সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় ওই ভবনের তৃতীয় তলা ধ্বংসস্তূপে পরিণত। নিহত তিনজন দোকান কর্মচারী। আহত পথচারীসহ ১৫ জন।
তিনতলা ভবনের তৃতীয় তলাটা যেন ধ্বংসস্তূপ। বিধ্বস্ত দেয়ালের ইট, দরজা, জানালা ও আসবাব ছিন্নভিন্ন হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। রাস্তায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। আশপাশে আতঙ্কিত লোকজন। সবাই বোঝার চেষ্টা করছেন কী হয়েছে।
গতকাল রোববার সকালে ঢাকার সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার শিরিন ভবনে বিস্ফোরণের ৪৫ মিনিট পর ঘটনাস্থলে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা যায়। ততক্ষণে ভবনের ভেতর থেকে নিহত তিনজনকে উদ্ধার করে নিকটস্থ পপুলার হাসপাতালে পাঠানো হয়। আহত আরও ১৫ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়।
পাশের ভবনের নিরাপত্তকর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, বেলা পৌনে ১১টার দিকে হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। আশপাশের ভবনও কেঁপে ওঠে। ভূমিকম্প হচ্ছে মনে করে অন্যান্য ভবনের লোকজনও নিচে নেমে আসেন। বিস্ফোরণের পরপর আগুন ধরে যায় শিরিন ভবনে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ১০টা ৫৫ মিনিটে ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। চারটি ইউনিট মিলে ১৮ মিনিটের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে এনে উদ্ধারকাজ শুরু করে। শুরুতে খবর ছড়িয়ে পড়ে, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ (এসি) যন্ত্র বিস্ফোরিত হয়েছে। পরে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে জানায়, জমে থাকা গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ হয়েছে। তাঁরা ঘটনাস্থলে গ্যাস ডিটেক্টর (শনাক্তকারী যন্ত্র) দিয়ে পরীক্ষা করে সেখানে গ্যাসের উপস্থিতি পেয়েছেন।
তবে ঠিক কোথায় ও কীভাবে গ্যাস জমেছিল, কীভাবে বিস্ফোরণের সূত্রপাত হয়; সেটা গতকাল পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের কর্মকর্তারা জানান, কোনো আবদ্ধ জায়গায় স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি ঘনত্বের গ্যাস থাকলে বৈদ্যুতিক সুইচ, শর্টসার্কিট, দেশলাই বা লাইটারসহ এ ধরনের যেকোনো কিছু থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত হতে পারে। তবে তাঁরা তিনটি বিষয় সামনে রেখে তদন্ত করছেন।
সিটিটিসির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের দায়িত্বে থাকা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) রহমত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, কনসিল লাইনের (অব্যবহৃত পুরোনো গ্যাসের লাইন) ছিদ্র থেকে নির্গত গ্যাস জমে এ বিস্ফোরণ হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। অনেক সময় গ্যাস–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পরও বদ্ধ পাইপলাইন ভবনে থেকে যায়।
অপর দুটি সন্দেহ সম্পর্কে এই কর্মকর্তা বলেন, পয়োনালা থেকে নির্গত গ্যাসও অনেক সময় শৌচাগারের পাইপ দিয়ে ওপরে উঠে কোনো স্থানে জমতে পারে। এ ছাড়া এসি থেকেও ধীরে ধীরে গ্যাস নির্গত হতে পারে। তবে এখান পর্যন্ত এসি থেকে গ্যাস নির্গতের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে সব সন্দেহ সামনে রেখে তদন্ত করা হচ্ছে।
বিকেলে সেনাবাহিনীর বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। তাঁরা জানান, সেখানে কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহারের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। বিস্ফোরণের প্রকৃত কারণ জানতে আরও তদন্ত করতে হবে।
প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টারের পাশের এই ভবনের তৃতীয় তলায় ফিনিক্স ইনস্যুরেন্সের নিউমার্কেট শাখার কার্যালয় রয়েছে। এ ছাড়া নিউ জেনারেশন ও লায়রা প্রোডাক্ট নামে দুটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সিটিটিসির বোমা নিষ্ক্রিয় দল ধারণা করছে, ফিনিক্স ইনস্যুরেন্সের কার্যালয় থেকে বিস্ফোরণের সূত্রপাত। তবে এ ঘটনায় নিহত তিনজনই নিউ জেনারেশনের কর্মচারী। আহত ও দগ্ধদের মধ্যে নিউ জেনারেশনের চারজন এবং ফিনিক্সের সাতজন কর্মী রয়েছেন।
এ ছাড়া চারজন পথচারী। তাঁদের মধ্যে একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজে স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী নূর নবী। আরেকজন ইডেন মহিলা কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তামান্না সুলতানা।
বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে এলাকা
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গতকাল সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে বিকট শব্দ শুনতে পান তাঁরা। হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে ঢাকার সায়েন্সল্যাব এলাকা। ওই প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টারের একটি কাপড়ের দোকানে কাজ করেন মাহবুব আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিকট শব্দ শুনলাম। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চলে গেলে। দ্রুত দোতলা থেকে নিচে নেমে দেখি পাশের ভবন তিনতলা থেকে ইট, জানালার গ্লাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। তিনতলা থেকে কয়েকজন লাফ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। আমরা তাদের লাফ দিতে মানা করি।’
বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে পাশের কাদের আর্কেড ভবন। ওই ভবনের তিনতলায় থাকা একটি কোচিং সেন্টারের জানালার কাচ ভেঙে কয়েকজন শিক্ষার্থী সামান্য আহত হন। ওই ভবনের চারতলার একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন জয়নাল আবেদিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রচণ্ড শব্দের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভবনটি কেঁপে ওঠে। জানালা খোলা থাকায় পাশের ভবনের ভাঙা কাচ এসে আমাদের অফিসে ঢুকে পড়ে। ভূমিকম্প হচ্ছে মনে করে দ্রুত নিচে নেমে আসি।’
হাসপাতালে স্বজনদের আহাজারি
শিরিন ভবনে বিস্ফোরণে যে তিনজন মারা গেছেন, তাঁরা সবাই নিউ জেনারেশন নামের প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। তাঁরা হলেন শফিকুজ্জামান (৪৫), আবদুল মান্নান (৪৫) ও সাদেকুর রহমান (৩২)।
স্বামীর মৃত্যুর খবর শুনে সাভার থেকে ধানমন্ডির বেসরকারি পপুলার হাসপাতালে ছুটে আসেন শফিকুজ্জামানের স্ত্রী পপি খাতুন। স্বামীর মৃতদেহ দেখে তিনি প্রথমে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। পাশে কাঁদছিলেন শফিকুজ্জামানের বড় ভাই মহিউদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৪ বছর ধরে ওই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন আমার ভাই। এক ছেলে ও এক মেয়ের পড়াশোনা ও সংসার চলত ওর উপার্জনের টাকায়।’
পুরান ঢাকা থেকে ছুটে আসেন আবদুল মান্নানের ছেলে মুসাদ্দেক হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাবার মুঠোফোন নম্বর থেকে দুপুরে ফোন আসে। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলা হয়, বাবা গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। শুনে এখানে আসি। এসে দেখি বাবা মারা গেছেন।’ কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মুসাদ্দেক।
এটি দুর্ঘটনা: ডিএমপি কমিশনার
গতকাল দুপুরে বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনটি পরিদর্শন করেন ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক। পরিদর্শন শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এটা একটা দুর্ঘটনা। গ্যাসসহ বিভিন্ন কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তবে ঘটনাস্থলে কোনো বিস্ফোরকের আলামত পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।
বিস্ফোরণের ঘটনায় গতকাল রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি। তবে রাতের মধ্যে এ ঘটনায় মামলা হবে বলে জানান পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) শহীদুল্লাহ।
এদিকে ওই ভবনের তিনতলায় অবস্থিত নিউ জেনারেশনের মালিক আকরাম হোসেন অভিযোগ করেন, ভবনটি খুব ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। ভবনমালিককে বিভিন্ন সময় বিষয়টি জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
তবে গতকাল পর্যন্ত এই ভবনের বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি। এটা আবাসিক নাকি বাণিজ্যিক, সেটাও নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। ভবনটির দোতলার এক পাশে রেস্তোরাঁ, আরেক পাশে কাপড়ের দোকান ও সেলুন রয়েছে। নিচতলার সবগুলোই কাপড়ের দোকান। নিচতলা ও দোতলার কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। দোতলার রেস্তোরাঁয় গ্যাসের লাইন থাকলেও তৃতীয় তলায় আগে কোনো গ্যাস–সংযোগ ছিল কি না; সেটা জানা যায়নি।