সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণ

‘সবকিছু ভেঙে পড়তাছে... ঘুইরা দেখি ভাই নাই’

গতকাল মঙ্গলবার বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এ ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে। আহত ব্যক্তিরা তাঁরা যে বেঁচে আছেন, তার জন্য সৃষ্টিকর্তার প্রতি শুকরিয়া আদায় করছেন। স্বজনেরা হতবিহ্বল ও বিরক্ত।

হাসপাতালে ছেলে সানি হাসানের পাশে বাবা আবদুল মোতালেব
ছবি: মানসুরা হোসাইন

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বারান্দার এক কোনায় প্রায় অন্ধকার জায়গায় জরুরি বিভাগের মর্গটি তালা দেওয়া। একজন মনের সন্দেহ দূর করতে দুইবার সেখান গিয়ে তালাটি দেখলেন। কাউকে খুঁজছেন কি না, জানতে চাইলে উদ্‌ভ্রান্তের মতো বললেন, ‘সিদ্দিকবাজারের ঘটনায় আমাদের একজনরে পাইতেছি না। এত বড় হাসপাতাল কই খুঁজব?’ এই ব্যক্তি আর কোনো কথা না বলে প্রায় দৌড়ে অন্যদিকে চলে গেলেন।

এ হাসপাতালে ভর্তি রোগীরা এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না তাঁরা বেঁচে আছেন। সৃষ্টিকর্তার প্রতি শুকরিয়া আদায়ের পাশাপাশি সবার কাছে বারবার দোয়া চাচ্ছিলেন। রোগীর সঙ্গে স্বজনেরা উদ্‌ভ্রান্ত, হতবিহ্বল। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে কারও সঙ্গে বাড়তি কথা বলতেও রোগীর স্বজনেরা বিরক্তি প্রকাশ করছিলেন। মো. মামুন নামের একজন জানালেন, তাঁর আপন কেউ আহত বা নিহত হন না। তবে কাজের সূত্রে পরিচয় ছিল, এমন কয়েকজন আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তাঁদের দেখতে হাসপাতালে এসেছেন।

আজ বুধবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি থাকা রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া গেল। শবে বরাতের সরকারি ছুটি বলে হাসপাতালে রোগীর চাপ কম। তবে সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণের ঘটনায় একেক রোগীর সঙ্গে কম করে হলেও তিন থেকে চারজন স্বজন হাসপাতালে এসেছেন। যেসব ওয়ার্ডে এসব রোগীদের ভর্তি করা হয়েছে, সেসব ওয়ার্ডে মানুষের জটলা লেগে আছে। হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হকের অনুমতি নিয়ে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়।

মঙ্গলবার বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে গুলিস্তানে বিআরটিসি বাস কাউন্টারের কাছে সিদ্দিকবাজারে কুইন স্যানিটারি মার্কেট হিসেবে পরিচিত সাততলা ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ভবনের দুই পাশে আরও দুটি বহুতল ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনজন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) আছেন। অন্যজন আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে।

‘শুকরিয়া। আমি ভাবি নাই বাঁচব’

৩২ বছর বয়সী সানি হাসানের মুখের প্রায় পুরোটাই ব্যান্ডেজে মোড়ানো। তিনি সিদ্দিকবাজারে স্যানিটারি পণ্য বিক্রির একটি দোকানে কাজ করতেন। চোখের সামনে ছেলের এ অবস্থায় হতবিহ্বল হয়ে বসে আছেন বাবা আবদুল মোতালেব। মুখে বিরক্তি নিয়ে শুধু বললেন, ছেলে আগের চেয়ে একটু ভালো আছে।

সাইফুল ইসলামকে দেখছেন চিকিৎসক

৪৮ বছর বয়সী শহীদুলের মুখে অক্সিজেন মাক্স লাগানো। পুরো মাথাটাই ফুলে আছে। তাঁর স্ত্রী মনছুরা বেগম জানালেন, শহীদুলের ঠোঁটেও সেলাই লেগেছে, তাই তিনি কথা বলতে পারছেন না। এই দম্পতির তিন মেয়ে। মনছুরা বেগমকে শহীদুল ইশারায় পায়ে ব্যথা হচ্ছে বলে জানান। মনছুরা পায়ে ধরে বলেন, সব জায়গাতেই তো কাটাছেঁড়া। পা যে টিপে দেবেন, সে জায়গাও তো নেই।

২৫ বছর বয়সী সাইফুল ইসলাম প্রতিবেদককে প্রথমেই বললেন, ‘শুকরিয়া। আমি ভাবি নাই বাঁচব, তবে আমি এখনো বাঁইচ্যা আছি।’ সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী সাইফুল ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, বিকট শব্দ শুনেছেন। তারপর ধুলায় চারপাশের কিছুই দেখতে পাচ্ছিলেন না। পাশেই লোকজন পড়ে আছেন। রাস্তাঘাট কিছুই বুঝতে পারছিলেন না।’ যতটুকু মনে করতে পারছেন, তাতে করে তাঁর মনে হচ্ছে, দুই ব্যক্তির লাশের ওপর দিয়েই তিনি ওই জায়গা থেকে বের হয়েছিলেন। তাঁর এক সহকর্মী তাঁকে হাসপাতালে এনেছিলেন। সাইফুলের মাথা ফেটে গেছে, হাতে ব্যথা পেয়েছেন। তবে হাসপাতালে এসে টিকিট কাটা থেকে শুরু করে বিভিন্ন জটিলতায় সেবা পেতে বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে, ততক্ষণ তাঁর মাথা থেকে রক্ত বের হচ্ছিল বলেও অভিযোগ করলেন তিনি। পরে চিকিৎসকেরা তাঁর মাথায় অনেকগুলো সেলাই করেছেন।

সাইফুলের সন্তানের বয়স তিন বছর। সাইফুল জানালেন, হাসপাতালে কিছু কিছু ওষুধ কিনতে হচ্ছে। তাঁর সম্বল বলতে কোম্পানি থেকে পাওয়া বেতনের টাকা, এর বাইরে আর কোনো সঞ্চয় নেই। তবে সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের একজন গতকাল হাসপাতালে এসে বলে গেছেন, প্রয়োজনে কোম্পানি পাশে থাকবে। হাসপাতালে কত দিন থাকতে হবে বা সব মিলিয়ে খরচ কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা জানেন না সাইফুল।

জাহাঙ্গীর হোসেন ও খলিলুর রহমান দুই ভাই। দুজনই একটি বীজ উৎপাদন কোম্পানিতে চাকরি করেন। দুই ভাই মিলে মঙ্গলবার সিদ্দিকবাজারের বিধ্বস্ত ভবনটিতে থাকা একটি কুরিয়ার সার্ভিসে মালামাল কুরিয়ার করতে যান। জাহাঙ্গীর হোসেন কুরিয়ারের জন্য মালামাল জমা দিয়ে ওই ভবন থেকে বের হয়ে যান। খলিলুর রহমান তখনো বের হননি। তারপর তো ৪৫ বছর বয়সী খলিলুর রহমানকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।

পে ইট ফরোয়ার্ড বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবক আবু বক্কর বিভিন্ন ওয়ার্ডে গিয়ে রোগীদের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছিলেন

খলিলুর রহমান হাসপাতালের যে বিছানায় ভর্তি সেখানে বৈদ্যুতিক পাখা নেই। ব্যথার পাশাপাশি ঘামছিলেন। প্লাস্টিকের একটি হাত পাখা দিয়ে ভাইকে বাতাস করতে করতে জাহাঙ্গীর বললেন, ‘দেখি চারপাশের সবকিছু ভেঙে পড়তাছে। এক মিনিটের ডিফারেন্স, ঘুইরা দেখি ভাই নাই। তার কিছুক্ষণ পর ভাই পিঠে কাচের টুকরা নিয়া দৌড় দিয়া আসে।’

খলিলুর রহমানও বললেন, তিনিও ভাবেননি যে তিনি বাঁচবেন। বললেন, ‘আল্লাহ বাঁচাইছে। বিকট শব্দ। ওই জায়গা থেকে কেমনে আইছি কইতে পারি না কিছু। বলতে পারি না কে বাঁচছে আর কে মরছে।’

১৬ বা ১৭ বছর বয়সী মো. তুহিন জুতার দোকানে কাজ করত। জানাল, ঘটনার পর চারপাশে ধোঁয়া দেখে ভয় পেয়েছিল। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছে। তার ভয় এখনো কাটেনি। ওয়ার্ডের মেঝেতে তার চিকিৎসা চলছে। সঙ্গে আছে তার নানি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক অভিজ্ঞান হালদার প্রথম আলোকে বলেন, বিস্ফোরণের ঘটনায় হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে কেউ মস্তিষ্কে, কেউ বুকে আঘাত পেয়েছেন, কারও হাড় ভাঙা, কারও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় কেটে গেছে, আবার কেউ দগ্ধ হয়েছেন। অনেকে আবার এসবের কয়েকটিতে আক্রান্ত। ফলে এই রোগীদের বিভিন্ন চিকিৎসকদের দেখাতে হচ্ছে। অনেককে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়েছে। যাঁদের বুকে আঘাত লেগেছে, তাঁদের বুকের ভেতরে নল ঢুকিয়ে জমাট হয়ে যাওয়া রক্ত বের করা হচ্ছে। অক্সিজেন দিতে হচ্ছে। তবে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের অনেকের অবস্থাই উন্নতির দিকে।

বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকেরা রোগীদের জন্য নিয়ে আসেন ফলের ঝুড়ি

হাসপাতালে স্বেচ্ছাসেবকদের উপস্থিতি

বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধিরা রোগী ও তাঁর স্বজনদের বিভিন্ন সহায়তা দিচ্ছেন। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের স্বেচ্ছাসেবকদের ফলের ঝুড়ি নিয়ে হাসপাতালে ঘুরতে দেখা যায়। তাঁরা জানালেন, রোগীদের ফলের ঝুড়ি দেওয়া হচ্ছে। এরপর অন্য কী লাগবে, তা-ও জেনে নিচ্ছেন।

বেসরকারি সংগঠন পে ইট ফরোয়ার্ড বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবক আবু বক্কর বিভিন্ন ওয়ার্ডে গিয়ে রোগীদের অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছিলেন। প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো বড় দুর্ঘটনার পর আহত ও নিহত ব্যক্তির পরিবারের সহায়তায় তাৎক্ষণিকভাবে অনেকেই এগিয়ে আসেন। তবে এই ব্যক্তিদের দুর্ভোগটা শুরু হয় কয়েক দিন পর থেকে। তখন আর এই ব্যক্তিদের পাশে তেমন কেউ থাকেন না। পে ইট ফরোয়ার্ড বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবকেরা আপাতত পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। তারপর এই মানুষগুলোর আসলেই কোন জিনিসগুলো জরুরি প্রয়োজন ,তা দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।

হাসপাতালের জরুরি বিভাগের বাইরে চেয়ার-টেবিল পেতে বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের কর্মীরা বসে আছেন। তাঁদের পেছনে যে ব্যানার টাঙানো তাতে লেখা রয়েছে, রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ ভবন বিস্ফোরণে আহত ব্যক্তিদের সহায়তায় এগিয়ে আসুন। তাঁরা কীভাবে সহায়তা করছেন, জানতে চাইলে একজন কর্মী বললেন, এক ভাই সব তথ্য দিতে পারবেন। তিনি হাসপাতালের ভেতরে রোগীদের দেখতে গেছেন।

হাসপাতালের বিভিন্ন জায়গায় বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণসহ অনেকেই ব্যানার টানিয়েছে। গণঅধিকার পরিষদ দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের রক্ত, ওষুধ ও খাবারের জন্য তথ্যসহায়তা ডেস্ক খুলেছে বলে ব্যানারে উল্লেখ করেছে।