সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশের ১৯ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও ২টি প্রতিষ্ঠানকে একুশে পদক ২০২৩ দেবে সরকার। সমাজসেবায় এ স্বীকৃতি পেয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। এ ফাউন্ডেশন যাত্রা শুরু করেছিল ২০১৩ সালে। চট্টগ্রামের প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগে স্নাতক করেছেন ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কিশোর কুমার দাস। তিনি বর্তমানে স্ত্রী জ্যাসিকা মারিয়াকে নিয়ে লাতিন আমেরিকার দেশ পেরুতে থাকেন। সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছেন ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন কাজ তদারকের জন্য। তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে একুশে পদক পাওয়াসহ সার্বিক বিষয়ে কথা বলেছেন। কিশোর কুমার দাসের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিবেদক মানসুরা হোসাইন।
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন একুশে পদক পেল, অনুভূতিটা যদি বলেন...
কিশোর কুমার দাস: আমি প্রথমেই বলব, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন এ স্বীকৃতি পায়নি, পেয়েছে এ দেশের মানুষ। যেসব তরুণ দিনের পর দিন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন, যাঁরা সহায়তা করছেন অথবা যে গণমাধ্যমকর্মীরা বিদ্যানন্দের ভালো কাজগুলো মানুষের সামনে তুলে ধরছেন—এ অর্জন সবার। সরকারি ঘোষণা আসার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনেকেই নিজেদের মতো করে একুশে পদকের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন। মানুষ বিশ্বাস করেই এ পোস্ট দিচ্ছেন। স্বীকৃতি পাওয়ার পর থেকেই মনে হচ্ছিল, আমি যদি প্রত্যেক মানুষের কাছে গিয়ে বলতে পারতাম, এ স্বীকৃতি ও অর্জন আপনার, তাহলে খুব তৃপ্তি পেতাম। মানুষের কাছ থেকে ধার করে আনা জিনিসগুলো আমরা তদারক করছি, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি—এর বাইরে তো আমরা কিছু করছি না। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের সঙ্গে অনেক মানুষ জড়িয়ে আছে। সরকার আসলে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনকে স্বীকৃতি দেয়নি, এ মানুষদের ভালো কাজকে স্বীকৃতি দিতে চেয়েছে। আর ফাউন্ডেশনের জবাবদিহির বড় জায়গা হচ্ছে মানুষ। সেবাগ্রহীতার কাছেও বিদ্যানন্দের জবাবদিহি করতে হয়।
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন কেন অন্য সংগঠনের চেয়ে আলাদা?
কিশোর কুমার দাস: দেশের বিভিন্ন সংগঠন অভুক্ত মানুষকে খাবার দিচ্ছে। এতিম বা দুস্থ শিশুদের পড়াশোনাসহ আবাসনের ব্যবস্থা করছে। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনও এ ধরনের বিভিন্ন কাজ করছে। তবে আমরা সবাইকে দেখাতে চেয়েছি, এভাবেও মানুষের সেবা করা যায় বা নিজেদের টাকা না থাকলেও চ্যারিটি করা যায়। যেমন ধরেন, কক্সবাজারে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক দিয়ে আমরা ‘প্লাস্টিক দানব’ তৈরি করলাম। কক্সবাজারের প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে শতাধিক মানুষ প্লাস্টিক বর্জ্য জমা দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পেয়েছেন। ‘প্লাস্টিক এক্সচেঞ্জ স্টোরে’ প্লাস্টিক জমা দিয়ে পছন্দের বাজারসদাই করেন। প্লাস্টিক রিসাইকেল বা প্লাস্টিকের ভয়াবহতা নিয়ে কাজ করার সামর্থ্য বিদ্যানন্দের নেই। এ কাজগুলো সরকার বা নীতিনির্ধারক মহলের কাজ। আমরা শুধু বিষয়টি তুলে ধরলাম সচেতনতা তৈরির জন্য। অনেক সংগঠন খাবার দিচ্ছে, তবে আমরা শুধু খাবার দিয়ে দায়িত্ব শেষ করি না, আমরা খাবারটা কীভাবে রান্না হচ্ছে, কীভাবে পরিবেশন করা হচ্ছে, এর পেছনের চিন্তাচেতনার বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিয়েছি। আমরা যে কাজটা শুরু করি, সব সময় চাই তা সরকার বা অন্য কেউ তার হাল ধরবে। ফাউন্ডেশন পরিচালিত ৭টি এতিম খানায় ৫০০ বাচ্চার থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ফাউন্ডেশনের বড় একটি দল সারা বছর প্রত্যন্ত এলাকার বঞ্চিত নারীদের আয়ের পথ করে দেওয়ার কাজ করছে। এ ধরনের কাজগুলো আমাদের তৃপ্তি দেয়। এবারের অমর একুশে বইমেলায় যে ব্যক্তিরা পড়াশোনা জানেন না তাঁদের কাছ থেকে শুনে ‘নিরক্ষরের গল্পগুচ্ছ’ নামে বই প্রকাশিত হচ্ছে। রাজধানীতে চার হাজার স্কয়ার ফুট জায়গায় নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সুপারমার্কেট চালু করতে যাচ্ছে এ ফাউন্ডেশন।
বিদ্যানন্দের কাজের পরিধিটা যদি একটু বলেন...
কিশোর কুমার দাস: বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন এতটা এতিমখানা করেছে, এতজন স্বেচ্ছাসেবক—আমরা ফাউন্ডেশনের কাজকে এভাবে সংখ্যা দিয়ে মূল্যায়ন করি না। আমরা সংখ্যাগুলো মনেও রাখতে চাই না বা মনে রাখি না। তবে অর্থনৈতিক স্বচ্ছতার জন্য আর্থিক হিসাব-নিকাশে কোনো ফাঁক রাখা হয় না। অডিটের জন্য অবশ্যই হিসাব–নিকাশ যা থাকার, তা সবই আছে। সংখ্যাটা মনে রাখলে তা একধরনের তৃপ্তি দেয়, মনে হতে পারে আরে আমরা তো অনেক কাজ করেছি। আমাদের কাছে কাজটাই মুখ্য। আমরা চাইলে ৬৪ জেলায় শাখা খুলতে পারতাম, কিন্তু তাতে অন্তত একজন কর্মীর বেতন, অফিসের বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খরচ বাড়ত। একইভাবে বিভিন্ন সংগঠনের নিবন্ধন করা স্বেচ্ছাসেবকের সংখ্যা অনেক থাকে। আমাদের কিন্তু হাজারো স্বেচ্ছাসেবক নেই। আমরা মনে করি থাকার দরকারও নেই। কোনো এলাকায় গিয়ে আমরা বলি, এলাকায় কতজন আছেন, কেউ কি এ তথ্য দিয়ে সাহায্য করবেন? মুহূর্তে তরুণেরা সেলিমের মা, করিমের মায়েদের তথ্য আনতে থাকেন। এই তরুণেরা নিজেরাও জানেন না তাঁরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করলেন। আমরা এটাকেই মডেল হিসেবে মনে করি। আমরা কোনো জায়গায় যাওয়ার জন্য যদি সুযোগ থাকে যাতায়াত খরচ কমানোর জন্য কম মূল্যের লঞ্চ ভাড়া করি, সেখানেই আমাদের থাকা, খাওয়া চলে।
আপনি দেশের বাইরে থাকেন, এতে বিদ্যানন্দের কাজে কোনো ব্যাঘাত ঘটছে না?
কিশোর কুমার দাস: বিদ্যানন্দ আমাকে কেন্দ্র করে ঘোরে না। সহজভাবে বললে, এটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংস্থা নয়। পেরুতে আমি একটি আবাসিক হোটেল চালাচ্ছি। কুকুরের আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করেছি। টাকার অভাবে বছরে একবারের বেশি বাংলাদেশে আসা সম্ভব হয় না। অনেক স্বেচ্ছাসেবক বছরের পর বছর আমার চেহারাও দেখেন না। কিন্তু কাজ চলছে, কোনো কাজ থেমে নেই।
বিভিন্ন হতাশা থেকেই কি বিদ্যানন্দের যাত্রা শুরু হয়েছিল...
কিশোর কুমার দাস: আমি ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন বঞ্চনার মধ্যে বড় হয়েছি। টাকার অভাবে লেখাপড়া প্রায় বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া—সব মিলে হতাশাগ্রস্ত ছিলাম। আত্মহত্যাও করতে চেয়েছিলাম। তারপর যখন নিজের হাতে একটু টাকাপয়সা এল, তখন কিছু একটা করতে চেয়েছিলাম। তবে বিদ্যানন্দ এত বড় হবে, সে চিন্তা মাথায় ছিল না। আর হতাশার কথা যদি বলেন, তা থেকে তো বের হওয়ার উপায় নেই। মেয়েটির বাবা মেয়ের জামাইকে একটি সাইকেল আর সোনার চেইন দিতে পারছেন না বলে মেয়েটি শ্বশুরবাড়ি যেতে পারছে না। বিয়ের পর থেকে ছয় মাস ধরে শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার অপেক্ষায় থাকা মেয়েটি আকুতি জানিয়েছিল তাঁকে একটি সোনার চেইন কিনে দিতে। একবার কিনে দেওয়ার কথা চিন্তাও করেছি, পরে ভেবেছি এতে একটি বাজে প্রথাকে প্রোমোট করা হবে। এক মা বলছিলেন, তাঁর স্বামী লম্পট, ১২ বছর বয়সী মেয়েকে বাবার হাত থেকে রক্ষার জন্য শহরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। শহরে কিছু হলে হোক, তবু তো চোখের সামনে কিছু দেখতে হবে না। এসব শুনলে মনে হয়, আমরা তো কিছুই করতে পারলাম না। অথবা এভাবে বললে, যে ব্যক্তি শাক কুড়িয়ে খেতেন তাঁকে আমরা গরুর মাংস দিয়ে খেতে দিলাম তাতে কি তেমন লাভ কিছু হলো? একবার এক এলাকায় নারীদের আয়ের কথা চিন্তা করে নৌকা দেওয়া হলো, কিছুদিন পরে দেখা গেলে ওই এলাকার মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আবার অনেক সময় ইচ্ছা থাকলেও অনেক কাজ শুরু করেও আমাদের বন্ধ করে দিতে হয়েছে। নিজেদের কাজের দুর্বলতার জন্য অনেক কাজে সফল হতে পারিনি। দাতাদের বেশির ভাগই দৃশ্যমান কাজে সহায়তা করতে চান, নারী নির্যাতন প্রতিরোধ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়ন—যে কাজের দ্রুত ফলাফল দৃশ্যমান হয় না তাতে সহায়তা করতে চান না। একজন অভুক্ত মানুষ মুঠো ভরে খাবার মুখে দিচ্ছেন এ ধরনের ছবির শক্তি অনেক বেশি। সব মিলে হতাশা ঘিরে ধরে। এই যে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন একুশে পদক পেল, এর আগে রাষ্ট্রীয় পদক, জাতীয় মানবকল্যাণ পদকসহ বিভিন্ন দেশি ও আন্তর্জাতিক পদক পেয়েছে, রাস্তার পাশে ফুটপাতে যে ব্যক্তি ঘুমিয়ে আছে, তার কাছে এসব পুরস্কারের কোনো মূল্য আছে? তবে হতাশার মধ্যেও বলতে হয় মানুষ বিশ্বাস করছে বলেই কোনো প্রতিদানের আশা না করেই বিদ্যানন্দের কাজে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন বলেই বিদ্যানন্দ কাজগুলো করতে পারছে। আর একজন স্বেচ্ছাসেবকও যদি মানুষের জন্য কিছু করতে চান ওই একজন স্বেচ্ছাসেবকের জন্যই বিদ্যানন্দ টিকে থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।
বিদ্যানন্দ নাম নিয়ে বা ব্যক্তি কিশোর কুমার দাসকে নিয়ে সাম্প্রদায়িক বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। এখন পরিস্থিতি কেমন?
কিশোর কুমার দাস: বিদ্যানন্দ নামটি দিয়েছেন একজন মুসলিম ব্র্যান্ড এক্সপার্ট—আনন্দের মাধ্যমে বিদ্যা অর্জন, এ স্লোগান সামনে রেখে। সাম্প্রদায়িক বিতর্ক এড়াতে একবার আমি পদত্যাগও করতে চেয়েছিলাম। তবে মনে হয় আলোচনা, সমালোচনা চলতেই থাকবে। সামনাসামনি না বললেও অনেকে পেছনে বলতেন, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন থেকে আমি তলে তলে অনেক টাকা কামাচ্ছি। এক সময় আমিও চাইতাম আমার ছেলে বা মেয়ে আমার নামটি বহন করবে। ছেলে হলে সীমান্ত এবং মেয়ে হলে চিত্রলেখা নাম রাখব বলেও ঠিক করে রেখেছিলাম। তবে মানুষ যাতে কোনো প্রশ্ন তুলতে না পারে, বলতে না পারে যে আমি আমার বংশধরের জন্য টাকা জমাচ্ছি, তাই আমি এবং আমার স্ত্রী কোনো সন্তানের জন্ম দেব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এতে আমাদের আফসোস আছে, আমার মা মন খারাপও করেছেন।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
কিশোর কুমার দাস: প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ।
‘এক টাকায় আহার’ প্রকল্পের আওতায় হাজারো সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মধ্যে খাদ্য বিতরণ, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো, কুড়িগ্রামে এক টাকায় ভাত-ডাল, মাছ-মাংসের রেস্তোরাঁ চালু, ঢাকার কেরানীগঞ্জে এক কড়াইয়ে একসঙ্গে চার হাজার মানুষের রান্না করার মেগা কিচেন, অবহেলিত উপকূলীয় এলাকা ও চরাঞ্চলের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ‘জীবন খেয়া’ নামের ভাসমান হাসপাতাল চালু, বিশ্বকাপ ফুটবল খেলার পর পরিত্যক্ত পতাকা দিয়ে বাচ্চাদের স্কুলের পোশাক বানানো, ভোটের পর পোস্টার দিয়ে বাচ্চাদের জন্য খাতা বানানো অথবা এবারের বইমেলায় জরাজীর্ণ বইয়ের স্টল দিয়ে মানুষকে মনে করিয়ে দেওয়া যে লাইব্রেরিগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে—এ ধরনের বিভিন্ন উদ্যোগের মাধ্যমে সবার নজর কেড়েছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন।
প্রতিবছর ফাউন্ডেশন গড়ে ১৭ লাখ মানুষকে রান্না করা খাবার খাওয়াচ্ছে। ১ লাখ ২০ হাজার পরিবারকে শুকনা খাবার সহায়তা দিচ্ছে। সাতটি এতিমখানা, পাঁচটি শিখন কেন্দ্র, দুটি স্কুল, একটি হাসপাতাল, দুটি লাইব্রেরি পরিচালনা করছে এ ফাউন্ডেশন। এ ফাউন্ডেশন বাৎসরিক অনুদান পাচ্ছে ২২ কোটি টাকা। ফাউন্ডেশনের আওতায় নিয়মিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ৫০০। এতে স্বেচ্ছাসেবক ২০০ ও কর্মকর্তা আছেন ৬০ জন। দেশের বিভিন্ন জায়গায় শাখা আছে আটটি।