প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বিতর্কিত তিন নির্বাচন

অর্থ, চাপে প্রভাবিত হয়েছিল পুলিশ

পরপর তিনটি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের সময় নগদ অর্থ ও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপে পুলিশ প্রভাবিত হয়েছিল। প্রশ্নবিদ্ধ ওই তিন নির্বাচনের সময় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অনেকে ‘ব্যবহৃত’ হন। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের মতবিনিময়ে বিষয়টি উঠে এসেছে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় সংসদ ভবনে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে পুলিশ, বিজিবি ও আনসারের শীর্ষ ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা মতবিনিময় সভা করেন। দুই ধাপে মোট ৩০ জনের মতো কর্মকর্তা সভায় অংশ নেন। এই কর্মকর্তাদের বড় অংশই ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় (কোনো না কোনোটিতে) আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার নিয়ে প্রস্তাব তৈরির জন্য অংশীজনদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে মতবিনিময় করছে বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বাধীন কমিশন। পাশাপাশি গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনও পর্যালোচনা করছে তারা। এর অংশ হিসেবে গতকাল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করল নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন।

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘বিনা ভোটের’ নির্বাচন হিসেবে পরিচিত। এই নির্বাচনে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল অংশ নেয়নি। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিবন্ধিত সব দল অংশ নেয়। তবে এই নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে হয়ে যায় বলে অভিযোগ ওঠে। যে কারণে ২০১৮ সালের নির্বাচন ‘রাতের ভোটের’ নির্বাচন হিসেবে বেশি পরিচিতি পায়। আর চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বলা হচ্ছে ‘ডামি নির্বাচন’। ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা ব্যক্তিদের বেশির ভাগ ছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা। যে কারণে তা ডামি নির্বাচন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এই নির্বাচনেও বিএনপিসহ অনেক দল অংশ নেয়নি।

এর আগে গত ৯ নভেম্বর প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করেছিল নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। ওই সভায় তিনটি নির্বাচনের দায় মোটাদাগে পুলিশের ওপর চাপিয়েছিলেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গতকালের সভায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের অনেকে নির্বাচনের সময় ‘ব্যবহৃত’ হওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। অবশ্য কেউ কেউ গত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের জন্য অনেকাংশে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের দায়ী করেন। কারণ, নির্বাচনের সার্বিক দায়িত্বে থাকের রিটার্নিং কর্মকর্তারা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব থাকে বিভিন্ন বাহিনীর। ভোটকেন্দ্রে পুলিশ সদস্যের সংখ্যা খুবই কম থাকে।

ওই সব নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তখনকার ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার এবং সব জেলা প্রশাসক। সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিলেন মূলত তখনকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও)। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে ছিল পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, আনসার এবং স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা।

সভায় উপস্থিত থাকা একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে বলেছে, নির্বাচন বা অন্য যেকোনো সময় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মানা ছাড়া উপায় থাকে না—এমনটি বলেছেন পুলিশের একাধিক সদস্য। তাঁরা বলেছেন, অন্যায় নির্দেশ না মানলে নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে হয়। কোনো সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকে না। একজন কর্মকর্তা বলেছেন, নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য ও নির্বাচনী দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের নগদ টাকা দেওয়া হয়েছিল। তখন কমিশনের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়, কে বা কারা এই টাকা দিয়েছে, আর টাকার উৎস কী। তবে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই বলে তখন কমিশনকে জানানো হয়। আবার কেউ কেউ বলেছেন, মাঠপর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের সব সময় স্থানীয় সংসদ সদস্যের প্রটোকল দিতে হতো, তাঁদের নির্দেশ মেনে চলতে হতো। বাস্তবে সংসদ সদস্যরাই নির্বাচনী এলাকার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন।

সংস্কার কমিশন সূত্র জানায়, বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বেশ কিছু প্রস্তাব দেন। এর মধ্যে আছে জেলা প্রশাসকদের বদলে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা করা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বদলে ইসির কর্মকর্তাদের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা করা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে আনসার সদস্যদের নির্বাচনী দায়িত্বের সম্মানী বাড়ানো, ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের পর ভোটারের আঙুলের ছাপ নিয়ে পরিচয় নিশ্চিত করার ব্যবস্থা থাকা, ভোটকেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, ভোটকেন্দ্রে গণমাধ্যমের প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত রাখা ইত্যাদি।

সভার বিষয়ে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাঠপর্যায়ের এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সংস্কার কমিশন খোলামেলা আলোচনা করেছে। সেখানে কেউ কেউ অপকটে স্বীকার করেছেন যে অতীতে নির্বাচনের সময় তাঁরা ব্যবহৃত হয়েছেন। নির্বাচনের সময় অর্থ লেনদেনের কথাও তাঁরা বলেছেন। তবে মতবিনিময় সভায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেছেন, তাঁরাও চান দেশের স্বার্থে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে এসব বন্ধ হোক। তাঁদের এ মনোভাব ইতিবাচক।