মশার প্রাণরাসায়নিক চরিত্র এবং আচরণগত পরিবর্তন কী হয়েছে, তা নিয়ে নিয়মিত গবেষণা হওয়া দরকার।
ডেঙ্গু মোকাবিলার মূল আলোচনা শহরকেন্দ্রিক, মূলত রাজধানী ঢাকাকে ঘিরে। বাস্তবে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু রোগী বেশি। রোগতত্ত্ববিদেরা বলছেন, ঢাকার বাইরের বাস্তব পরিস্থিতির কোনো চিত্র কারও জানা নেই।
ডেঙ্গু পরিস্থিতি পর্যালোচনায় গতকাল রোববার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা ও জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) যৌথভাবে আয়োজিত এক বৈঠকে এই বক্তব্য উঠে আসে।
বৈঠকে বিশেষজ্ঞরা ডেঙ্গু প্রতিরোধে ঘাটতির নানা দিক তুলে ধরেন। তাঁরা বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে গ্রামে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া দরকার। ঢাকার বাইরে ভিন্ন ধরনের মশায় মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।
ঢাকার একটি হোটেলে আয়োজিত ওই বৈঠকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, সরকার একজন ডেঙ্গু রোগীর পেছনে গড়ে ৫০ হাজার টাকা খরচ করছে। এ বছর এ পর্যন্ত ডেঙ্গুর জন্য ৪০০ কোটি টাকা খরচ করেছে সরকার।
এ বছর ৬৪ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ কোন ধরনের মশায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছে, তা আমরা জানি না।অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা
স্বাস্থ্যমন্ত্রী এই হিসাব দেওয়ার কিছু সময় পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম গণমাধ্যমকে জানায়, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় (শনিবার সকাল ৮টা থেকে রোববার সকাল ৮টা পর্যন্ত) দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এ বছর মোট ৫৪৮ জনের মৃত্যু হলো। এর মধ্যে ঢাকার শহরের হাসপাতালে মারা গেছেন ৪০৪ জন এবং ঢাকা শহরের বাইরে মারা গেছেন ১৪৪ জন।
সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে নতুন ২ হাজার ৩২৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা শহরের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ৯২০ জন এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৪০৭ জন রোগী।
মশার প্রাণরাসায়নিক চরিত্র এবং মশার আচরণগত পরিবর্তন কী হয়েছে, তা নিয়ে নিয়মিত গবেষণা হওয়া দরকার।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান মো. গোলাম ছারোয়ার
কন্ট্রোল রুমের তথ্য বলছে, দেশে এ পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১ লাখ ১৪ হাজার ৫১১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে ভর্তি হয়েছেন ৬০ হাজার ১০২ জন এবং ঢাকা শহরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন ৫৪ হাজার ৪০৯ জন। অর্থাৎ ঢাকার বাইরে রোগী বেশি। রোগতত্ত্ববিদেরা বলছেন, ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু এত রোগী এই প্রথম দেখা গেল।
গতকালের অনুষ্ঠানে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, ২০১৯ সালে কুষ্টিয়া ও যশোরের একাধিক গ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া গিয়েছিল। তখন আইইডিসিআরের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়ে যে ওই সব গ্রামে ডেঙ্গু ছড়িয়েছিল এডিস অ্যালবোপিক্টাস নামের মশা।
রোগতত্ত্ববিদ ও কীটতত্ত্ববিদেরা বলছেন, ডেঙ্গু ছড়ায় এডিস মশা। এডিস দুই ধরনের—এডিস ইজিপ্টাই ও এডিস অ্যালবোপিক্টাস। এডিস ইজিপ্টাই থাকে মূলত শহরে। অন্যদিকে এডিস অ্যালবোপিক্টাস সক্রিয় থাকে গ্রামাঞ্চলে। এরা গাছের কোটরে, কলাগাছের বাকলের মধ্যে বা কচুপাতায় থাকা সামান্য পানিতে ডিম পাড়ে।
অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, ‘এ বছর ৬৪ জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ কোন ধরনের মশায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছে, তা আমরা জানি না।’ তিনি আরও বলেন, শহরের মানুষকে পানি জমিয়ে রাখতে নিষেধ করা হয়। কিন্তু গ্রামের মানুষের পানি না জমিয়ে উপায় থাকে না। তাহলে ডেঙ্গু মোকাবিলায় গ্রামের মানুষের জন্য কী বার্তা দেওয়া হবে?
