কারাভোগ শেষ, তবু মুক্তি নেই বাদল ফরাজির

বাদল ফরাজি
বাদল ফরাজি

কারাভোগ শেষ, তবু মুক্তি মিলছে না ভারতে বেড়াতে গিয়ে খুনের মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত বাংলাদেশি তরুণ বাদল ফরাজির। বাদলের বৃদ্ধ মা শেফালি বেগম ঢাকায় এসে অপেক্ষায় রয়েছেন ছেলেকে একবার ছুঁয়ে দেখার, কিন্তু সেই মুক্তি যে কবে মিলবে, তা নিশ্চিত করতে পারছে না কারাগার কর্তৃপক্ষ।

এই প্রতিবেদকের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন শেফালি বেগম। তিনি বলছিলেন, ‘বাদল মুক্ত হওয়া পর্যন্ত আমি বেঁচে থাকলেই হয়। আমার নির্দোষ ছেলেকে এভাবে সাজা যাঁরা দিলেন, তাঁদেরও একদিন বিচার হবে। ভারত থেকে আমার ছেলেকে এনেই বলেছিল তাকে মুক্ত করে দেবে। কিন্তু ছেলের আর মুক্তি মিলছে না।’ এর আগে দীর্ঘদিন সন্তান ফিরে আসার আশায় থেকে মারা যান বাদলের বাবা।

জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার সুভাষ কুমার ঘোষ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারত সরকারকে বাদল ফরাজির সাজাভোগ শেষে মুক্তির বিষয়ে প্রস্তাব পাঠানোর জন্য আমরা ঊর্ধ্বতনদের প্রস্তাব ও অন্যান্য কাগজপত্র পাঠিয়েছি। তাদের মতামত পেলে আমরা তাঁকে মুক্তি দিতে পারব। এ ব্যাপারে সরকার অত্যন্ত আন্তরিক।’

২০ জুলাই বাদল ফরাজির সাজার মেয়াদ শেষ হয়েছে। ভারতের আদালতের দেওয়া আদেশ মেনে যাবজ্জীবন কারাভোগের পরই ২০ জুলাই তাঁর মুক্তি পাওয়ার কথা। কিন্তু এখনো চলছে চিঠি-চালাচালি। বাদল ফরাজি কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী আছেন। সেখানে তিনি অন্য বন্দীদের লেখাপড়া শেখান।

‘নিরপরাধ’ বিবেচনায় ঢাকঢোল পিটিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফেরত আনা হয়েছিল ১০ বছর ধরে কারাগারে থাকা বাদল ফরাজিকে। কিন্তু দেশে আনার পর চার বছর পার হলেও কারাগারেই দাগি আসামিদের সঙ্গে দিন পার করছেন তিনি।

বাদল ফরাজির বয়স এখন প্রায় ৩৩। ১৮ বছর বয়সে তিনি ভারতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। যে খুনের মামলায় তাঁর সাজা হয়েছে, সেটি হয়েছিল তিনি ভারতে যাওয়ার আগে। বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একাধিক বৈঠকের নথিতে তাঁকে নির্দোষ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

একটি খুনের মামলার আসামির সঙ্গে নামের মিল থাকার কারণে ২০০৮ সালে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢোকার সময় বাদল ফরাজিকে গ্রেপ্তার করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। পর্যটক ভিসা নিয়ে বাংলাদেশের বাগেরহাট থেকে তাজমহল দেখতে বেরিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এরপর আর ফেরেননি। পাসপোর্ট অনুযায়ী, বাদলের স্থায়ী ঠিকানা বাগেরহাট, বর্তমান ঠিকানা খুলনা।

‘ছেলেটি নির্দোষ জানার পরও আমরা কিছু করতে পারিনি কারণ, ভারতের আদালতে সাজা হয়েছে। যেহেতু তাদের আদালতে সাজা হয়েছে, তাদের আইন মেনেই বাদলকে মুক্তি দেওয়া হবে। তবে তাঁর মুক্তির প্রক্রিয়া যাতে ত্বরিত হয়, আমরা সেই ব্যবস্থা নেব।’
আসাদুজ্জামান খান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

২০ জুলাই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে কারা অধিদপ্তরে পাঠানো এক চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৮ সালের ৬ জুলাই বাদল ফরাজিকে পুলিশ অধিদপ্তরের মাধ্যমে নয়াদিল্লির তিহার কারাগার থেকে ঢাকায় কেন্দ্রীয় কারাগারে হস্তান্তর করা হয়। ২০ জুলাই বাদল ফরাজির ১৪ বছর সাজা পূর্ণ হয়েছে। সাজাভোগ শেষে মুক্তির বিষয়ে ভারত সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন।

