প্রবাসে শ্রমিকের মৃত্যুর ২০% দুর্ঘটনায়

অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে দেশে আনার পর দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের দাবি জানিয়েছে রামরু।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে মৃত্যুবরণ করা অনেক প্রবাসীর লাশ দাফন করা হয় সেখানেই। এর পরও গত অর্থবছরে বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছে চার হাজারের বেশি প্রবাসীর মৃতদেহ। সংশ্লিষ্ট দেশগুলো থেকে পাঠানো মৃত্যু সনদে যেসব কারণ পাওয়া যায়, সেটিই থাকে সরকারি হিসাবে। গত পাঁচ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০ শতাংশের বেশি প্রবাসী মারা যান কর্মক্ষেত্রের বিভিন্ন দুর্ঘটনায়।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য বলছে, একজন কর্মী মারা যাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট দেশের কর্তৃপক্ষ মৃত্যুর কারণ লিখিতভাবে জানায়। দূতাবাস সেটি কল্যাণ বোর্ডে পাঠায়। সেই হিসাবে ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে ১৮ হাজার ১৬৬টি মরদেহ এসেছে দেশে। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা, কর্মস্থলে দুর্ঘটনা, আগুনে পোড়া, ভবন থেকে পড়ে যাওয়া ও বৈদ্যুতিক শকে মারা গেছেন ৩ হাজার ৬৯৮ প্রবাসী। সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন সড়ক দুর্ঘটনায়, ২ হাজার ৬৪৯ জন। কর্মক্ষেত্রে আসা–যাওয়ার সময় এসব দুর্ঘটনা ঘটে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে পাঠানো কল্যাণ বোর্ডের এক প্রতিবেদন বলছে, বিদেশে কর্মী পাঠানোর আগে বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) প্রশিক্ষণ দেয়। যে দেশে কাজে যাচ্ছেন, সে দেশের কাজের ধরন, পরিবেশ ও চাপ সামলানোর কৌশল, কর্মঘণ্টা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণাসহ কীভাবে ভিন্ন পরিবেশে নিজেকে সুস্থ রাখা যায়, তার প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন প্রথম আলোকে বলেন, গন্তব্য দেশের নিয়মকানুন, আচার–আচরণসহ নিরাপত্তা সচেতনতা বিষয়ে বিদেশগামী কর্মীদের ধারণা দেওয়া হয়, তিন দিনের বাধ্যতামূলক কর্মশালায়। অগ্নি ও সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ের ওপর আরও জোর দেওয়া হবে।

সেখানে দুর্ঘটনায় মৃত্যু অনেক বছর ধরে চলছে। এটি ঠেকাতে প্রচুর সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া নির্যাতন করে মেরে দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার অভিযোগ আছে প্রবাসী পরিবারের।
রামরুর প্রতিষ্ঠাতা তাসনিম সিদ্দিকী

দেশে যাচাই হয় না মৃত্যুর কারণ

প্রবাসী শ্রমিক

অভিবাসন খাত নিয়ে নিয়মিত কাজ করে, এমন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে অধিকাংশ প্রবাসীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাক উল্লেখ করা হয়। রোগসহ স্বাভাবিক মৃত্যু ধরা হয় ৬৯ শতাংশের। আর দুর্ঘটনাসহ নানা কারণে বাকি ৩১ শতাংশের অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। কর্মক্ষেত্রে নির্যাতন, খুন, আত্মহত্যায় বাধ্য করার অভিযোগ আছে। কিন্তু বিদেশে মৃত কর্মীদের মৃত্যুর কোনো কারণ বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যাচাই করা হয় না। এভাবে দায়সারাভাবে মৃত্যুর কারণ বলে দেওয়াটা পরিবারের জন্য অসম্মানজনক।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, কর্মীর মৃত্যুর বিষয়ে গন্তব্য দেশের মৃত্যুসনদই সাধারণত গ্রহণ করা হয়। কোনো মৃত্যুসনদ বিষয়ে আপত্তি তুলে আবার দেশে ময়নাতদন্ত করার অনুরোধ কখনো কোনো মৃত ব্যক্তির আত্মীয় করেননি।

দেশে আসা প্রতিটি মৃতদেহ দাফনে ৩৫ হাজার টাকা নগদ সহায়তা দেয় কল্যাণ বোর্ড। এর বাইরে এখন জীবন বিমার সুবিধা পায় কর্মীর পরিবার। আর বিদেশে কোনো ক্ষতিপূরণ দাবি থাকলে তা দূতাবাসের মাধ্যমে আদায় করে দেওয়া হয়। মৃত কর্মীর বকেয়া থাকলে তা–ও আদায়ের উদ্যোগ নেয় দূতাবাস। কল্যাণ বোর্ডের তথ্য বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে মৃতদেহ এসেছে ৩ হাজার ৬৯১টি। আর সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসেছে ৪ হাজার ১০৭টি।

২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে ১৮ হাজার ১৬৬টি মরদেহ এসেছে দেশে। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা, কর্মস্থলে দুর্ঘটনা, আগুনে পোড়া, ভবন থেকে পড়ে যাওয়া ও বৈদ্যুতিক শকে মারা গেছেন ৩ হাজার ৬৯৮ প্রবাসী। সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন সড়ক দুর্ঘটনায়, ২ হাজার ৬৪৯ জন।

মৃত্যুঝুঁকি বাড়াচ্ছে উচ্চ তাপ

আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে মিলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও প্রবাসীদের মৃত্যুর কারণ নিয়ে কাজ করছে দেশের বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট (রামরু)। এ সংস্থা বলছে, উপসাগরীয় অঞ্চলের (মধ্যপ্রাচ্য) ছয়টি দেশে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে বছরে ১০ হাজার প্রবাসী মারা যান। তাঁদের প্রতি দুজনের মধ্যে একজনের বেশি প্রবাসীর মৃত্যুর কোনো অন্তর্নিহিত কারণ কার্যকরভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। প্রাকৃতিক কারণ বা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হিসেবে মৃত্যুসনদ দেওয়া হয়। বিপজ্জনক ঝুঁকি সত্ত্বেও কর্মীদের ওপর তাপের প্রভাব সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই। তাপ–সংক্রান্ত কারণে মৃত্যুর কথা সরকারি হিসাবে জানা যায় না।

রামরু বলছে, মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি শ্রমিকদের বড় অংশ কাজ করে অবকাঠামো নির্মাণ খাতে। দিনের বেলায় প্রচণ্ড তাপের মধ্যে তাঁদের কাজ করতে হয়। এতে তাপজনিত নানা রোগে শুধু কিডনি নয়, মস্তিষ্ক থেকে শুরু করে শরীরের সব অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এসব দেশে তাপ আরও বাড়ছে। মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসীদের মৃত্যুঝুঁকি বাড়াচ্ছে অতিরিক্ত তাপ। প্রচণ্ড তাপ ও সূর্যালোকে দীর্ঘসময় কাজ করায় তাঁদের দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যার দিকে পরিচালিত করে। যে জন্য আজীবন চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। দিনে ও রাতে তাপমাত্রা বৃদ্ধি শরীরে ক্রমবর্ধমান চাপ সৃষ্টি করে এবং শ্বাসতন্ত্র, হৃদ্‌রোগ, বহুমূত্র ও কিডনি রোগের প্রভাবকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। এতে অকালমৃত্যু ঘটে।

অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে দেশে আনার পর দ্বিতীয় ময়নাতদন্তের দাবি জানিয়েছে রামরু। সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, সেখানে দুর্ঘটনায় মৃত্যু অনেক বছর ধরে চলছে। এটি ঠেকাতে প্রচুর সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া নির্যাতন করে মেরে দুর্ঘটনা বা আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার অভিযোগ আছে প্রবাসী পরিবারের। তাই দেশে তদন্ত করে প্রতিবেদন সংশ্লিষ্ট দেশে পাঠানো যায়। এতে নিয়োগকর্তারা একটি জবাবদিহির মধ্যে আসবেন।