একই অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ও বাংলাদেশ মেডিসিন সোসাইটির মহাসচিব আহমেদুল কবীর বলেন, ডেঙ্গুর একাধিক ধরনে মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। ডেঙ্গুর যেসব লক্ষণ বা উপসর্গ এ বছর দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে আগামী বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের পরিস্থিতি আরও জটিল হওয়ার ঝুঁকি আছে।
অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান মো. গোলাম ছারোয়ার বলেন, ওষুধ প্রয়োগের পদ্ধতি সঠিক না হলে মশা নিয়ন্ত্রণ হবে না। ওষুধ ছিটানোর সময় ওষুধের সঙ্গে পানির ফোঁটার আকার ঠিক না থাকলে মশা মরবে না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যসচিবের উদ্দেশে এই কীটতত্ত্ববিদ বলেন, ‘মশার প্রাণরাসায়নিক চরিত্র এবং মশার আচরণগত পরিবর্তন কী হয়েছে, তা নিয়ে নিয়মিত গবেষণা হওয়া দরকার।’
গতকালের বৈঠকে দেশের শীর্ষস্থানীয় রোগতত্ত্ববিদ, কীটতত্ত্ববিদ বা জনস্বাস্থ্যবিদেরা কেউ উপস্থিত ছিলেন না। কারণ, তাঁদের আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। অন্যদিকে সারা দেশে মশা নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্ব স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের। অনুষ্ঠানে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকলেও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রতিনিধি বা কর্মকর্তাকে দেখা যায়নি।
বৈঠকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ছাড়াও শিক্ষা, গণপূর্ত, তথ্য মন্ত্রণালয়, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। এতে মুক্ত আলোচনা পর্ব সঞ্চালনা করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা বেশ কিছু সুপারিশ করেন। এর মধ্যে রয়েছে ডেঙ্গু নিয়ে সারা বছর কাজ করতে হবে, ডেঙ্গু মোকাবিলায় মূল জোরটা দিতে হবে প্রতিরোধে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়কে ডেঙ্গু মোকাবিলার কাজে সম্পৃক্ত হতে হবে, ডেঙ্গু বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে একটি জাতীয় কমিটি হওয়া দরকার, মশা নিধনে ব্যবহৃত ওষুধ কার্যকর কি না তা নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে, মশার ওষুধ ছিটানোর প্রক্রিয়া বিজ্ঞানসম্মত হতে হবে এবং মশকনিধন কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। অনুষ্ঠানের শুরুতে রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পক্ষ থেকে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একটি উপস্থাপনা তুলে ধরা হয়।
আলোচনায় অংশ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ডেঙ্গুর মতো হঠাৎ কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় স্বাস্থ্য বিভাগের নিয়মিত কোনো বরাদ্দ নেই। নিয়মিত বরাদ্দ থাকা দরকার। কারণ, জরুরি সময়ে স্বাস্থ্য খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অর্থের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
স্বাস্থ্যসচিব (স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ) আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, তাঁদের হিসাবে সারা দেশে এ পর্যন্ত ৬ থেকে ১০ বছর বয়সী ২৭টি শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এর মধ্যে ছেলেশিশু ১৫টি ও মেয়েশিশু ১২টি।
অনুষ্ঠানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রতিনিধি বর্ধন জং রানা বলেন, বাংলাদেশে যখনই ডেঙ্গু সমস্যা দেখা দিয়েছে, তখনই বাংলাদেশকে সহায়তা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
ইউনিসেফের প্রতিনিধি সেলডন ইয়েট বলেন, ডেঙ্গু মোকাবিলায় সরকারকে ২২ লাখ মার্কিন ডলার (২৪ কোটি টাকা) আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে ইউনিসেফ।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম। এতে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের প্রতিনিধি প্রীতি চক্রবর্তী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে একই পরিবারের দুটি শিশু মারা যাওয়ার ঘটনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এই কষ্ট শুধু ওই পরিবারই বুঝতে পারে।