কারাগার সূত্রে জানা গেছে, বাদল ফরাজির সাজা কোন দেশের নিয়মে কার্যকর করা হবে, তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে সরকার। ভারতের পেনাল কোড অনুযায়ী বাদলের সাজা ১৪ বছর। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের মেয়াদ ৩০ বছর। এখন কোন আইনে তাঁর সাজা কার্যকর হবে, তা স্পষ্ট নয়। বাদল ফরাজির মুক্তির ব্যাপারে জানতে ও তাঁর সাজা মওকুফ করার সুপারিশ করে ভারত সরকারকে চিঠি দিয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ হাইকমিশনের মাধ্যমে পাঠানো চিঠিতে জানিয়েছে, বাদল ফরাজি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। ২০১৮ সালের দিল্লি প্রিজনস রুলের ১২৫১-এর বিধি অনুসারে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত প্রত্যেক দোষী সাব্যস্ত বন্দী ১৪ বছর ‘প্রকৃত কারাবাস’ কাটিয়ে কারাগার থেকে মুক্তি পাবেন। তাদের মতে, সাজার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও একজন আসামিকে কারাগার থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুক্তি পাওয়ার অধিকার দেয় না।

অপরাধ সংঘটিত হওয়া পরিস্থিতি ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কারণ ইত্যাদি বিবেচনা করে একজন আসামির মুক্তির সুপারিশ করতে হবে। বাদল ফরাজির প্রকৃত কারাবাসের ১৪ বছর পূর্ণ হলে, তাঁর মুক্তির জন্য সুপারিশ পেতে ভারতের দিল্লি কারাগারের সাজা পর্যালোচনা বোর্ডে পাঠানো হতে পারে। এ ছাড়া মুক্তি পেতে কারাগারে বাদল ফরাজির আচরণ সম্পর্কেও বিশেষভাবে জানানো যেতে পারে।

বাদল ফরাজিকে ভারত থেকে ফেরানোর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছিলেন, বাদল ফরাজিকে এনেই মুক্তির ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু কেন তাঁকে পুরো সাজাই ভোগ করতে হবে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছেলেটি নির্দোষ জানার পরও আমরা কিছু করতে পারিনি কারণ, ভারতের আদালতে সাজা হয়েছে। যেহেতু তাদের আদালতে সাজা হয়েছে, তাদের আইন মেনেই বাদলকে মুক্তি দেওয়া হবে। তবে তাঁর মুক্তির প্রক্রিয়া যাতে ত্বরিত হয়, আমরা সেই ব্যবস্থা নেব।’

বাদল ভারতে গিয়েছিলেন ২০০৮ সালের ১৩ জুলাই। ওই বছরের ৬ মে দিল্লির অমর কলোনিতে এক বৃদ্ধা খুন হন। বিভিন্ন সময় ভারতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত খবর বলছে, বেনাপোল সীমান্ত পার হতেই বাদল ফরাজিকে বাদল সিং ভেবে গ্রেপ্তার করা হয়। ২০০৮ সালের ২১ জুলাই তিনি আটক হন। ২০১৫ সালের ৭ আগস্ট বাদল ফরাজিকে দিল্লির সাকেত আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। রায়ের বিরুদ্ধে দিল্লির হাইকোর্টে আপিল করা হয়। সেখানেও নিম্ন আদালতের রায় বহাল থাকে। বাদলের জীবন কাটছিল দিল্লির তিহার কারাগারে। সেখানে তিনি মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পাস করেন।

একপর্যায়ে বন্দীদের কাউন্সেলিং করতে যাওয়া মানবাধিকারকর্মী রাহুল কাপুরের সঙ্গে কথা হয় বাদল ফরাজির। শুরু হয় ‘জাস্টিস ফর বাদল’ শীর্ষক একটি স্বাক্ষর সংগ্রহ কর্মসূচি। রাহুল ভারতে বাংলাদেশ হাইকমিশনে যোগাযোগ করেন। সরকারের চেষ্টার পর ২০১৮ সালের জুলাইয়ে ভারত তাঁকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠায়।

নির্দোষ জানার পরও বাংলাদেশে এনে বাদলকে এভাবে আটক রাখা মানবাধিকারের লঙ্ঘন বলে মনে করছেন অনেকে। মানবাধিকারকর্মীদের মতে, ভারতে থাকলে সেখানকার মানবাধিকারকর্মীদের চাপে বাদল মুক্ত হয়ে যেতেন। মুক্ত হওয়ার পর মামলা করতে পারতেন, পারতেন ক্ষতিপূরণ চাইতে।

বাদলকে দেশে আনার পর সরকার কয়েক দফায় সাধারণ ও ২০ বছর সাজা খাটা বন্দীদের একটি অংশকে মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু বাদলের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।