টানা চতুর্থ দিনের মতো জলাবদ্ধতার কবলে চট্টগ্রামবাসী

টানা চতুর্থ দিনের মতো চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা গেছে
ছবি: প্রথম আলো

চট্টগ্রাম নগরের চকবাজার এলাকার মুহাম্মদ আলী শাহ লেনের বাসিন্দা আবদুল হামিদ। একটি দোতলা ভবনের নিচতলায় মা, বাবা, দুই মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন তিনি। চার দিন ধরে তাঁর বাসায় পানি জমে আছে। এতে পরিবারটি চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।

বৃষ্টি থেকে জলাবদ্ধতার এই দুর্ভোগের কথা বলতে গিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, গত শুক্রবার থেকে ভোগান্তি শুরু। এখনো চলছে। শুক্রবার সন্ধ্যার পর পানি নেমে গিয়েছিল।

কিন্তু গত শনিবার থেকে আজ সোমবার সকাল পর্যন্ত পানি আর নামেনি। বৃষ্টি থামলে পানি কিছুটা কমে। বৃষ্টি শুরু হলে পানি আবার বেড়ে যায়। জলাবদ্ধতার কারণে তাঁর বাসায় রান্নাবান্না বন্ধ আছে। শুকনা খাবার খাচ্ছেন। এ ছাড়া আত্মীয়স্বজনের পাঠানো খাবার দিয়ে দিন পার করছেন তাঁরা।\

ভারী বৃষ্টির কারণে গত শুক্রবার থেকে চট্টগ্রাম নগরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। গতকাল রোববার সারা রাত থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। এতে আজ টানা চতুর্থ দিনের মতো নগরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা গেছে। নগরের রাস্তাঘাট, অলিগলি ও বসতবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে।

চট্টগ্রাম নগরের যেসব ওয়ার্ডে সবচেয়ে বেশি জলাবদ্ধতা দেখা যায়, তার একটি চকবাজার। এই ওয়ার্ডের অধিকাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। গত তিন দিনের মতো আজ সকালেও চক সুপারমার্কেট, চকবাজার কাঁচাবাজার এলাকা পানিতে ডুবে থাকতে দেখা যায়। চারপাশের সড়কে প্রায় কোমরসমান পানি। ওয়ার্ডের অলিগলিতেও একই অবস্থা।

জলাবদ্ধতায় ভোগান্তির কথা জানিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, বাকলিয়ার ডিসি সড়কে তাঁর কর্মস্থল (কাজী অফিস)। সেখানেও পানি জমে রয়েছে। এই কারণে অফিসে যেতে পারছেন না। আয়রোজগার বন্ধ আছে। বাড়ির সামনের রাস্তাঘাট ডুবে থাকায় দুই মেয়েকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে পারছেন না। তাদের গৃহশিক্ষকও আসছেন না।

রাস্তাঘাট হাঁটু থেকে কোমরসমান পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় নগরবাসী ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। জরুরি প্রয়োজনে যাঁরা বের হচ্ছেন, তাঁদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

অনেক এলাকার নিচতলার বসতঘরে পানি জমে থাকায় রান্নার চুলা জ্বালাতে পারছেন না ভুক্তভোগী বাসিন্দারা। অভিভাবকেরা সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে পারছেন না। অনেকে কর্মস্থলে যেতে পারছেন না।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সকাল ৯টা থেকে আজ সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ২৫০ মিলিমিটার বৃষ্টির রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে আজ সকাল ৬টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টায় ২২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।

নগরের চকবাজার এলাকার ওমর আলী মাতব্বর সড়ক এলাকার বাসিন্দা মারুফ হাসান বলেন, চার দিন ধরে তাঁদের বাসার সামনে পানি জমে রয়েছে। এ কারণে ঘর থেকে বের হওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। তিনি মনে করেন, নালা-নর্দমাগুলো পরিষ্কার করলে অন্তত পানি নেমে যেত। তাহলে আর এই দুর্ভোগ পোহাতে হতো না।

নগরের বাকলিয়ার বিএড কলেজ এলাকার বাসিন্দা জয় বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের এলাকায় এখনো পানি কমেনি, বরং রাতের বৃষ্টিতে তা বেড়েছে। এভাবে জলাবদ্ধতা হওয়ায় অসহনীয় ভোগান্তি পোহাচ্ছেন তাঁরা। অফিসে যেতে কষ্ট হচ্ছে। বাজার-সদাই করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এই দুর্ভোগ থেকে কবে মুক্তি মিলবে, সে ব্যাপারে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কেউ কিছু বলতে পারছেন না।

আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকার ২৫ নম্বর রোডের বাসিন্দা মো. জামাল উদ্দিন বলেন, গতকাল সড়কে হাঁটুর ওপরে পানি ছিল। রাতের বৃষ্টিতে ভবনের নিচতলায় পানি ঢুকেছে। মূল গেটের অর্ধেক পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

যেসব এলাকায় জলাবদ্ধতা

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, এবার নগরের অন্তত ৪০ শতাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। জলাবদ্ধতার কারণে এসব এলাকার অন্তত ১৫ লাখ মানুষ দুর্ভোগে পড়েছেন।

এবার নগরের বহদ্দারহাট, চান্দগাঁও, মুরাদপুর, শুলকবহর, খাজা রোড, খতিবের হাট, রাহাত্তরপুল, মিয়া খান নগর, কে বি আমান আলী সড়ক, সৈয়দ শাহ সড়ক, বারইপাড়া, মৌলভীপুকুর পাড়, চকবাজার, ডিসি সড়ক, কাপাসগোলা, কাতালগঞ্জ, আল ফালাহ গলি, পূর্ব বাকলিয়ার পুলিশ বিট, মাজার গেট, বড় কবরস্থান, খরমপাড়া, ফুলতলা, ঘাসিয়াপাড়া, চেয়ারম্যানঘাটা, বাংলা কলেজ, জে এম সেন হল এলাকা, পাঠানিয়া গোদা, সানোয়ারা আবাসিক, ফরিদারপাড়া, শমসেরপাড়া, হালিশহরের এল ব্লক, শ্যামলী আবাসিক এলাকা, হালিশহর পুলিশ লাইন, হালিশহর শাপলা আবাসিক এলাকা, শান্তিবাগ আবাসিক এলাকা, আনন্দবাজার, হাজীপাড়া, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, ঈশান মিস্ত্রির হাট, অক্সিজেন এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা গেছে। এসব এলাকার রাস্তাঘাট, অলিগলি—এমনকি ঘরের ভেতরেও পানি উঠেছে।

জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশনের একটি, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) দুটি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি প্রকল্পের আওতায় ১১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকার কাজ চলছে।

গত ৬ বছরে ৫ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা ব্যয়ের পরও সুফল পাচ্ছেন না নগরবাসী। আগামী বছরের জুনে এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না। প্রকল্পগুলোর মেয়াদ আরও বাড়ানো হবে বলে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাবিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও কাউন্সিলর মো. মোবারক আলী প্রথম আলোকে বলেন, আজকেও বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। জোয়ারের প্রভাবে এবার জলাবদ্ধতা প্রকট হয়েছে। এরপরও কোথাও পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে কি না, তা চিহ্নিত করতে, পানিপ্রবাহের প্রতিবন্ধকতা থাকলে তা অপসারণে ওয়ার্ড পর্যায়ে সিটি করপোরেশনের কর্মীরা কাজ করছেন।