বাংলাদেশে শ্রমমান ও শ্রমিক অধিকার নিশ্চিত করতে ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন সহজ করা এবং ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির বিষয়ে জোর দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ঢালাওভাবে মামলা ও আটকের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশে শ্রমবিষয়ক কর্মপরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছে দেশটি।
এসব পদক্ষেপ বিনিয়োগ, ব্যবসাসহ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের পথ সুগম করবে বলে জানিয়েছে ঢাকা সফররত মার্কিন প্রতিনিধিদল।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্তর্জাতিক শ্রমবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি কেলি এম ফে রদ্রিগেজ গতকাল সোমবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন। কেলির রদ্রিগেজের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদল পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিন এবং শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামানের সঙ্গেও বৈঠক করে। বৈঠকে ওই বিষয়গুলোতে মার্কিন প্রতিনিধিদলটি গুরুত্ব দেয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
কেলি রদ্রিগেজের নেতৃত্বে ২০ সদস্যের মার্কিন প্রতিনিধিদল গত শুক্রবার থেকে ঢাকা সফর করছে।
বাসসের খবরে বলা হয়, তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দেশে আরও বিদেশি ক্রেতাকে আকৃষ্ট করতে ব্যাপক শ্রম সংস্কারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি বলেন, ‘আমাদের শ্রম আইনকে বৈশ্বিক মানদণ্ডের সমমান সমম্পন্ন করতে চাই। এটা আমার অঙ্গীকার।’
বৈঠকে প্রতিনিধিদলের কর্মকর্তারা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে শ্রম আইন সংস্কার ও কারখানায় শ্রমিকবান্ধব পরিস্থিতি তৈরিতে ড. ইউনূসের পদক্ষেপকে সমর্থন করে।
মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনায় উপস্থিত থাকা কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র মূলত তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে। তা হলো কারখানায় ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধন সহজতর করা; ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো এবং শ্রমবিষয়ক কর্মপরিকল্পনা ও শ্রম আইনের দ্রুত সংস্কার।
একাধিক কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানান, বাংলাদেশে ৫ আগস্ট–পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতির আগে এবং পরে ঢালাওভাবে মামলা ও আটকের ঘটনা ঘটেছে। একাধিক আলোচনায় মার্কিন প্রতিনিধিদলটি এ বিষয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মামলাগুলো স্বাধীনভাবে তদন্ত করার কথা বলেছে তারা।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নিশ্চিত করাসহ শ্রম অসন্তোষ নিরসনে শ্রমিক, মালিক ও সরকারের সম্মিলিত উদ্যোগে দেওয়া ১৮ দফার বিষয়টি আলোচনায় আসে। যুক্তরাষ্ট্র এই উদ্যোগের প্রশংসা করলেও ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধনপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। দুই বছর ধরে এই প্রক্রিয়ায় উন্নতি আনার তাগিদ দেওয়া হলেও এতে উন্নতি হয়নি বলে মন্তব্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
বৈঠকের সূত্রগুলো জানিয়েছে, মার্কিন প্রতিনিধিদল বিভিন্ন আলোচনায় শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর প্রসঙ্গটি তোলে। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রপ্তানি করা পোশাকের দাম বাড়ানোর বিষয়টি তোলে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, সস্তা শ্রমে আটকে থাকলে পণ্যের মূল্য বাড়বে না। মনে রাখা উচিত, উচ্চতর ব্র্যান্ড কখনো সস্তা শ্রম কেনে না। সস্তা শ্রমে উৎপাদিত পণ্য কেনে কম পরিচিত প্রতিষ্ঠান। কাজেই বাংলাদেশ যত দিন এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে পণ্য কেনাবেচায় যুক্ত থাকবে, তত দিন শ্রমবাজার ও ব্যবস্থাপনার কোনো উন্নতি হবে না।
ট্রেড ইউনিয়ন করতে কারখানার ২০ শতাংশ শ্রমিকের সমর্থন থাকার নিয়ম রয়েছে, তার বদল হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র চায় এ হার ১০ শতাংশে নামিয়ে আনতে। তবে সরকার ১৫ শতাংশের ব্যাপারে রাজি হয়েছে। ভবিষ্যতে এ হার আরও কমতে পারে।
মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক শেষে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান শ্রমসচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। তিনি জানান, আগামী মার্চ মাসের মধ্যে শ্রম আইন সংশোধন করা হবে।
মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশ করে শ্রম অধিদপ্তর ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে বলে অভিযোগ রয়েছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রমসচিব বলেন, প্রশ্নটি অমূলক নয়। যুক্তরাষ্ট্রের দলটিও এমন প্রশ্ন তুলেছে। কয়েকটি সরকারি দপ্তর পরিদর্শন করে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। তবে এ ব্যাপারে কাজ চলছে।
শ্রমসচিব বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের দলটি জানিয়েছে, এটা তারা কার্যকর দেখতে চায়। আমরা তা কার্যকর করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
শ্রম অধিকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকার পরিস্থিতিও জুড়ে দিচ্ছে উল্লেখ করে শ্রমসচিব বলেন, ‘মানবাধিকার সার্বিকভাবে একটি বড় বিষয়। কিন্তু শ্রমিকদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা, স্বাধীন তদন্ত ইত্যাদি তারা চায়। আমি একমত হয়েছি। তারা বলেছে, ১১ দফা বাস্তবায়িত হলে অবশ্যই আমাদের রপ্তানি বাড়বে এবং ন্যায্যমূল্য পাব। ক্রেতাদের তারা বলতে পারবে এখানে (বাংলাদেশে) মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার সংরক্ষিত হচ্ছে।’