১৯৭১: তরুণের চোখে

একই অধিকারের স্বপ্ন আমাদের

অঞ্জলি আগস্টিনা
অঞ্জলি আগস্টিনা

ধনী-গরিব, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, বাঙালি-আদিবাসী—১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সবার মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধিকার ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সবার ত্যাগের পাল্লা ছিল একই। শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হাতিয়ার হিসেবে যাঁরা তির-ধনুক, বল্লম, লাঠিও হাতে তুলে নিয়েছিলেন, তাঁদেরও আকাঙ্ক্ষা ছিল স্বাধীনতা। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর এসে আজও ভাবতে হচ্ছে, কতটা স্বাধীন আসলে আমরা হয়েছিলাম? স্বাধীন রাষ্ট্রের ওপর কতটা আস্থা-প্রত্যাশা গড়ে তুলতে পেরেছি আমরা? প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির অঙ্কের ফল তো তীব্র অসমতা। শাসকের ক্ষমতার রদবদলের সঙ্গে সঙ্গে বারবার বদলেছে স্বাধীনতার সংজ্ঞা, বদলেছে ইতিহাস।

বাংলাদেশে ৪৫ থেকে ৫০টি আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসীদের অসামান্য ত্যাগ আর অবদানের কথা এ দেশের কতজন মানুষ জানে? বইপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে নানা ধ্যানধারণা পাওয়া গেলেও প্রতিষ্ঠিত কিছু রাজনৈতিক দল ছাড়া অন্য কারও গল্প লেখা হয়নি কখনো।

বৃহত্তর রাজশাহী ও রংপুরজুড়ে হাজারো ভূমিপুত্র আদিবাসীর বসবাস। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের পর এতটা বছর পেরিয়ে গেলেও নিজ ভূমি বাঁচাতেই সংগ্রাম করে চলেছে তারা। এই ২০২৪ সালে এসেও পরিচয় নিয়ে তাদের সংকট কাটেনি? অথচ বাংলাদেশ স্বাধীন করার পেছনে অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, সব জাতির আত্মপরিচয় স্বমহিমায় প্রকাশ করতে পারার অধিকার। অথচ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দলিল সংবিধানে আদিবাসীদের ক্ষুদ্র জাতি, সংখ্যালঘু বা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মতো নেতিবাচক শব্দ ব্যবহার করা হলো। দেশবাসীর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হলো। আদিবাসীরা চিহ্নিত হলো পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী হিসেবে। আপনি যখন কাউকে পিছিয়ে পড়া বলে চিহ্নিত করবেন, তখনই তাদের বাড়তি সুবিধার প্রয়োজন হবে। সেই বাড়তি সুবিধার প্রয়োজন কেন স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও ঘুচল না?

কোনো দেশে বৈষম্যহীনভাবে সব জাতিকে একই গতিতে এগোতে দিলে তো সুনির্দিষ্ট কোনো জাতির বাড়তি সুবিধার প্রয়োজনই হয় না। প্রয়োজন হয় কেবল সমান সুযোগ আর সুষ্ঠু পরিচর্যার। আদিবাসীদের ভাষা সংরক্ষণ, ভূমির অধিকার রক্ষা, পাঠ্যবইয়ে নিজস্ব ভাষায় পাঠদানের ব্যবস্থা, বৈচিত্র্যময় জীবনযাপনের সঙ্গে মূলধারার জনগোষ্ঠীর পরিচয়, উন্নত জীবনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি মুক্তিযুদ্ধে পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৩ বছরেও।

উপরন্তু এসেছে নতুন এক বিপদ। আধুনিক সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে তরুণ আদিবাসীরা হারাতে বসেছেন নিজেদের সত্তা ও সংস্কৃতিকে। গ্রহণযোগ্য হতে না পারার আশঙ্কায় অনেকে নিজেদের আদিবাসী বলে পরিচয় দিতেও কুণ্ঠা বোধ করেন। ভূমি সংরক্ষণে এবং ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চার পূর্ণাঙ্গ বিকাশে যথাযথ সরকারি পদক্ষেপ না থাকায় আদিবাসীদের অবস্থা দিন দিন নাজুক থেকে নাজুকতর হচ্ছে।

জাতি, ধর্ম, বর্ণের বিভিন্নতাকে বাদ দিয়ে কখনোই একাত্তরে মুক্তি সম্ভব ছিল না। হাজারো বৈচিত্র্যের মধ্য দিয়ে মানুষে মানুষে সম্প্রীতির সম্পর্ক, সুস্থ রাজনৈতিক চর্চা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আক্ষরিক অর্থে নয় প্রকৃতপক্ষেই স্বাধীন বিচার বিভাগ, মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা—এই সবকিছু বৈষম্যহীনভাবে অনুশীলন করার পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা কি আসলেও আমরা অর্জন করতে পেরেছি? এমন একটা কথা আছে যে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। তাহলে কি স্বাধীনতার স্বাদ পেতে না পেতেই আরেক অদৃশ্য পরাধীনতার শিকলে বাঁধা পড়েছে মানুষ, আদিবাসী জনগোষ্ঠীরাও? আদিবাসীদের জাতিগত পরিচয় পর্যবসিত হলো তুচ্ছতাচ্ছিল্য, উপহাস বা গালিগালাজের বস্তুতে।

আদিবাসী জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর হিসেবে মতপ্রকাশের পূর্ণ অধিকার নিয়ে নীতিনির্ধারক বা চিন্তাশীল নাগরিকদের চিন্তাচেতনার প্রতিফলন পাব বলে বিশ্বাস করি। ২০২৪ সালে দাঁড়িয়ে একজন স্বপ্নবান তরুণ হিসেবে বৈষম্যহীন এক সমাজের স্বপ্ন দেখি, যেখানে এক সমতলে প্রতিষ্ঠিত হবে আদিবাসীদের কণ্ঠস্বর, আত্মত্যাগ, সাংবিধানিক স্বীকৃতি আর ভূমির অধিকার।

  • অঞ্জলি আগস্টিনা সরেন: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস