কী খেলাটাই না হলো! বাংলাদেশ বনাম নেপাল। সাফ চ্যাম্পিয়ন কোন নারী দল হবে, তারই চূড়ান্ত লড়াই। নেপালের দশরথ রঙ্গশালায় খেলা হচ্ছে। আমরা প্রথম আলোর কর্মীরা বার্তাকক্ষের ব্যস্ততা ভুলে তাকিয়ে আছি কম্পিউটারের পর্দায়। ইউটিউবে লাইভ খেলা দেখাচ্ছে, সেখানেই চোখ।
গোল, গোল...পুরো অফিস চিৎকার করছে। আমি জানি, তখন চিৎকার করছে ময়মনসিংহের ধোবাউরা উপজেলার কলসিন্দুর গ্রাম।
ফোন করি কলসিন্দুর স্কুলের ফুটবল কোচ জুয়েল মিয়াকে। ওই গ্রামের বেশ কজন ফুটবলার আছেন এখন কাঠমান্ডুতে বাংলাদেশ দলে। কলসিন্দুরবাসী বলছেন, মোবাইলে খেলা দেখছেন। নেপাল গোল শোধ করে দিল। রাঙামাটির খাগড়া স্কুলের আশপাশের গ্রামগুলো তখন প্রার্থনায় বসেছে। মনিকা চাকমা, ঋতুপর্ণা, রুপনা, আচিং মগিনি ও আনাই মগিনি যে এই স্কুলের ছাত্রী ছিলেন। সাতক্ষীরায় সাবিনার পাড়ায় আবারও হুল্লোড়। গোল করেছে বাংলাদেশ। ঋতুপর্ণার সেই রকম শট।
আমরা প্রথম আলোয় বসে চোখ মুছি।
এই খেলোয়াড়দের আমরা ছোট থেকে বড় হতে দেখলাম। ২০১৫ সাল থেকে ওদের পাশে আছি আমরা। প্রথম আলো। প্রথমে কামরান পারভেজের প্রতিবেদন। ফুটবল রাঙাচ্ছে কলসিন্দুরের ফুটবলার মেয়েরা। অনূর্ধ্ব–১৪ জাতীয় দলের ১৮ জনের মধ্যে ১০ জন এক স্কুলের।
প্রথম আলো ২০১৫ সালে কলসিন্দুরের মেয়েদের নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করল—রেদওয়ান রনি পরিচালিত ‘অদম্য মেয়েরা’। ২০১৫ সালের ৬ নভেম্বর রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে আকর্ষণের কেন্দ্রে গ্রাম থেকে আসা কিশোরীরা। প্রথম আলোর দেওয়া লাল জামা পরে ওরা পরীর মতো ঘুরছিল।
ওদেরকে প্রথম আলো বৃত্তি দিতে শুরু করল। পরে, অনূর্ধ্ব–১৪ আঞ্চলিক টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হলে ২০১৬ থেকে এই জাতীয় টিমের সব খেলায়াড়কে প্রথম আলো বৃত্তি দেয় ২০১৯–এর ডিসেম্বর পর্যন্ত।
আজকের টিমে সেই মেয়েদের বেশির ভাগই খেলেছে এবং এরাই বাংলাদেশকে নারী ফুটবলে সাফ চ্যাম্পিয়ন করল, অপরাজিত টানা দুবার।
২০২২ সালে নারী ফুটবল দল চ্যাম্পিয়ন হলে প্রথম আলো তাদের আবার নিয়ে আসে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে। তাদেরকে নিয়ে প্রামাণ্য ছবি বানানো হয়—সে আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে। মহানুভব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় তহবিল গঠন করে প্রথম আলো। মোট ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার তহবিল। বাফুফের হাতে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা দেওয়া হয় নারী ফুটবলের কল্যাণের জন্য। ৩০ লাখ টাকা দেওয়া হয় খেলোয়াড় আর স্টাফদের।
কলসিন্দুর গ্রামে ৩৫ শিশু-কিশোরীকে এখনো কিশোর আলো বৃত্তি দিয়ে যাচ্ছে। ২০২২ সালে কিশোর আলোর জন্মদিন উদ্যাপন করা হয় কলসিন্দুর গ্রামে। ওই সময় শিশু-কিশোরী খেলোয়াড়দের চোখেমুখে অপুষ্টির ছাপ দেখতে পাই। আমার মন কেমন করে! তখনই ফুটবলার মেয়েশিশু ও কিশোরীদের আনা হয় কিশোর আলো বৃত্তির আওতায়, কলসিন্দুরে।
২০২২ সালে সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরে আসে বাংলাদেশের নারী ফুটবলাররা। ওই খেলার আগে সানজিদা ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন, ‘পাহাড়ের কাছাকাছি স্থানে বাড়ি আমার। পাহাড়ি ভাইবোনদের লড়াকু মানসিকতা, গ্রাম বাংলার দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষদের হার না মানা জীবনের প্রতি পরত খুব কাছাকাছি থেকে দেখা আমার। ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়বো এমন নয়, এগারোজনের যোদ্ধাদল মাঠে থাকবে, যে দলের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে।’ কথাটা আরেকবার পড়তে বলি। কেউ এসেছে বাবাকে হারিয়ে। কেউ এসেছে মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে। কেউ এসেছে বোনের অলংকার বিক্রি করে। এটাই কিন্তু বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের আসল ছবি।
২০১৫ সালে প্রথম আলো যখন কলসিন্দুর গ্রামে যায় প্রামাণ্য ছবির শুটিং করতে, তখন প্রথম আলোর পক্ষ থেকে কিশোরীদের জিজ্ঞেস করা হয়, তোমরা কী চাও?
আমরা একবেলা পেট ভরে খেতে চাই।
আরও বেশি কিছু চাও।
বেশি করে খাবার দেন। বাড়ি নিয়ে যাব। ভাইবোনদের সঙ্গে নিয়ে খাব।
এ কথা আমরা ভুলতে পারি না।
আজও সারা বাংলাদেশের মেয়েরা চ্যাম্পিয়ন নারীদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ফুটবল খেলতে যাচ্ছে মাঠে। দারিদ্র্য আর সমাজের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে। কিন্তু এরা অনেকেই খেলতে যায় খালি পেটে।
আর যে শত শত মেয়ে গ্রামে–গঞ্জে খেলে, এদের অল্প কজনই জাতীয় দলে সুযোগ পায়।
জাতীয় দলের মেয়েদেরই মাসোয়ারা খুব কম। অন্যদের অবস্থা কত খারাপ, চিন্তাও করা যাবে না। আবার খেলার বয়স দ্রুত ফুরিয়ে যায়। তখন কী করবে এই মেয়েরা?
এবারও হয়তো ছাদখোলা বাসে ফিরবেন মেয়েরা বিমানবন্দর থেকে ফুটবল ফেডারেশন পর্যন্ত। কিন্তু তাঁরা কত টাকা বেতন পান, কেউ কি খোঁজ নেন?
আর এই ঢাকার ক্যাম্পের বাইরে যাঁরা আছেন, সেই নারী ফুটবলাররা, কিশোরী ফুটবলাররা কি দুই বেলা পেট পুরে খেতে পান?
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ঢাকায় ক্যাম্প বানিয়ে এদের রেখে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে প্রায় ৯ বছর। আজকের সাফল্য সেই কঠোর অনুশীলন আর সাধনার ফল।
অভিনন্দন বাংলাদেশ। আমাদের মেয়েরাই বাংলাদেশকে পরাজিত হতে দেবে না। বারবার করে ছিনিয়ে আনবে জয়। এটা যেমন জুলাই আন্দোলনে দেখা গেছে, তেমনি দেখিয়ে দিচ্ছে সাবিনা-বাহিনী। বাংলাদেশের জয় হবেই। জয়ের ধারা অনিঃশেষ রইবে।