মেট্রোরেলে উঠছেন যাত্রীরা। বেশির ভাগ সময় স্টেশনে ভিড় লক্ষ করা যাচ্ছে। যাত্রীরা বলছেন, ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো দরকার। সম্প্রতি মতিঝিল স্টেশনে
মেট্রোরেলে উঠছেন যাত্রীরা। বেশির ভাগ সময় স্টেশনে ভিড় লক্ষ করা যাচ্ছে। যাত্রীরা বলছেন, ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো দরকার। সম্প্রতি মতিঝিল স্টেশনে

মেট্রোরেল সাড়ে তিন মিনিট বিরতিতে চলার কথা, ১০ মিনিট পর পর চলছে কেন

মেট্রোরেলে এখন ট্রেন চলছে ১০-১২ মিনিট বিরতিতে। তবে সাড়ে ৩ মিনিট পরপর চালানোর মতো ট্রেন আছে। ঘাটতি জনবলে।

রাজধানীর উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর দারুণ খুশি হয়েছিলেন মতিঝিলের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী আবুল হাসান ফজলে রাব্বি। তবে এখন কিছুটা হতাশ তিনি। কারণ, মিরপুর ১০ নম্বর সেকশন থেকে ট্রেনে উঠতে তাঁকে রীতিমতো লড়াই করতে হয়।

ফজলে রাব্বি মিরপুরের বাসিন্দা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সকালে ট্রেন যাত্রীতে টইটম্বুর থাকে। ধাক্কাধাক্কি করে উঠতে হয়। শেওড়াপাড়া ও আগারগাঁওয়ে দেখা যায়, যাত্রীদের কেউ কেউ উঠতেই পারেন না। সন্ধ্যায় ফেরার পথে মাঝের কিছু স্টেশনে একই দৃশ্য দেখেন তিনি। 

ঢাকার উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত দিনে-রাতে মেট্রোরেল চালুর পর তাতে গাদাগাদি করে যাত্রীরা চলাচল করছেন। বিশেষ করে সকালে ও সন্ধ্যায় ব্যাপক ভিড় হচ্ছে। মধ্যবর্তী কিছু কিছু স্টেশন থেকে যাত্রীদের ট্রেনে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ছে।

ডিএমটিসিএল সূত্র বলছে, এখন ব্যস্ত সময়ে আট সেট ও বাকি সময়ে সাত সেট ট্রেন চালানো হয়। তবে যান্ত্রিক সমস্যা এড়াতে ২৪টি ট্রেনই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করা হয়।

যাত্রীরা বলছেন, মেট্রোরেল চলাচলে গতি এনে দিয়েছে। তবে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো দরকার। 

ঢাকায় মেট্রোরেল–ব্যবস্থা নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) বলছে, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত সাড়ে তিন মিনিট পর পর ট্রেন চালানোর সক্ষমতা আছে তাদের। এখন চলছে ১০ থেকে ১২ মিনিট বিরতিতে। পুরোদমে এবং বাড়তি সময় ট্রেন চালাতে বাড়তি জনবল দরকার। জনবলের প্রশিক্ষণ দরকার। সেখানে ঘাটতি রয়েছে। 

ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা যাত্রীদের চাহিদা অনুসারে দুই ট্রেনের মাঝের বিরতির সময় কমানোর সিদ্ধান্ত নেবেন। জুলাইয়ের মধ্যেই ধীরে ধীরে পূর্ণাঙ্গ যাতায়াত নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছেন তাঁরা। তিনি মনে করেন, এখন যাত্রীর চাপ বেশি। এর কারণ বইমেলা ও বাণিজ্য মেলা। ইজতেমাকেন্দ্রিক যাত্রী বেশি ছিলেন। তবে এই প্রবণতা স্থায়ী হবে কি না, সেটা নিশ্চিত নয়। যাত্রী চাহিদা দেখে মেট্রোরেলের চলাচল বাড়ানো হবে। 

আরও কিছু সেবা এখনো সহজলভ্য হয়নি। যেমন এখন মেট্রোরেল স্টেশনে গিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কার্ডে টাকা ভরতে হয়। এটি অনলাইনে বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে করার চেষ্টা চলছে। 

কত যাত্রী

ঢাকায় মেট্রোরেলের লাইন-৬ (উত্তরা-মতিঝিল) প্রকল্প নেওয়ার সময় পরিকল্পনা করা হয় যে, সকাল থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করবে। ঘণ্টায় ৬০ হাজার এবং দিনে পাঁচ লাখ যাত্রী পরিবহন করা যাবে। এর জন্য হিসাব করে লাইন-৬–এর অধীনে ২৪ সেট ট্রেন কেনা হয়।

বর্তমানে সকাল আটটা থেকে রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করছে। ব্যস্ত সময় অর্থাৎ পিক আওয়ারে ১০ মিনিট পরপর এবং বাকি সময় ১২ মিনিট পরপর ট্রেন চলাচল করে। 

ডিএমটিসিএল সূত্র জানিয়েছে, মেট্রোরেলে এখন গড়ে প্রতিদিন আড়াই লাখ যাত্রী যাতায়াত করছে। গত জানুয়ারি পর্যন্ত মেট্রোরেলে প্রায় সোয়া দুই কোটি যাত্রী যাতায়াত করেছে। প্রতিটি ট্রেনে গড়ে যাত্রী চলাচল করে ১ হাজার ৬৫০ জনের মতো। তবে ব্যস্ততার সময়ে অনেক বেশি যাত্রী হয়। 

মোট যাত্রীর অর্ধেক স্থায়ী পাস ব্যবহার করে যাতায়াত করেন। এ পর্যন্ত ২ লাখ ৬০ হাজার কার্ড বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে গত ২০ জানুয়ারি দিনে-রাতে চালুর পর ৬৩ হাজার কার্ড বিক্রি হয়েছে।

মেট্রোরেলের প্রতিটি ট্রেন চলছে ছয়টি কোচ নিয়ে। দুই প্রান্তের দুটি কোচকে বলা হয় ট্রেইলর কার। ছয় কোচের একটি ট্রেনে বসে ও গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে মোট ২ হাজার ৩০৮ যাত্রী ভ্রমণ করতে পারার কথা। অবশ্য যাত্রীরা বলছেন, প্রবীণদের পক্ষে ব্যস্ত সময়ে ট্রেনে ওঠা অনেকটা অসম্ভব। নারীরা যদি ব্যস্ত সময়ে তাঁদের জন্য বরাদ্দ কামরার বাইরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে অন্য কামরায় ওঠেন, তাহলে গাদাগাদির মধ্যে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়তে হয়। 

নিজের স্বামী ও সাত বছর বয়সী সন্তানকে নিয়ে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মেট্রোরেলে শেওড়াপাড়া থেকে উত্তরা গিয়েছিলেন উম্মে সালমা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এত ভিড় ছিল যে প্রথম আসা ট্রেনটিতে তিনি ওঠার সাহস করেননি। পরেরটিতে অনেক কষ্টে উঠেছেন। তবে ওঠার সময় ও ভেতরে গাদাগাদিতে যে ভোগান্তি হয়েছে, তা নারীদের জন্য লোকাল বাসের অভিজ্ঞতার মতোই। তিনি বলেন, নারী কামরাগুলোতে ব্যস্ত সময়ে ব্যাপক ভিড় হয়। 

মেট্রোরেল সারা বিশ্বেই অতি ঘন ঘন (হাই ফ্রিকোয়েন্সি) চলাচলকারী গণপরিবহন। এর জন্য সর্বদা তৎপর, স্মার্ট ও দক্ষ জনবল দরকার। তা না হলে মেট্রোরেলের চলাচল বাড়ানো যাবে না। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্বের অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর একটি। এখানে যাত্রীর সংখ্যা বেশি না হওয়ার কারণ নেই। 
পরিবহনবিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদীউজ্জামান

ট্রেন সব কটিই প্রস্তুত

ডিএমটিসিএল সূত্র বলছে, এখন ব্যস্ত সময়ে আট সেট ও বাকি সময়ে সাত সেট ট্রেন চালানো হয়। তবে যান্ত্রিক সমস্যা এড়াতে ২৪টি ট্রেনই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করা হয়।

একেকটি ট্রেনে এখন যে ছয়টি কোচ আছে, তা বাড়িয়ে আটটিও করা সম্ভব। পাশাপাশি রাত ১২টা পর্যন্ত মেট্রোরেল চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও আছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিশ্বের বড় শহরগুলোতে সপ্তাহান্তে অর্থাৎ ছুটির দিনে একদিন ২৪ ঘণ্টা মেট্রোরেল চলাচল করে। কর্মদিবসে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেট্রোরেল চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। বাংলাদেশে ছুটির দিনে শুক্রবার মেট্রোরেল বন্ধ থাকে।

