নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া কাউকে সদস্য করার আগে ওই ব্যক্তিকে পাঁচটি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। ষষ্ঠ ধাপে গিয়ে ওই ব্যক্তি সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন।
সম্প্রতি পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে অভিযানের সময় সেখান থেকে ‘সিলেবাস (প্রশিক্ষণ এবং দাওয়াতি কার্যক্রম)’ শিরোনামে সাংগঠনিক নির্দেশিকা উদ্ধার করে র্যাব। তাতে সংগঠনের সদস্য অন্তর্ভুক্তি, প্রশিক্ষণ ও দাওয়াতি কার্যক্রম এবং ‘হিজরতের’ নামে বাড়ি ছাড়ার আগে করণীয় বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে।
জঙ্গিবিরোধী অভিযানে ও তদন্তে যুক্ত কর্মকর্তারা বলছেন, জামাতুল আনসারের এ নির্দেশিকা তৈরি করা হয়েছে অনেকটাই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের নিয়মকানুনের আদলে। উভয় সংগঠনের গোপনীয়তা বজায় রাখার কৌশলও প্রায় একই। দুই জঙ্গিগোষ্ঠীই আল–কায়েদার মতাদর্শ অনুসরণ করে।
জামাতুল আনসার ফিল শারক্বীয়ার প্রতিষ্ঠাতারা বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সাবেক সদস্য। সংগঠনের অনেক সদস্য আগে আনসার আল-ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এ কারণে এ সংগঠনে আনসার আল ইসলামের প্রভাব রয়েছে। এ কারণে হয়তো দুই সংগঠনের লক্ষ্য–উদ্দেশ্য অনেকটা একই।কমান্ডার খন্দকার আল, র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মঈন
উদ্ধার করা ‘সিলেবাস’ অনুযায়ী, এই জঙ্গিগোষ্ঠী প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত ব্যক্তিকে প্রথম ধাপে উদ্বুদ্ধ করে। দ্বিতীয় ধাপে সংগঠনের পর্যবেক্ষণে থাকে এক বছর। তৃতীয় ধাপে এসে ধর্মীয় নিয়মকানুনসহ নানা বিষয়ে আলোচনার মধ্য দিয়ে ওই ব্যক্তিকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয়। চতুর্থ ধাপে ওই সদস্যকে দেওয়া হয় জঙ্গিবাদের মূল দীক্ষা। পঞ্চম ধাপে সংগঠনের বিন্যাস ও কর্মনীতি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। এরপর ষষ্ঠ ধাপে হয় সশস্ত্র প্রশিক্ষণ (তাদের ভাষায় যুদ্ধকৌশলে দক্ষ করা)। ছয়টি ধাপ পার করার পর সংগঠনের দাওয়াতি শাখা বা আসকারি (সামরিক) শাখায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় ওই ব্যক্তিকে।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন প্রথম আলোকে বলেন, জামাতুল আনসার ফিল শারক্বীয়ার প্রতিষ্ঠাতারা বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সাবেক সদস্য। সংগঠনের অনেক সদস্য আগে আনসার আল-ইসলামের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এ কারণে এ সংগঠনে আনসার আল ইসলামের প্রভাব রয়েছে। এ কারণে হয়তো দুই সংগঠনের লক্ষ্য–উদ্দেশ্য অনেকটা একই।
গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও তাঁদের কাছ থেকে উদ্ধার করা সাংগঠনিক কাগজপত্র বিশ্লেষণ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, জামাতুল আনসারের সাত সদস্যের শুরা কমিটি রয়েছে। এ কমিটিই সংগঠনের মূল নীতি নির্ধারণ করে থাকে। তাঁরা হলেন সংগঠনের আমির আনিছুর রহমান ওরফে মাহমুদ, দাওয়াতি শাখার প্রধান আবদুল্লাহ মায়মুন ওরফে মুমিন, অর্থ শাখার প্রধান মোশাররফ ওরফে রাকিব, সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান ওরফে রণবীর, সামরিক শাখার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি সৈয়দ মারুফ হোসেন ওরফে মানিক, সংগঠনের পাহাড়ে প্রশিক্ষণবিষয়ক সমন্বয়ক শামিন মাহফুজ এবং ভোলার শায়েখ দাদুভাই (বিস্তারিত পরিচয় জানা যায়নি)।
জামাতুল আনসারের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নতুন এ জঙ্গি সংগঠনে মাদ্রাসায় এবং কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ব্যক্তির পাশাপাশি স্বল্পশিক্ষিত ব্যক্তিও আছেন। আছেন চিকিৎসক, দরজি, গাড়ির চালকও। এর মধ্যে চিকিৎসক ও কারিগরি দক্ষতা আছে, এমন ব্যক্তিদের সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়।
সম্প্রতি র্যাবের উদ্ধার করা জঙ্গি প্রশিক্ষণের ভিডিও থেকে যে ৩২ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে পাঁচজন স্বল্পশিক্ষিত। এর মধ্যে কুমিল্লার মো. দিদার ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। যদিও প্রশিক্ষণ শিবিরে তিনি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য রয়েছে।
জামাতুল আনসারের ‘সিলেবাসে’ সদস্যদের ১৪ ধরনের কাজ শিখতে বলা হয়েছে। সেগুলো হলো বিদ্যুতের কাজ, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম মেরামত, কংক্রিটের ঢালাই, রাজমিস্ত্রির কাজ, কাঠমিস্ত্রির কাজ, দরজির কাজ, হোটেলের তন্দুর (চুলা) তৈরি ও রুটি বানানো, বেকারির পাউরুটির চুলা তৈরিসহ পাউরুটি বানানো, মুঠোফোন মেরামত, ঘড়ি মেরামত, কৃষিকাজ, ছাগল পালন, হাঁস-মুরগির ডিম ফোটানোর কৌশল শেখা এবং ঘোড়া পালনের বিষয়ে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন।
জঙ্গিবিষয়ক তদন্তে যুক্ত একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকে থাকার প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এসব শেখার বিষয়টি সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ঘোড়া পালনের বিষয়টি নিয়ে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়নি।
র্যাবের কর্মকর্তারা জানান, জামাতুল আনসারের অর্থ শাখার প্রধান মোশাররফ হোসেন ওরফে রাকিব তাঁর শ্বশুরবাড়ি মুন্সিগঞ্জে সংগঠনের টাকায় গরু-ছাগল ও ভেড়ার খামার খুলেছিলেন। কথিত হিজরতে যাওয়া সংগঠনের সদস্যরা এ খামারে স্বেচ্ছাশ্রম দেওয়ার পাশাপাশি পশুপালনের প্রশিক্ষণ নিতেন।
সিলেবাসে যে ১৪ ধরনের কাজ শেখার কথা বলা হয়েছে, অনেকগুলো এখানে শেখানো হতো। পাশাপাশি সংগঠনের টাকায় গুলিস্তানের সুন্দরবন মার্কেটে মুঠোফোন সরঞ্জামাদি বিক্রির দোকান এবং মগবাজারে টুপি, আতর বিক্রির দোকান দিয়েছিলেন রাকিব। দোকানের আয় সংগঠনের তহবিলে জমা হতো।