গত শতকের সত্তরের দশকে জিনিসপত্রের দাম যখন চড়চড় করে বাড়ছিল, সেই সময় বগুড়ার শেরপুরের বিখ্যাত দইয়ের দাম ১ টাকা ২৫ পয়সা থেকে একলাফে ৫ টাকায় ওঠে। দইয়ের স্বাদ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। তখন এ নিয়ে গান বেঁধেছিলেন বগুড়ার বিখ্যাত গানের দল বগুড়া ইয়ুথ কয়্যারের শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার তৌফিকুল আলম টিপু। গানের কথা—‘গোবরা তুই খ্যায়া যা শেরপুরের দই, পাঁচ শিকা আছলো এখন পাঁচ টেকায় লই।’
বগুড়ার বিখ্যাত সেই সরার দই এবার পেল ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি। শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের (ডিপিডিটি) ২৫ জুন এ অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই দিন বগুড়ার দই ছাড়া জিআই স্বীকৃতি পাওয়া অন্য পণ্যগুলো হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জের ল্যাংড়া ও আশ্বিনা আম। এ নিয়ে দেশের ১৫টি পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেল।
কোনো একটি দেশের নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মাটি, পানি, আবহাওয়ার প্রেক্ষাপটে সেখানকার জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাহলে সেটিকে সেই দেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। দেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে নিবন্ধন পায় জামদানি।
এরপর একে একে স্বীকৃতি পায় ইলিশ, ক্ষীরশাপাতি আম, মসলিন, বাগদা চিংড়ি, কালিজিরা চাল, বিজয়পুরের সাদা মাটি, রাজশাহীর সিল্ক, রংপুরের শতরঞ্জি, দিনাজপুরের কাটারিভোগ চাল, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম। নতুন করে এ তালিকায় যুক্ত হলো বগুড়ার দইসহ চার পণ্য। এখন থেকে এসব পণ্য বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পাবে।
ডিপিডিটির ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. জিল্লুর রহমান আজ বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, বগুড়া রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির আবেদন পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যাচাই-বাছাই শেষে ২৬ জুন দই ছাড়াও তিনটিকে জিআই পণ্য হিসেবে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
জিল্লুর রহমান বলেন, কোনো পণ্যের জিআই স্বীকৃতির আবেদন এলে তা যাচাই-বাছাই করে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। এরপর দুই মাস সময় দেওয়া, এ নিয়ে কারও কোনো আপত্তি আছে কি না। আপত্তি না থাকলে ওই পণ্যের স্বীকৃতি দিয়ে দেওয়া হয়। বগুড়ার দইয়ের ক্ষেত্রেও কেউ কোনো আপত্তি তোলেনি। তাই এর স্বীকৃতি মিলেছে।
বগুড়ার দইয়ের জিআই পণ্যের স্বীকৃতির জন্য বগুড়া রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি তাদের আবেদনে এর ইতিহাস তুলে ধরে। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশের অন্যান্য জেলা কিংবা অঞ্চলে দই উৎপাদিত হলেও কিছু বিশেষত্বের কারণে ‘বগুড়ার দই’-এর খ্যাতি দেশজুড়ে।
উৎপাদনব্যবস্থার প্রতিটি পর্যায়ে কারিগরদের (উৎপাদক) বিশেষ পদ্ধতি অনুসরণের পাশাপাশি মান নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তারা যত্নবান হওয়ায় বগুড়ার দই স্বাদে-গুণে তুলনাহীন। প্রায় ১৫০ বছর আগে বগুড়ার শেরপুর উপজেলার ঘোষ পরিবারের হাত ধরে বগুড়ার দইয়ের উৎপাদন শুরু হয়। শেরপুরে দই তৈরির প্রবর্তক ঘোষপাড়ার নীলকণ্ঠ ঘোষ।
পরবর্তী সময়ে বগুড়ার নওয়াব আলতাফ আলী চৌধুরীর (পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীর বাবা) পৃষ্ঠপোষকতায় শেরপুরের ঘোষপাড়ার অন্যতম বাসিন্দা শ্রী গৌর গোপাল পাল বগুড়া শহরে দই উৎপাদন শুরু করেন। বর্তমানে নওয়াববাড়ি রোডে তাঁর উত্তরসূরি দুই সন্তান শ্রী বিমল চন্দ্র পাল ও শ্রী স্বপন চন্দ্র পাল ‘শ্রী গৌর গোপাল দধি ও মিষ্টান্ন ভান্ডার’ নামে সেই প্রাচীন দোকানটি চালু রেখেছেন।
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী তৎকালীন পার্লামেন্ট সদস্যদের দই খাইয়ে বাহবা পেয়েছিলেন বলে শ্রী স্বপন চন্দ্র পাল তাঁর দাদুর মুখে শুনেছেন।
বিদেশে বগুড়ার দইয়ের খ্যাতি প্রথম ১৯৩৮ সালে ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়ে। ওই বছরের গোড়ার দিকে তৎকালীন বাংলার ব্রিটিশ গভর্নর স্যার জন এন্ডারসন বগুড়া নওয়াববাড়িতে বেড়াতে এসে প্রথম দইয়ের স্বাদ গ্রহণ করেন।
তাঁকে কাচের পাত্রে তৈরি করা বিশেষ ধরনের দই খেতে দেওয়া হয়। লোভনীয় স্বাদের কারণে গভর্নর এন্ডারসন বগুড়ার দই ইংল্যান্ডে নেওয়ার পরিকল্পনা করেন।
আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ববিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল প্রপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) নিয়ম মেনে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিপিডিটি জিআই পণ্যের স্বীকৃতি ও সনদ দিয়ে থাকে। ২০১৩ সালে ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন হয়। ২০১৫ সালে আইনের বিধিমালা তৈরির পর জিআই পণ্যের নিবন্ধন নিতে আহ্বান জানায় ডিপিডিটি।
কোনো পণ্যের জিআই স্বীকৃতির অন্তত দুটো তাৎপর্য আছে। ডিপিডিটির ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. জিল্লুর রহমান বলেন, প্রথম গুরুত্ব হলো এর মাধ্যমে কোনো পণ্য কোনো নির্দিষ্ট এলাকার বলে চিহ্নিত হয়। এর বৈশ্বিক স্বীকৃতি মেলে। দ্বিতীয় গুরুত্ব হলো, এর মাধ্যমে পণ্যটির বাণিজ্যিকীকরণের সুবিধা হয়। পণ্যটি যখন বাইরের দেশে পাঠানো হয়, তখন জিআই স্বীকৃতি পণ্যের মান ও দাম নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে।