের স্প্রের ব্যবহার হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস রোগীদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর কয়েলের ধোঁয়ায় ফরমালডিহাইড, হাইড্রোকার্বনসহ আরও কিছু উপাদান থাকে, যেগুলোর নির্দিষ্ট পরিমাণের বাইরে গেলে তা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তবে শিশুদের ধারে-কাছে কয়েল না জ্বালানোই ভালো।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনামতে, মশা তাড়ানোর স্প্রে বা ইলেকট্রিক কয়েল ঘরে দেওয়ার পর সেখানে পরবর্তী ২০ মিনিট মানুষকে থাকতে নিষেধ করা হয়। কারণ, ওই স্প্রেতে ছড়ানো কীটনাশকের ড্রপলেটস মাটিতে নেমে আসতে ২০ মিনিট সময় লাগবে। ফলে তখন সেখানে মানুষ থাকলে তিনি সরাসরি কীটনাশকের সংস্পর্শে আসবেন, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
সর্বোপরি ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধি, সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা বাড়ানো, পরিস্থিতি মোকাবিলায় কৌশলগত অগ্রাধিকার ঠিক করা, স্বাস্থ্যব্যবস্থায় দক্ষতা বাড়ানো, হাসপাতালে রোগী ব্যবস্থাপনায় সৃজনশীল উদ্যোগ, মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা চালু, মশারি বিতরণ, মশার ওপর নিয়মিত নজরদারি এবং সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নিয়মিত ও জোরালো তদারকির মাধ্যমে ডেঙ্গুর প্রভাব কমানো সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।