বিটিসিএলের একটি প্রকল্পে সরঞ্জাম সরবরাহের দরপত্র বাতিল নিয়ে বিরোধে জড়িয়েছেন টেলিযোগাযোগমন্ত্রী ও সচিব।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকার একটি প্রকল্পে সরঞ্জাম সরবরাহকারী নিয়োগের দরপত্র বাতিল নিয়ে বিরোধে জড়িয়েছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এবং একই মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান।
বিটিসিএল সূত্র বলছে, মন্ত্রী চান ‘সঠিক যন্ত্রপাতি’ সরবরাহকারী নিয়োগে নতুন করে দরপত্র আহ্বান করতে। আর সচিব চান আগে ডাকা দরপত্র অনুযায়ী কাজ দিতে।
মন্ত্রী ও সচিবের বিরোধের মধ্যে বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামান চৌধুরীকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এই পদে (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) ছিলেন।
যতটুকু জানতে পেরেছি, ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক চালু করতে ২০১৫ সালের পুরোনো মডেলের যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে। ২০২৩ সালে এসে যেখানে আমরা সামনে অগ্রসর হব, সেখানে পুরোনো মডেলের যন্ত্রপাতি কেন কেনা হচ্ছে।মোস্তাফা জব্বার, টেলিযোগাযোগমন্ত্রী
এই সরঞ্জাম সরবরাহে ২০২২ সালের ১৪ আগস্ট দরপত্র আহ্বান করা হলেও এখনো কাজ দেওয়া সম্ভব হয়নি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগ, যেসব যন্ত্রপাতি কেনার প্রক্রিয়া চলছে, তা দরপত্রের শর্ত পূরণ করে না। ফলে সরকারের সরঞ্জাম কেনা বাবদ ৪৬৩ কোটি টাকা গচ্চা যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফাইভ–জি নেটওয়ার্ক চালু করতে দেরি হওয়া আমার পছন্দ হচ্ছে না। কেন দেরি হচ্ছে, তা সচিবকে জিজ্ঞেস করেন।’ সরঞ্জাম সরবরাহ নিয়ে নতুন করে দরপত্র আহ্বানের পক্ষে নিজের অবস্থানের কথা জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে সরিয়ে দেওয়ার সময় তাঁকে জানানো হয়নি।
টেলিযোগাযোগসচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান মন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়ে মন্তব্য করা সমীচীন বলে মনে করেন না। তিনি বলেন, বিটিসিএলের বোর্ড চেয়ারম্যান তিনি। শুধু চেয়ারম্যানের একার কিছু করার নেই। বোর্ডই সিদ্ধান্ত নেয়।
টেলিযোগাযোগ বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, উচ্চ গতির ইন্টারনেট–সেবা ফাইভ–জি উপযোগী অপটিক্যাল ফাইবার (বিশেষ তার) বসানোর উদ্যোগ নিয়ে প্রকল্প নেওয়া হয় ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এর মাধ্যমে জেলা ও উপজেলাকে অপটিক্যাল ফাইবার সংযোগের আওতায় আনার কথা। প্রকল্পের মোট ব্যয় ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা। সরঞ্জাম কেনার ব্যয় ৪৬৩ কোটি টাকা।
টেলিযোগাযোগসচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান মন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়ে মন্তব্য করা সমীচীন বলে মনে করেন না। তিনি বলেন, বিটিসিএলের বোর্ড চেয়ারম্যান তিনি। শুধু চেয়ারম্যানের একার কিছু করার নেই। বোর্ডই সিদ্ধান্ত নেয়।
সরঞ্জাম কেনার দরপত্রে প্রস্তাব দাখিল করে তিনটি কোম্পানি জেডটিই করপোরেশন, হুয়াওয়ে টেকনোলজিস লিমিটেড ও নকিয়া সলিউশন। তাদের সবাইকে যোগ্য হিসেবে মূল্যায়ন করে সাত সদস্যের কারিগরি কমিটি। অভিযোগ রয়েছে, তিন প্রতিষ্ঠানের কেউ দরপত্রের শর্ত পূরণ করতে পারেনি। তারপরও কারিগরি কমিটি তাদের যোগ্য ঘোষণা করে।
নথিপত্র বলছে, দরপত্র দলিলের শর্ত ভেঙে তিনটি কোম্পানিকে কেন কারিগরিভাবে যোগ্য বলা হলো, তা মূল্যায়ন কমিটির কাছে জানতে চান বিটিসিএলের তখনকার ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামান চৌধুরী। যে ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, তা সন্তোষজনক মনে হয়নি তাঁর কাছে। যেমন দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির ব্যাখ্যা ছিল, সনদে না থাকলেও নকিয়ার ওয়েবসাইটের তথ্যের ভিত্তিতে তাদের যোগ্য বলে গণ্য করা হয়েছে। অথচ দরপত্রে জমা দেওয়া নথির বাইরের তথ্যের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করার কোনো সুযোগ নেই।
ব্যাখ্যাতে আরও দেখা গেছে, হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে সনদ যাচাই করেছেন মূল্যায়ন কমিটির বাইরের এক কর্মকর্তা। অথচ আইনে দরপত্রের কোনো তথ্য মূল্যায়ন কমিটির বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। নথিপত্র বলছে, দরপত্রে ৪০০ গিগাবাইট লাইন ক্ষমতার যন্ত্রপাতি সরবরাহের অভিজ্ঞতার অন্তত একটি সনদ দেওয়ার কথা। সনদে ৪০০ গিগাবাইট উল্লেখ না থাকলে তা গ্রহণ করাই হবে না, এমন সতর্কতাও দেওয়া হয়। অথচ নকিয়ার সনদ ১০০ গিগাবাইট/২০০ গিগাবাইট ক্ষমতার যন্ত্রের। তবু মূল্যায়ন কমিটি তাদের কারিগরিভাবে যোগ্য ঘোষণা করে।
নথিতে দেখা যায়, সরকারি ক্রয় আইনে দেওয়া ক্ষমতা অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমন অবৈধ কারিগরি মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুমোদনে অস্বীকৃতি জানান এবং আবার দরপত্র ডাকার নির্দেশ দেন।
আরেকটি অভিযোগ হলো, মূল্যায়নের সময় অটোমেটিক্যালি সুইচড অপটিক্যাল নেটওয়ার্ক (এসন) সক্ষমতা নির্ণয়ে সব পথ পরীক্ষার পরিবর্তে মাত্র ৪ পথে নিরবচ্ছিন্নতার প্রমাণই যথেষ্ট বলে শর্ত সহজ করে দেওয়া হয়। মূল্যায়নে তিন প্রতিষ্ঠানের যন্ত্রপাতি সে যোগ্যতাও প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। তিনটি পথের পর আর কাজ করেনি। কিন্তু সবাইকে কারিগরি-যোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে।
নথিতে দেখা যায়, সরকারি ক্রয় আইনে দেওয়া ক্ষমতা অনুযায়ী ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমন অবৈধ কারিগরি মূল্যায়ন প্রতিবেদন অনুমোদনে অস্বীকৃতি জানান এবং আবার দরপত্র ডাকার নির্দেশ দেন।
বিটিসিএল গত ১৩ জুন তিনটি কোম্পানিকে লিখিতভাবে দরপত্র বাতিলের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়। ১৯ জুন টেলিযোগাযোগ বিভাগের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি পর্যালোচনা সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে দরপত্র নতুন করে আহ্বান করতে হবে। এর মধ্যেই মূল্যায়ন প্রতিবেদন কবে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে এসেছে, তা উল্লেখ করে প্রতিবেদন অনুমোদনে দেরি করায় বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিরুদ্ধে গত ১৬ মে চিঠি দেয় হুয়াওয়ে। গোপনীয় তথ্য জোগাড় করে অবৈধভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করার চেষ্টার অভিযোগে শাস্তির প্রথম ধাপ হিসেবে ২৭ আগস্ট হুয়াওয়েকে চিঠি দেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
হুয়াওয়ে রিভিউ প্যানেলে এই শাস্তির চিঠির বিরুদ্ধে রিভিউ (পুনর্মূল্যায়ন) আবেদন করে। সিপিটিইউ এই শাস্তির চিঠি অকার্যকর বলে আদেশ দেয়। সঙ্গে আবেদন ছাড়াই তিন কোম্পানিকে যোগ্য এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালককে শাস্তির আদেশ যোগ করে চিঠি দেয়।
যতটুকু জানতে পেরেছি ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক চালু করতে ২০১৫ সালের পুরোনো মডেলের যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে। ২০২৩ সালে এসে যেখানে আমরা সামনে অগ্রসর হব, সেখানে পুরোনো মডেলের যন্ত্রপাতি কেন কেনা হচ্ছে।টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার
এমন পরিস্থিতিতে দরপত্রের বাণিজ্যিক প্রস্তাব খোলা হয়নি। ১৮ অক্টোবর ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদুজ্জামানকে সরিয়ে দেওয়া হয়। বিষয়টি আদালতেও গড়িয়েছে।
