ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের রিভিউ আবেদন পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করে রায় দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণ করা যাবে। গতকাল রোববার দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এক রায়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে বিচারপতিদের অপসারণের বিষয়টি জাতীয় সংসদের পরিবর্তে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে ফিরল।
বিচারপতিদের অপসারণের এই ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে নিতে ১০ বছর আগে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী এনেছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ। পরবর্তী সময়ে হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। ২০১৭ সালে রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।
সেই আবেদন পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ গতকাল রায় দেন। রায়ে সংবিধানের এ-সংক্রান্ত ৯৬ অনুচ্ছেদের ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ ও ৮ উপ-অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা হয়।
এই রায়ের ফলে কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনে অসমর্থ বা গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ উঠলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। আর রাষ্ট্রপতির উদ্দেশ্যে নিজের সই করা পত্র দিয়ে কোনো বিচারক চাইলে পদত্যাগ করতে পারবেন। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হয় প্রধান বিচারপতি ও পরবর্তী জ্যেষ্ঠ দুজন বিচারপতিকে নিয়ে।
রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি করে আপিল বিভাগের এই রায়ের মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের ওপর অন্য দুটি অঙ্গের হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা কমে গেল, যা খুবই ইতিবাচক।এম এ মতিন, আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি
আপিল বিভাগের রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল হওয়া মানে বিচার বিভাগ দুর্বৃত্তায়ন ও রাজনীতির খপ্পর থেকে বেরিয়ে এল। বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের একটা জায়গায় গেল।’ তিনি বলেন, রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি করে আপিল বিভাগের রায়ের মধ্য দিয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ৯৬ অনুচ্ছেদে যা ছিল, তা চলে এল।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও আইনজীবীদের একাধিক সংগঠন ‘দলবাজ’, ‘দুর্নীতিবাজ’ ও ‘আওয়ামী লীগের ফ্যাসিস্ট’ বিচারপতিদের পদত্যাগের দাবি তোলে। আন্দোলনের মুখে গত ১০ আগস্ট তখনকার প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতি পদত্যাগ করেন।
এরপর একই দাবিতে ১৬ অক্টোবর হাইকোর্ট ঘেরাও ও বিক্ষোভ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটির আইনজীবী শাখা ও বৈষম্যবিরোধী আইনজীবী সমাজ। ওই দিন বিক্ষোভের মধ্যে হাইকোর্ট বিভাগের ১২ বিচারপতিকে বেঞ্চ না দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানায় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। এমন একটা প্রেক্ষাপটে বিচারপতিদের অপসারণ ও ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে আপিল বিভাগে থাকা রিভিউ আবেদনের বিষয়টি আবার আলোচনায় আসে।
২০১৪ সালে জাতীয় সংসদে পাস করা ষোড়শ সংশোধনীর আইনের বৈধতা নিয়ে তখন হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিলেন নয়জন আইনজীবী। গতকাল আপিল বিভাগের রায়ের পর রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ প্রথম আলোকে বলেন, রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তির মধ্য দিয়ে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায় বহাল রয়েছে। রিভিউর নিষ্পত্তির রায়ে বিচারপতিদের পদত্যাগ–সংক্রান্ত ৯৬(৮) উপ-অনুচ্ছেদটিও পুনর্বহাল করা হয়েছে। ফলে বিচারপতিদের পদত্যাগ নিয়ে বিতর্ক দূর হলো।
রাষ্ট্রপক্ষের করা রিভিউ আবেদনটি শুনানির জন্য গতকাল আপিল বিভাগের কার্যতালিকার এক নম্বর ক্রমিকে ছিল। সকাল নয়টার দিকে এজলাসে আসেন প্রধান বিচারপতি ও অপর পাঁচ বিচারপতি। তাঁরা হলেন বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম, বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী, বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল করিম, বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি এস এম এমদাদুল হক।
রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি শুরু হয় সকাল সাড়ে নয়টার দিকে। অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান শুনানিতে বলেন, রিভিউ আবেদনে (আওয়ামী লীগ সরকার আমলে করা) ৯৪টি যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে। যখন ৯৪টি যুক্তি থাকে, তখন সেগুলো কোনো যুক্তিই নয়। যে কারণে এগুলো উপস্থাপন করা হচ্ছে না। বাড়তি একটি যুক্তি তুলে ধরা হচ্ছে। সেটা হচ্ছে আপিল বিভাগের আগের রায়ে ৯৬ অনুচ্ছেদের ২, ৩, ৪, ৫, ৬ ও ৭ উপ-অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা হয়। তবে বিচারপতিদের পদত্যাগ–সংক্রান্ত উপ-অনুচ্ছেদটি পুনর্বহাল করা হয়নি। তিনি বলেন, সাংবিধানিকভাবে বিচারপতিদের পদত্যাগের অধিকার রয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীতে ৯৬(৮) উপ-অনুচ্ছেদে পদত্যাগের বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে, আর বাহাত্তর সালের সংবিধানের ৯৬(৪) অনুচ্ছেদে এ বিষয়ে বলা হয়। পদত্যাগ বিষয়ে অস্পষ্টতা দূর করে রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তির আরজি জানান অ্যাটর্নি জেনারেল।