ডিএমটিসিএল কর্তৃপক্ষ অবশ্য মেট্রোরেল পুরোদমে চালু করলে পর্যাপ্ত যাত্রী পাওয়া যাবে কি না, সেই বিষয়টি সামনে আনছে। তাদের মতে, এখনো সক্ষমতার চেয়ে কম যাত্রী নিয়ে চলছে মেট্রোরেল। ফলে দুই ট্রেনের মাঝের বিরতির সময় কমিয়ে আনলে খরচ বেড়ে যাবে। ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক বলেন, সমীক্ষা করে দেখতে হবে রাত ১২টা পর্যন্ত মেট্রোরেল চালালে কী রকম যাত্রী হয়। সেই অনুযায়ী রাত সাড়ে আটটার পর কটি ট্রেন চলবে, তা ঠিক করা হবে। 

অবশ্য যাত্রীরা বলছেন, ব্যস্ততার সময়ে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো জরুরি। মানুষ যাতে উঠতে পারে, স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। 

ঘাটতি জনবলে 

যাত্রী আছে, ট্রেন প্রস্তুত আছে, তাহলে মেট্রোরেলে ট্রেন চলাচলের সংখ্যা বাড়ছে না কেন—সেই খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঘাটতি আসলে দক্ষ জনবলের। 

ডিএমটিসিএল সূত্র বলছে, লাইন-৬–এর জন্য ১ হাজার ২৪ জনের একটি জনবলকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। এর মধ্যে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৭৩০ জনের মতো। জনবল নিয়োগ দেওয়ার পর দেশে, ভারতে ও জাপানে প্রশিক্ষণের কথা। সবাই পূর্ণাঙ্গ প্রশিক্ষণ পায়নি। 

ডিএমটিসিএলের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, মেট্রোরেল চালুর আগেই জনবল নিয়োগ সম্পন্ন করা দরকার ছিল। কারণ, ব্যবস্থাটি বাংলাদেশে প্রথম। ফলে প্রতিটির দেশে-বিদেশে লম্বা প্রশিক্ষণ দরকার। বাংলাদেশে জনবলের একটি বড় অংশের নিয়োগ হয়েছে মেট্রোরেল চালুর পর। 

মেট্রোরেল প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, দক্ষ জনবলের ঘাটতি থাকায় কখনো ত্রুটি দেখা দিলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি সময় ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখতে হয়। মূলত সমস্যা চিহ্নিত করতে দেরি হয় এবং সমাধানেও সময় বেশি লাগছে।

যেমন গত রোববার বৈদ্যুতিক ত্রুটির কারণে পৌনে দুই ঘণ্টা চলাচল বন্ধ রাখা হয়। এর বাইরে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই ত্রুটির কারণে কিছু কিছু সময় বন্ধ থাকে মেট্রোরেল। যদিও মেট্রোরেল চলাচলের জন্য নিজস্ব বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা আছে। প্রতিটি সাবস্টেশনে দুটি ট্রান্সফরমার রয়েছে। একটি বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে এবং অন্যটি জরুরি প্রয়োজনে চালু হবে। অর্থাৎ কোথাও বিদ্যুৎ-বিভ্রাট হলেও ট্রেন চলাচল বন্ধ হবে না।

আরও কিছু সেবা এখনো সহজলভ্য হয়নি। যেমন এখন মেট্রোরেল স্টেশনে গিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কার্ডে টাকা ভরতে হয়। এটি অনলাইনে বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে করার চেষ্টা চলছে। 

‘সারা বিশ্বেই অতি ঘন ঘন চলে’

২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রথম মেট্রোরেল চালু করা হয়। গত বছর ৪ নভেম্বর শুরু হয় মতিঝিল পর্যন্ত চলাচল। মতিঝিল অংশে রাত পর্যন্ত চলাচল শুরু হয় গত ২০ জানুয়ারি। এরপরই যাত্রীর চাপ বেড়েছে। 

পরিবহনবিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মো. হাদীউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, মেট্রোরেল সারা বিশ্বেই অতি ঘন ঘন (হাই ফ্রিকোয়েন্সি) চলাচলকারী গণপরিবহন। এর জন্য সর্বদা তৎপর, স্মার্ট ও দক্ষ জনবল দরকার। তা না হলে মেট্রোরেলের চলাচল বাড়ানো যাবে না। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্বের অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর একটি। এখানে যাত্রীর সংখ্যা বেশি না হওয়ার কারণ নেই। 

হাদীউজ্জামান আরও বলেন, মানুষ তাঁর চলাচলের সময়ে মেট্রোরেলের মতো একটি সময়সাশ্রয়ী, ভোগান্তিহীন বাহন পেলে তাতেই উঠবে। দরকার ব্যস্ত সময়ে চলাচল বাড়ানো এবং সবাই যাতে উঠতে পারে, সেই ব্যবস্থা করা।