স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়, দরকার ব্যয়ের দক্ষতা ও স্বচ্ছতা।
স্বাস্থ্য খাতে সরকারের বরাদ্দ প্রয়োজনের কম। আবার বরাদ্দ দেওয়ার অর্থ, অদক্ষতার কারণে খরচ করতে পারে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। চিকিৎসা নিতে ধনীরা বিদেশ যাচ্ছেন। সেবা নিয়ে দরিদ্র শ্রেণি নিঃস্ব হচ্ছে। দেশের স্বাস্থ্য খাত আস্থার সংকটে পড়েছে।
রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে গতকাল সোমবার আয়োজিত ‘স্বাস্থ্য বাজেটবিষয়ক মতবিনিময় সভা’য় অর্থনীতিবিদ, গবেষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন। নাগরিক সংগঠন বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ ও উন্নয়ন সমন্বয় যৌথভাবে এ সভার আয়োজন করে। মূলত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট সামনে রেখে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানের মূল উপস্থাপনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও উন্নয়ন সমন্বয়ের সভাপতি আতিউর রহমান নিজেদের করা জরিপের তথ্য উদ্ধৃত করে বলেন, সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে দেওয়া ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রীতে চাহিদার মাত্র এক-তৃতীয়াংশ পূরণ হয়। গ্রামাঞ্চলের চিকিৎসাকেন্দ্রে সেবা না পেয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে প্রতি তিনজনের একজনকে সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে সেবা দেওয়া সম্ভব, যদি শূন্য পদগুলো পূরণ করা হয়।
আতিউর রহমান বলেন, স্বাস্থ্য ব্যয় জিডিপির মাত্র ২ দশমিক ৫ শতাংশ। এই হার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। বছরের পর বছর জাতীয় বাজেটের ৫ শতাংশের আশপাশে থাকছে স্বাস্থ্যের বাজেট। অন্যদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও প্রশাসনিক অদক্ষতার কারণে উন্নয়ন বাজেটের ৫০ শতাংশই অব্যয়িত থেকে যায়। তিনি বলেন, ওষুধ খাতে সরকারি বরাদ্দ বাড়ালে চিকিৎসা খাতে ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় কমবে।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ও পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক সচিব মামুন আল রশীদ বলেন, স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বাড়ানো প্রয়োজন, এ কথা সবাই জানেন, সবাই বলেন; কিন্তু বাজেট বাড়ালে সমস্যার সমাধান হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে, দ্বিমতও আছে। জাতীয় বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা আইন, নীতিমালা এবং প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন বক্তব্য ও প্রতিশ্রুতিকে গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনেক কাজের তদারকি ও নজরদারি করার সক্ষমতা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেই।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো এস এম জুলফিকার আলী বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর সবচেয়ে বড় ধাক্কা আসছে স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে। দরিদ্র পরিবারগুলোর আয়ের ৬০ শতাংশ চলে যাচ্ছে চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে। সরকার দারিদ্র্য বিমোচনের যে চেষ্টা চালাচ্ছে, তা ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসা করাতে গিয়ে বহু মানুষ আবার দরিদ্র হয়ে পড়ার কারণে। স্বাস্থ্য খাতের ওপর মানুষের আস্থার ঘাটতি আছে উল্লেখ করে এস এম জুলফিকার আলী বলেন, স্বাস্থ্য খাতের পদ্ধতিগত ও ব্যবস্থাপনাজনিত উন্নয়ন দরকার।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমেদ বলেন, সংকটের একটি কারণ হচ্ছে, স্বাস্থ্যকে বাণিজ্যমুখী করে ফেলা হয়েছে। উন্নয়নের হাতিয়ার হতে পারে স্বাস্থ্য—এই চিন্তা বা দর্শন কোথাও দেখা যায় না। রোগপ্রতিরোধের জন্য পৃথক কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার দাবি তুলে জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলেন, ডায়াবেটিস রোগীর সারা জীবনের জন্য ওষুধের ব্যবস্থা করার চেয়ে ডায়াবেটিস যেন না হয়, সেই উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে, এমন মন্তব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও নীতিনির্ধারকদের জবাবদিহির আওতায় আনতে পারলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। আড়াই ঘণ্টার অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রুমানা হক।