রিট আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। তিনি বলেন, ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে আপিল বিভাগের রায় হওয়ার পর সংবিধান ছাপা হয়। অথচ এতে রায়ের কথা উল্লেখ করা হয়নি। আইনের উদ্দেশ্য ছিল বিচারককে কীভাবে অপসারণ করা যাবে। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থেকে জাতীয় সংসদে নিয়ে যাওয়ার জন্য ষোড়শ সংশোধনী আইনটি করা হয়।
মনজিল মোরসেদ বলেন, পদত্যাগ–সংক্রান্ত ৯৬(৮) উপ–অনুচ্ছেদ নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। হাইকোর্টের রায়ে ষোড়শ সংশোধনী আইনটি বাতিল করা হয়েছে। আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল করেন। তিনি বলেন, পদত্যাগ করা বিচারকদের মৌলিক অধিকার। এ নিয়ে সমস্যা হচ্ছে না। কেননা আপিল বিভাগের রায়ের পর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা পদত্যাগপত্র দেন এবং তা গৃহীত হয়। বিচার বিভাগের সুরক্ষা ও স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনরুজ্জীবিত করে আপিল বিভাগ আগে যে রায় দিয়েছেন, সে ক্ষেত্রে রিভিউ করার সুযোগ নেই। তাই রিভিউ আবেদন খারিজ করার আরজি জানান তিনি।
আদালতের অনুমতি নিয়ে শুনানিতে অংশ নেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস। রায়ের পর তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই রায়ের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের কর্তৃত্ব এবং ক্ষমতা বাড়ল।
বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস হয়। ‘বিচারকদের পদের মেয়াদ’–সংক্রান্ত ষোড়শ সংশোধনী বিল অনুসারে, সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের উপ-অনুচ্ছেদ ২-এ বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতাসংক্রান্ত বিধান রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়, প্রমাণিত ও অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের কারণে সংসদের মোট সদস্যসংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনো বিচারককে অপসারিত করা যাবে না। আর উপ-অনুচ্ছেদ ৩-এ বলা হয়, এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধীন প্রস্তাব-সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করবে।
বাহাত্তরের সংবিধানে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা ছিল সংসদের হাতে। ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে ৯৬(২) অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সরাসরি রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়। আর ৯৬(৩) অনুচ্ছেদটি বিলুপ্ত করা হয়।
১৯৭৭ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে এক সামরিক আদেশে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে দেওয়া হয়। এরপর তাঁর সময়েই পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এই বিধান সংবিধানে স্থান পায়।
২০১০ সালে আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন, তবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে অনুমোদন দেওয়া হয়।
এরপর ২০১১ সালে জাতীয় সংসদে গৃহীত পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাহাত্তরের সংবিধানের অনেক বিষয় ফিরিয়ে আনা হলেও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল রেখে দেওয়া হয়।
২০১৪ সালে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে দিয়ে ষোড়শ সংশোধনী পাস করা হয়। তাতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বাদ দেওয়া হয়।
ষোড়শ সংশোধনীর বৈধতা নিয়ে ৯ জন আইনজীবী হাইকোর্টে একটি রিট করেন। ২০১৬ সালের ৫ মে হাইকোর্টের তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। একই বছরের ৩ জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার (এস কে সিনহা) নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্বসম্মতিতে আপিল খারিজ করে রায় দেন।
২০১৭ সালের ১ আগস্ট পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়ে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের জন্য ৩৯ দফাসংবলিত একটি আচরণবিধিও প্রণয়ন করে দেওয়া হয়।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তাঁর লেখা রায়ে গণতন্ত্র, রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, সুশাসন, দুর্নীতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দেন। রায়ে তাঁর বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, দলীয় নেতা ও দলটির সমর্থক আইনজীবীরা। তাঁরা প্রধান বিচারপতি সিনহার পদত্যাগের দাবি তোলেন। একপর্যায়ে বিচারপতি সিনহা ছুটি নিয়ে বিদেশে চলে যান। বিদেশে থাকা অবস্থায়ই তিনি পদত্যাগ করেন। অবশ্য অনেক পরে তিনি গণমাধ্যমে বলেছিলেন, তাঁকে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল।
এদিকে ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। সেই রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি করে গতকাল আপিল বিভাগ রায় দেন।
আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন প্রথম আলোকে বলেন, পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা হলে তাতে কিছু কিছু বিষয়কে সুরক্ষা দেওয়া হয়। এর মধ্যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলও ছিল। তিনি বলেন, রিভিউ আবেদন নিষ্পত্তি করে আপিল বিভাগের এই রায়ের মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের ওপর অন্য দুটি অঙ্গের হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা কমে গেল, যা খুবই ইতিবাচক।