টেলিযোগাযোগসচিব আবু হেনা মোরশেদ জামান প্রথম আলোকে বলেন, বিটিসিএলের বোর্ডের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে আসাদুজ্জামান চৌধুরীকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব থেকে সরানো হয়েছে।
নথিপত্র ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, টেলিযোগাযোগ যন্ত্রপাতির আয়ুষ্কাল ৭ থেকে ৮ বছর, যা দরপত্রেও বলা রয়েছে। অর্থাৎ যন্ত্রপাতির ব্যবহারযোগ্য কার্যকাল ২০৩০ সালে শেষ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) হিসাবে, এ সময়ে বাংলাদেশের ব্যান্ডউইডথ চাহিদা দাঁড়াবে ২৬ টেরাবাইট, যা প্রকল্পের প্রস্তাবে (ডিপিপি) অনুমোদিত। অথচ তার বদলে ৫ গুণ, অর্থাৎ ১২৬ টেরাবাইটের যন্ত্রপাতি দরপত্রে চাওয়া হয়েছে, যা অপচয়। আবার প্রয়োজনীয় সক্ষমতার যন্ত্রপাতি না কিনলে পুরো টাকাই গচ্চা যাবে।
টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যতটুকু জানতে পেরেছি ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক চালু করতে ২০১৫ সালের পুরোনো মডেলের যন্ত্রপাতি কেনা হচ্ছে। ২০২৩ সালে এসে যেখানে আমরা সামনে অগ্রসর হব, সেখানে পুরোনো মডেলের যন্ত্রপাতি কেন কেনা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘যতটুকু সামর্থ্য আছে, আমি রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় হতে দেব না।’
‘ফাইভ জি প্রকল্প: ৪৬৩ কোটি টাকা গচ্চার শঙ্কা’ শিরোনামে প্রথম আলোয় ৭ নভেম্বর প্রকাশিত সংবাদের কয়েকটি অংশের প্রতিবাদ জানিয়েছে হুয়াওয়ে বাংলাদেশ।
প্রতিবাদপত্রে বলা হয়, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) একটি প্রকল্পে যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য হুয়াওয়েসহ যে তিনটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়, তারা শর্ত পূরণ করতে পারেনি বলে উল্লেখ করা তথ্যটি সত্য নয়। বরং কারিগরি মূল্যায়ন কমিটিই যন্ত্রপাতি ও হুয়াওয়েসহ বাকি দুটি প্রতিষ্ঠানকে যোগ্য ঘোষণা করে। পরবর্তী সময়ে সিপিটিইউ রিভিউ প্যানেলও তিনটি প্রতিষ্ঠানকেই যোগ্য ঘোষণা করে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদনে গোপনীয় তথ্য সরবরাহ করে অবৈধভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণকে প্রভাবিত করার যে বিষয়টি বলা হয়েছে, সেটি ভিত্তিহীন। শুধু একটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে কিছু প্রেক্ষাপট হুয়াওয়ের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছিল।
হুয়াওয়ে এই প্রকল্পে যে ধরনের যন্ত্রপাতি সরবরাহ করবে, সেগুলো হবে সবচেয়ে আধুনিক মডেলের। কাজেই কোনো পুরোনো মডেলের যন্ত্র সরবরাহ কিংবা অর্থ গচ্চা যাওয়ার বিষয়টি একেবারেই অযৌক্তিক।
প্রতিবেদকের বক্তব্য:
কারিগরি মূল্যায়ন প্রতিবেদনেই উল্লেখ রয়েছে, সব দরদাতার যন্ত্রপাতিই তৃতীয় কেব্ল বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর ‘এসন’ সক্ষমতা প্রমাণে ব্যর্থ হয়েছে। যন্ত্রপাতির এই সক্ষমতাই দরপত্রের অন্যতম আবশ্যিক চাহিদা। এ বিষয়ে প্রতিবেদনে বিস্তারিত রয়েছে।
গোপনীয় তথ্য প্রকাশবিষয়ক তথ্য প্রথম আলোর নয়, এটা নথিপত্র থেকেই লেখা হয়েছে। এ ছাড়া ‘কারিগরি মূল্যায়ন প্রতিবেদন জমার তারিখের গোপনীয় তথ্য’ টেকভিশান২৪ ডটকম নামে একটি অনলাইন পোর্টালে ৭ মে প্রকাশিত খবর থেকে জেনেছিল বলে হুয়াওয়ে রিভিউ প্যানেলে দেওয়া আবেদনে উল্লেখ করেছে। বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, ৭ মে প্রকাশিত ওই খবরে ১৮ মে সংঘটিত ঘটনার বর্ণনাও রয়েছে।
এ ছাড়া পুরোনো মডেলের যন্ত্রপাতি কেনাবিষয়ক বক্তব্যটি টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের।