ছয়টি প্রতিষ্ঠান টাকা না দিয়ে উধাও হয়ে গেছে। তিনটি আওয়ামী লীগ নেতাদের মালিকানাধীন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর দলের নেতাদের কেউ কেউ টেলিযোগাযোগ খাতে ব্যবসায় নামেন। নারায়ণগঞ্জের আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান নেমেছিলেন বিদেশ থেকে টেলিফোন কল আনার ব্যবসায়।
শামীম ওসমান ২০১২ সালে স্ত্রী সালমা ওসমান ও ছেলে ইমতিনান ওসমানের নামে কে টেলিকম লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান খুলে আন্তর্জাতিক গেটওয়ে বা আইজিডব্লিউ লাইসেন্স নেন, যার মাধ্যমে বিদেশ থেকে টেলিফোন কল আসত। কে টেলিকমের কাছে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) পাওনা দাঁড়িয়েছিল ১২৬ কোটি টাকা। সেই টাকা তারা পরিশোধ করেনি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর শামীম ওসমানের পরিবার আত্মগোপনে চলে গেছে। ফলে সরকারের টাকা আদায় একেবারেই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
শুধু শামীম ওসমান নয়, বিটিআরসি দ্বাদশ সংসদের ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুর ছেলে আসিফ শামস ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের পরিবারের প্রতিষ্ঠানসহ ছয়টি আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠানের কাছে ৯২১ কোটি টাকা পাবে। বিটিআরসি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে মামলা করেছে। তবে টাকা আদায় করতে পারেনি।
বিটিআরসির আগের প্রশাসনের বিরুদ্ধে টাকা আদায়ে জোর তৎপরতা না থাকা এবং মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়ার ক্ষেত্রে ঢিলেমির অভিযোগ ছিল। সংস্থাটির কমিশনার (অর্থ, হিসাব ও রাজস্ব বিভাগ) মুশফিক মান্নান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী বিটিআরসি এখন কাজ করবে।
দেশের বাইরে থেকে করা (আন্তর্জাতিক ইনকামিং) কলগুলো আইজিডব্লিউ অপারেটরের মাধ্যমে দেশে প্রবেশ করে। নীতিমালা অনুসারে, আন্তর্জাতিক কলের আয় থেকে ৪০ শতাংশ অর্থ বিটিআরসিকে দিতে হয়। যদিও ছয়টি প্রতিষ্ঠান সেই টাকা দেয়নি।
দেশে মোবাইল ইন্টারনেটের ব্যবহার বৃদ্ধির আগে আন্তর্জাতিক কলসংখ্যা অনেক বেশি ছিল। আইজিডব্লিউ ব্যবসায়ীরা বলছেন, ২০১৫ সালেও দেশে প্রতিদিন ১০ কোটি মিনিট কল আসত। এখন অবশ্য তা প্রায় দেড় কোটি মিনিটে নেমে এসেছে। কারণ হলো, মানুষ এখন হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, সিগন্যাল, টেলিগ্রাম ইত্যাদি ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে কথা বলেন। তবু এখন ২৪টি আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, পাওনা না দেওয়া ৬টি প্রতিষ্ঠানের ৫টি ২০১২ সালের এপ্রিলে লাইসেন্স নেয়। আরেকটি লাইসেন্স পায় একই বছরের অক্টোবরে। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে তারা ব্যবসা গুটিয়ে নেয়। ২০১৫ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে তাদের লাইসেন্স বাতিল করে বিটিআরসি। এসব প্রতিষ্ঠান রাজস্ব ভাগাভাগি বাবদ প্রায় ৬০৯ কোটি টাকা, লাইসেন্স ফি বাবদ ৭৩ কোটি টাকা, মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) বাবদ ১২ কোটি টাকা এবং বিলম্ব মাশুল বাবদ ২২৭ কোটি টাকা পরিশোধ করেনি।
বিটিআরসি ও আইজিডব্লিউ খাতের সূত্র বলছে, এই ছয় প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্যই ছিল অল্প সময়ে বড় অঙ্কের অর্থ আয় করে চলে যাওয়া। দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবসা করা তাদের লক্ষ্য ছিল না। এ কারণে তখন কম খরচে কল এনে তারা বিপুল অর্থ আয় করে। সেখান থেকে বিটিআরসির পাওনা ও লাইসেন্স ফি না দিয়ে তারা চলে যায়।
বিটিআরসি এবং যৌথ মূলধনী কোম্পানি ফার্মসমূহের পরিদপ্তর (আরজেএসসি) সূত্র জানিয়েছে, জাহাঙ্গীর কবির নানকের মেয়ে সৈয়দা আমরিন আঁখি ও স্ত্রী সৈয়দা আরজুমান্দ বানুর নামে রাতুল টেলিকমের লাইসেন্স নেওয়া হয়েছিল। বিটিআরসি তাঁদের কাছে ১৩০ কোটি ৪০ লাখ টাকা পায়।
শামসুল হক টুকুর ছেলে ও পাবনার বেড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র এস এম আসিফ শামসের প্রতিষ্ঠান ভিশন টেলের কাছে ২৩৫ কোটি ৫৪ লাখ টাকা পাবে বিটিআরসি। শামস ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাঁর অংশীদারত্ব প্রত্যাহার করেন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) জানিয়েছিল, ভিশন টেলের মালিকানায় ছিলেন অনলাইন প্রতারণার ঘটনায় আলোচিত রিং আইডির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরিফুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী আইরিন ইসলামও।
শামীম ওসমানের স্ত্রী সালমা ওসমান ও পুত্র ইমতিনান ওসমানের নামে থাকা কে টেলিকমের মালিকানা পরিবর্তন করা হয় ২০১৩ সালের আগস্টে। নতুন মালিক হন মো. সাখাওয়াত হোসেন, দেবব্রত চৌধুরী ও মো. রকিবুল ইসলাম। এই তিন ব্যক্তির কোনো খোঁজ বিটিআরসি পায়নি।
টেলেক্স লিমিটেড নামের আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠানের কাছে ১১৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা পাওনা বিটিআরসির। আরজেএসসি সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আবদুর রহমান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান। তাঁদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা যায়নি।
অ্যাপল গ্লোবালটেল কমিউনিকেশনসের কাছ থেকে ১১৮ কোটি ১৪ লাখ টাকা পাবে বিটিআরসি। আরজেএসসি থেকে ৮ সেপ্টেম্বর জানা যায়, অ্যাপল গ্লোবালটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহিউদ্দিন মজুমদার। পরিচালক হিসেবে রয়েছেন ফারহানা জাফর, মো. জাবেদ আলী, মো. নাসির উদ্দিন ও মো. নূর হোসেন। তাঁদের সম্পর্কেও বিস্তারিত জানা যায়নি।
বিটিআরসি ১৯৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা পাবে বেস্টটেক টেলিকম নামের একটি আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠানের কাছে। এর মালিক মো. তারিকুল ইসলাম, এনায়েত কবির ও মো. মামুন-উর-রশিদ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বিস্তারিত জানেন না।
আইজিডব্লিউগুলোর আয়ের একটি অংশ মোবাইল অপারেটররাও পায়। এই ছয় প্রতিষ্ঠান মোবাইল অপারেটরদের টাকাও দেয়নি। ৪ অপারেটর পাবে ৩২০ কোটি টাকা।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, কর্তৃত্ববাদী সরকার বিটিআরসির মতো কমিশনকেও করায়ত্ত করেছে এবং ক্ষমতা খর্ব করেছে। পটপরিবর্তনের সুযোগে বিটিআরসিকে এসব বিষয়ে শক্ত ভূমিকা নিতে হবে। এমনকি এ ধরনের অনিয়মে বিটিআরসির কেউ জড়িত থাকলে তাদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে।