বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হবে না

রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সকাল থেকেই সারা দেশের যুবলীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা আসতে থাকেন।

যুবলীগের মহাসমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বাংলাদেশে ইনশা আল্লাহ কোনো দুর্ভিক্ষ হবে না। তার জন্য এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের অর্থনীতি এখনো যথেষ্ট শক্তিশালী। অনেকে বলেছিল শ্রীলঙ্কা হবে, এই হবে, সেই হবে, তাদের মুখে ছাই পড়েছে। সেটা হয়নি, ইনশা আল্লাহ হবেও না।’

গতকাল শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপন উপলক্ষে আয়োজিত মহাসমাবেশে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।

যুবলীগের ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বড় জমায়েতের লক্ষ্য নিয়ে বেশ কয়েক দিন ধরে প্রস্তুতি চলেছে। গতকাল ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশের কার্যক্রম শুরু হওয়ার কথা ছিল বেলা আড়াইটায়। কিন্তু সকাল থেকেই রাজধানীসহ সারা দেশ থেকে যুবলীগের নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসতে থাকেন। মূল সংগঠন আওয়ামী লীগও জমায়েতে অংশ নেয়।

একপর্যায়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশস্থলের বাইরে শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, মৎস্য ভবন, রমনাসহ আশপাশের এলাকা লোকে ভরে যায়। অনেকে দূরদূরান্ত থেকে বাস, ট্রাক, পিকআপ নিয়ে আসেন। সেগুলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরেও রাখতে দেখা গেছে। বরিশাল থেকে অনেকে লঞ্চে এসেছেন। সমাবেশে আসা ব্যক্তিদের অনেকেই জানান, তাঁদের যাত্রা শুরু হয়েছে আগের রাতে। সমাবেশকে কেন্দ্র করে গতকাল ছুটির দিনেও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় যানজট হয়।

মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগে যুবলীগের নেতাদের বক্তৃতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা পরিবেশনা চলে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমাবেশস্থলে পৌঁছান বেলা আড়াইটার দিকে। এরপর তিনি পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন।

সবার শেষে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের নেতা-কর্মীদের আশ্বস্ত করে বলেন, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা কেউ রুখতে পারবে না। তিনি বিরোধীদের সমালোচনার বিষয়ে বলেন, ‘ওরা যত কথাই বলুক, বিভ্রান্ত হবার কিছু নেই। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা এগিয়ে যাব।’

উন্নয়নের সমালোচকেরা চোখ থাকতে অন্ধ বলে মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ভূমিহীনেরা ঘর পেয়েছে। দেশে দরিদ্র মানুষ থাকবে না। বাংলাদেশ পারে। জাতির পিতার মতো তিনিও বিশ্বাস করেন বাংলাদেশকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।

রিজার্ভের টাকা দেশে বিনিয়োগ হয়েছে

রিজার্ভের টাকা খরচের ব্যাখ্যা দিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, ‘বাইরে থেকে সমস্ত ভোজ্যতেল আনতে হচ্ছে। করোনার কারণে দুটো বছর আমাদের কোনো শিল্প যন্ত্রপাতি আসেনি। দুই বছর পর সারা বিশ্ব উন্মুক্ত হওয়ার পর তা আসছে। আমাদের রিজার্ভ তো ব্যবহার করতে হবে। তার মধ্যে আমরা ৮ বিলিয়ন ডলার বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছি। রিজার্ভ জমিয়ে রাখলে তো হবে না। সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। বিভিন্নভাবে ব্যবহার করছি। সেটাও আমাদের মজুত।’

রিজার্ভ বিনিয়োগের তথ্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকার নিজেদের টাকায় বিমান কিনেছে। এর জন্য বিমানকে ঋণ দেওয়া হয়েছে। তারা ২ শতাংশ হারে সুদে সেই টাকা ফেরত দিচ্ছে। পায়রা নদী ড্রেজিং নিজেদের টাকায় করা হয়েছে। নইলে এ টাকা বিদেশি ব্যাংক থেকে নিতে হতো। তখন সুদসহ ডলার ফেরত দিতে হতো। আজ সরকার নিজেদের ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘নিজেদের রিজার্ভ থেকে ব্যবহার করেছি। ফলে ঘরের টাকা ঘরে থাকছে। সুদের টাকাও আমাদের ঘরে থাকছে। অপচয় হচ্ছে না। এভাবে আমরা টাকা আমাদের দেশের জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করছি।’

বিএনপির মুখে সমালোচনা শোভা পায় না

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এতিমের টাকা আত্মসাৎ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তাঁর (খালেদা) পরিবর্তে যাকে দিয়েছে, সে তো আরও এক ধাপ ওপরে। তারেক জিয়ার সাজা হয়েছে অর্থ পাচার মামলায়, ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা আর গ্রেনেড হামলার মামলায়। যাদের নেতা হচ্ছে খুন, অর্থ পাচার ও অবৈধ অস্ত্র চোরাকারবারি মামলার আসামি, তাদের মুখে আওয়ামী লীগের সমালোচনা শোভা পায় না।

খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের প্রতি ইঙ্গিত করে অষ্টম শ্রেণি পাস আর এসএসসি ফেল দিয়ে দেশ চললে সেই দেশের উন্নতি হয় না বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।

নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে সারা দেশের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কানাডার আদালত রায় দিয়েছেন পদ্মা সেতুতে কোনো দুর্নীতি হয়নি। কানাডার ফেডারেল কোর্টে আরেকটি রায় আছে—তা হলো বিএনপি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন।

বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘অর্থনীতিকে গতিশীল করা আমাদের লক্ষ্য। যারা ক্ষমতায় ছিল, দুর্নীতি, লুটপাট করে হাজার হাজার কোটি টাকা কামাই করে বিদেশে গিয়ে এখন নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করছে। বাংলাদেশের যে অগ্রযাত্রা, তা কেউ রুখতে পারবে না।’

যুবকদের দেশ গড়ায় মনোযোগী হতে হবে

করোনা সংক্রমণসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়ানোয় যুবলীগের প্রশংসা করেন আওয়ামী লীগের সভাপতি। রোগীর চিকিৎসা, লাশ দাফন, ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে সবকিছুতেই যুবলীগ উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছে। ঝড়-বন্যায় আওয়ামী লীগসহ সহযোগী সংগঠন মানবতার ডাকে ছুটে গেছে বলে জানান শেখ হাসিনা। যুবকদের দেশ গড়ার কাজে মনোযোগী হতে হবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তরুণের শক্তি, বাংলাদেশের সমৃদ্ধি। আমাদের দেশ ও দেশের মানুষের সেবা করতে হবে। সে জন্য যুবসমাজকে অনুরোধ করব—আমাদের পরনির্ভরশীল থাকলে হবে না। আত্মনির্ভরশীল হতে হবে।’

উপলক্ষ ছিল যুবলীগের সুবর্ণজয়ন্তী। এবার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনটি মহাসমাবেশে রূপ দেয় সংগঠনটি। গতকাল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

যুবলীগের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখানে আছেন বা বাইরে আছেন, সকলে নিজের গ্রামে যান। সেখানে কোনো জমি যেন অনাবাদি না থাকে, সেটা দেখতে হবে। নিজের জমি চাষ করতে হবে। অন্যের জমিও যেন উৎপাদনশীল হয়, সেই ব্যবস্থা প্রতিটি যুবলীগ কর্মীকে করতে হবে।’

দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে যুবসমাজকে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মাদক থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, এর জন্য যুবলীগের প্রতিটি নেতা-কর্মীকে অঙ্গীকার করতে হবে। সেভাবে কাজ করতে হবে।

প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যুবলীগের মহাসমাবেশে আসা নেতা–কর্মীদের বিএনপিকে জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বিএনপি আবার এলে গণতন্ত্র গিলে খাবে। দেশটাও গিলে খাওয়ার চেষ্টা করবে তারা।

যারা মনে করছে ধাক্কা দিলেই সরকার পড়ে যাবে, তারা ভুল করছে বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা আমির হোসেন আমু। তিনি বলেন, তাদের দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হবে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ সেলিম বলেন, বিএনপি ১০ ডিসেম্বর সরকার ফেলে দেবে বলে লাফালাফি করছে। তাদেরই পালিয়ে পাকিস্তানে যেতে হবে।

সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির সমাবেশের ইঙ্গিত করে বলেন, যুবলীগ প্রস্তুত আছে। কঠিন প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে।

মহাসমাবেশে যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ সভাপতিত্ব করেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান খান।

বর্ণাঢ্য জমায়েত

সমাবেশে যোগ দেওয়া নেতা-কর্মীদের পরনে ছিল নীল, সবুজ, হলুদসহ বাহারি রঙের টি-শার্ট ও টুপি। কেউ কেউ মাথায় বেঁধেছেন ব্যাজ। তাঁদের হাতে হাতে ছিল জাতীয় ও দলীয় পতাকা। বিভিন্ন ধরনের ব্যানার ও পোস্টারেও ছেয়ে যায় উদ্যান ও তার আশপাশ এলাকা। নেতা-কর্মীরা স্লোগানে, করতালিতে, বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে সমাবেশস্থল মুখর করে রাখেন। নেতা-কর্মীদের জন্য খাবার ও পানির ব্যবস্থাও ছিল সমাবেশস্থলে। ক্যাসিনো–কাণ্ডে আলোচিত সাবেক যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটেরও পোস্টার দেখা যায়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সমাবেশ–সংলগ্ন এলাকার মোড়ে মোড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাড়তি উপস্থিতি দেখা গেছে।

প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে যুবলীগের ইতিহাস তুলে ধরে নৃত্য আলেখ্য পরিবেশন করা হয়। সংসদ সদস্য মমতাজ ও শিল্পী পান্থ কানাই শেখ হাসিনাকে নিয়ে গান পরিবেশন করেন।