‘কোটি টাকার বিনিময়েও আমি আমার সন্তানরে পামু না। আইজ তিন-চার মাস হইয়া আইতেছে, আমার সন্তান আমারে মা কইয়া ডাকে না। কই গেলে আমি আমার মানিকরে পামু, কন আপনেরা।’ এভাবে বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন সেলিনা বেগম।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে গুলিতে নিহত একমাত্র ছেলে আমিনুল ইসলামের কথা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলাতে পারছিলেন না সেলিনা। ‘স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল: জুলাই গণ–অভ্যুত্থান’ অনুষ্ঠানে ছেলের স্মৃতিচারণা করেন তিনি। গণ–অভ্যুত্থানে হতাহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের স্মৃতিচারণার এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল। আজ শুক্রবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবে ছিল এই আয়োজন।
২১ জুলাই রাজধানীর শনির আখড়া এলাকায় আমিনুল ইসলাম গুলিবিদ্ধ হলে তাঁকে রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যান বাবা রিকশাচালক ওবায়দুল ইসলাম। আমিনুল একটি কারখানায় আট হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন। সেই টাকা দিয়ে বাসা ভাড়া দেওয়া হতো। আর তাঁর বাবার রিকশা চালানোর টাকায় সংসার চলত।
সুখেই ছিলেন উল্লেখ করে কান্নাজড়িত কণ্ঠে সেলিনা বেগম বলেন, ‘(আমিনুল দুপুরে) ভাত খাইতে আইত। যদি দেখত আমি শুয়ে আছি, গালডা আমার গালের লগে লাগাইত। এহন তো কেউ আমার গালের লগে গাল লাগায় না। আমারে মা কইয়া ডাকে না। বাবায় তো আর বাবা ডাক শোনে না। আমার মনের জ্বালা কারে কমু।’
আমিনুলের বেশ কিছু ছবি প্রিন্ট করে এনেছেন সেলিনা বেগম। যখন দেখতে ইচ্ছে করে, তখন দেখেন তিনি। সেলিনা বলেন, ‘সংসার করলে ঝগড়াঝাঁটি হয়। অনেক সময় একটু রাগারাগি হলে আমি কানলে, আমার সন্তান কইত মা—“তুমি কাইন্দো না। তোমার চোখের পানি আমি দেখতে পারি না।” এখন তো কেউ কয় না—“মা, তুমি এত কান্দো ক্যা।” কেউ যদি আমার আমিনরে (আমিনুল) ফেরত দিতে পারত, আমি আমার জীবনডা দিয়ে দিতাম।’
বিলাপ করতে করতে সেলিনা বেগম বলেন, ‘চার মাস হইছে আমি আমার ছেলের মুখ দেখি না। কই গেলে আমি আমার সন্তানরে পামু। আমার একটাই ছেলে। কোন জায়গায় যামু কন, আপনেরাই কন, কই আমি আমার সন্তানের ডাক…(শুনতে পাব)। কই গেলে আমি আমার মানিকরে পামু কন আপনেরা।’
রাজধানীর নতুন বাজার (বারিধারা) এলাকার মো. মুজাহিদ বাড্ডায় আহত হন। আজকের এই আয়োজনে তিনি সেই ঘটনা বর্ণনা দেন। প্রতিদিন আন্দোলনে আসা মুজাহিদ এক রাতে আন্দোলন শেষে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে বাসায় ফিরছিলেন। তখনো সহিংসতা চলছিল। সে সময় ছাদ থেকে গুলি করা হচ্ছিল। একপর্যায়ে দেখেন একটি বাচ্চা রাস্তা দৌড় দিয়ে পার হচ্ছিল। পার হওয়ার সময় ওই বাচ্চার ডান হাতে গুলি লাগে।
মুজাহিদ বলেন, ‘এটা দেখে আমার সহ্য হয় নাই। আমি দৌড়ে বাচ্চাটাকে ধরলাম। ধরতেই কিডনি বরাবর দুইটা বুলেট লাগে। সেখানে আমি পড়ে যাই। পড়ে যাওয়ার পর আমাকে শটগান দিয়ে বাইড়াবাড়ি করছে। বলছে, আসছিলি কেন আন্দোলনে। পরে গাড়ি থেকে ছিটা (ছররা) গুলি মারছে। এখনো আমার ভেতরে ১২৩টার মতো গুলি আছে।’
শিক্ষার্থী ওয়াহিদুল ওয়াহেদও বাড্ডা এলাকায় চোখে গুলিবিদ্ধ হন। আন্দোলনে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসায় অসন্তোষ প্রকাশ করে ওয়াহিদুল বলেন, ‘আমাদের ওপর দিয়েই কিন্তু সরকার হয়েছে। আমার মনে হচ্ছে এটা আমাদের সরকার না। আসলেই আমাদের না। কারণ, যতটুকু চিকিৎসা আমাকে দিয়েছে, এই চিকিৎসা এমনিতেই সবাইকে দেয়। আমার মনে হয়, যে চিকিৎসা দিয়েছে, তা আরও একটু উন্নত মানের বা শোভনীয় হওয়া উচিত ছিল।’ নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর অসুস্থতার কারণে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পারেননি। তাই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম।
অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণা করেন জুলাই অভ্যুত্থানে নিহত ইমনের মা কুলসুম বেগম, নিহত হাফিজুল সিকদারের শাশুড়ি নাছিমা বেগম, নিহত রায়হানের বাবা মো. মোজাম্মেল, আহত রিফাতের বাবা মো. রিয়াজ, আহত মো. আনিসুরের বাবা মো. শামসুদ্দীন, নিহত ইয়ামিনের বাবা মো. রতন, আহত রিফাত হাওলাদার, সাদ্দাম হোসেন, আহত খলিলুর রহমান প্রমুখ।
ছাত্র ফেডারেশন সভাপতি মিতু সরকারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ লেখক শিবিরের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মুঈনুদ্দীন আহমেদ, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এমএলএম) সাধারণ সম্পাদক আবদুল হাকিম ও বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন সহসভাপতি দীপা মল্লিক।