ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

বুদ্ধির খেলা দাবা, গ্র্যান্ডমাস্টারদের কথা

দাবা বুদ্ধির খেলা। কিস্তিমাতের খেলা। ‘দাবা’ শব্দটির সঙ্গে সঙ্গে ভাবনায় আসে গালে হাত, কপালে চিন্তার ভাঁজে দুই পক্ষের বোঝাপড়া। ছোট-বড় যাঁরাই খেলেন না কেন, খেলাটি আদতে আপনার মস্তিষ্কের ব্যায়াম। বুদ্ধিকে আরও শাণিত করে তোলার প্রক্রিয়া। হাতি, ঘোড়া, সৈন্য, রাজা ইত্যাদি নিয়ে রাজ্য সামাল দিতে হলে চাই মনোযোগ ও দ্রুত চিন্তা করার ক্ষমতা। নিয়মিত দাবা খেলায় মস্তিষ্ক থাকে সজীব। বুদ্ধির প্রসারে তাই এই খেলা অনন্য।

দাবা খেলার মধ্য দিয়ে নিজের আরও চমৎকার ইতিবাচক দিকগুলো আপনি উন্মুক্ত করতে পারবেন। যেমন নিয়মিত দাবা খেললে স্মৃতিশক্তি ক্রমে বৃদ্ধি পায়। কারণ, দাবা খেলায় যদি আপনি জয় লাভ করতে চান, তাহলে নিজের চাল ও আপনার প্রতিপক্ষের চালের ওপর কড়া নজর রাখতে হবে। স্মৃতিশক্তিকে ঝালাই দিতে এর জুড়ি নেই।

অস্থির-অসহিষ্ণু এই সময়ে দাবা একজন মানুষকে শেখাবে ধৈর্য ধারণের বিষয়টি। সাধারণত একটি দাবা ম্যাচে সময়সীমা ২০ মিনিট থেকে শুরু করে ১ ঘণ্টা পর্যন্ত হতে পারে। আবার কিছু কিছু সময় একটি ম্যাচ ছয় ঘণ্টা বা তার বেশি সময়ও চলে।

দাবা খেলার সম্পূর্ণ ম্যাচ ধরে একজন খেলোয়াড়কে সব সময় প্রতিটি চাল, পরবর্তী কী চাল দিতে হবে, এমন ভাবনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ধীরস্থির হয়ে এই ভাবনার মধ্য দিয়ে ধৈর্যশীলতার ইতিবাচক গুণটি অজান্তেই ধারণ করবেন।

খেলা নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী না–ও হতে পারে। প্রতিপক্ষ যেকোনো সময় সব পরিকল্পনা ধরে ফেলতে পারে। তাই সেই সময় সমস্যা সমাধানে নতুন পথ তৈরির চিন্তা করতে হবে। এটা ব্যক্তিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় সাহায্য করবে।

দাবা গভীর মনোযোগের খেলা। মনোযোগ যদি খেলা থেকে সরে যায়, তাহলে জিততে থাকা ম্যাচও হেরে যেতে পারেন। একজন দক্ষ দাবাড়ু হেরে যেতে পারেন খেলার ছোট ছোট ভুলের জন্য। তাই মনোযোগ বৃদ্ধিতে দাবা বেশ কার্যকর।

এই খেলা সৃজনশীল চিন্তাশক্তি বাড়ায়। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব কিশোর বয়সী ছেলেমেয়ে দাবা খেলে, তারা অন্য ছেলেমেয়েদের তুলনায় একটু বেশি সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত।

দাবা খেলায় বুদ্ধির প্রসারে একজন শিক্ষার্থী তার মধ্যে গুণগত পরিবর্তন আনার সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করতে পারবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে। স্বপ্ন দেখতে পারবে ভবিষ্যৎ গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার।

অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, গ্র্যান্ডমাস্টার আবার কী?

গ্র্যান্ডমাস্টার হলো দাবা খেলার সর্বোচ্চ খেতাব। এটি দাবার আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘ফিদে’ থেকে দেওয়া হয়। গ্র্যান্ডমাস্টারকে সংক্ষেপে বলা হয় জিএম (GM), আর নারীদের ক্ষেত্রে বলা হয় ডব্লিউজিএম (WGM)। গ্র্যান্ডমাস্টার শব্দটি প্রায় এক শতাব্দী পুরোনো। ১৯৫০ সালে আন্তর্জাতিক দাবা ফেডারেশন এই অনন্য পুরস্কার দেওয়া শুরু করে। ১৯৫০ সালে প্রথম ২৭ জনকে গ্র্যান্ডমাস্টার খেতাব দেওয়া হয়। যার মধ্যে ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন মিখাইল বোটভিনিক এবং সেই সময়ের সেরা দাবা খেলোয়াড়েরা। ১৯৫৭, ১৯৬৫ ও ১৯৭০ সালে একাধিকবার গ্র্যান্ডমাস্টারের যোগ্যতা নির্ধারণের মানদণ্ড পরিবর্তিত হয়েছে।

বর্তমানে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ দাবা খেলোয়াড় হলেন ম্যাগনাস কার্লসেন। ২০১৩ সাল থেকে আজ পর্যন্ত ম্যাগনাস হচ্ছেন বিশ্বের সবচেয়ে সফল দাবাড়ু।

তাহলে ২০১৩ সালের আগে কারা ছিলেন? মজার বিষয় হলো এখানে ‘কারা’ শব্দটির জায়গায় ‘কে’ হবে। কারণ, ম্যাগনাসের আগে তাঁর শিক্ষক, তাঁর দাবার গুরু গ্যারি কাসপারভ ২৫৫ মাস ছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দাবা খেলোয়াড়। ২৫৫ মাস, সহজ করে বললে ২১ বছর ৩ মাস। হ্যাঁ, একটানা ২১ বছর দাবার দুনিয়াকে শাসন করে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছিলেন গ্যারি কাসপারভ। এই সময় তাঁকে হারানো তো দূরের কথা, চ্যালেঞ্জ জানানোর মতোও কাউকে পাওয়া যায়নি। তাই বোধ হয় স্বেচ্ছায় ‘গুডবাই’ জানিয়েছিলেন দাবাকে। যেদিন বিদায় নিলেন, সেদিনও তিনি ছিলেন অপরাজেয়। অপ্রতিরোধ্য। ‘দাবার মুকুটহীন সম্রাট’ বলে একবাক্যে গ্যারি কাসপারভকে মেনে নিয়েছে গোটা দুনিয়া।

বিশ্বকাঁপানো দাবাড়ুদের কথা তো জানলাম। এবার ফিরে আসি ঘরের খবরে।

উপমহাদেশে বাংলাদেশ দাবায় ১৯৮৭ সালে প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার পায়। ভারত পায় ১৯৮৮ সালে। বাংলাদেশের নিয়াজ মোর্শেদের পর ভারতের বিশ্বনাথ আনন্দ গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।

নিয়াজ মোর্শেদ বাংলাদেশের দাবার কিংবদন্তি। মাত্র ২১ বছর বয়সে গ্র্যান্ডমাস্টার হয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। ক্রীড়াক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখায় ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক স্বাধীনতা দিবস পুরস্কারে ভূষিত হন নিয়াজ মোর্শেদ।

২০০৫ সালে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গ্র্যান্ডমাস্টার পদকটি পান জিয়াউর রহমান। তিনি বাংলাদেশি দাবাড়ুদের মধ্যে সর্বোচ্চ ফিদে রেটিং অর্জন করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ থেকে গ্র্যান্ডমাস্টার হন রিফাত বিন সাত্তার, আবদুল্লাহ আল রাকিব ও এনামুল হোসেন রাজীব—এই পাঁচজন। ১৯৮৫ সালে রাণী হামিদ ‘আন্তর্জাতিক মহিলা দাবা মাস্টার’ খেতাব পান। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত তিনিই একমাত্র নারী, যিনি এ খেতাব অর্জন করেন।

দাবার গুরুত্ব বিবেচনা করেই ভবিষ্যৎ গ্র্যান্ডমাস্টার তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে ‘মার্কস অ্যাকটিভ স্কুল’। শুরু হয়েছে দেশজুড়ে স্কুলভিত্তিক দলগত দাবা প্রতিযোগিতা। ‘হয়ে ওঠো আগামীর গ্র্যান্ডমাস্টার’ স্লোগানে এই প্রতিযোগিতা দেশের স্কুলভিত্তিক দলগত দাবার সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্ট। প্রতিযোগিতায় ৬৪ জেলা থেকে আগত শিক্ষার্থীরা লড়বে পরস্পরের বিপক্ষে। দলগত এই প্রতিযোগিতায় নিজ নিজ স্কুল বা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিত্ব করবে শিক্ষার্থীরা। স্কুলভিত্তিক দলগুলো শুরুতে খেলবে জেলা পর্যায়ে। এরপর জেলা পর্যায়ের বিজয়ী দলগুলো অংশ নেবে বিভাগীয় পর্যায়ে। তারপর বিভাগীয় পর্যায়ের বিজয়ী দলগুলো অংশ নেবে রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত জাতীয় অর্থাৎ চূড়ান্ত পর্যায়ে।