একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ শুধু ঢাকা আর ইসলামাবাদের মধ্যে আটকে ছিল না। অনেক দৌড়ঝাঁপ হয়েছে কলকাতা, দিল্লি, ওয়াশিংটন, মস্কো আর বেইজিংয়ে। কূটনৈতিক লড়াই হয়েছে জাতিসংঘে। সব ছাপিয়ে সামনে এসেছে মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা। অনেক ঐতিহাসিক দলিলের সূত্র ধরে সম্প্রতি প্রথমা প্রকাশন থেকে বের হয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসবিষয়ক গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের বই ১৯৭১: ভারতের বাংলাদেশ যুদ্ধ। বইটি থেকে ‘ক্র্যাকডাউন’ শিরোনামে অধ্যায়ের কিছু অংশ পাঠকদের জন্য প্রকাশ করা হলো।
১৯৬৯ সালের পয়লা মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সদস্য ছিল প্রায় ২৫ হাজার। মার্চের (১৯৬৯) পর সামরিক বাহিনীতে যোগ হয় আরও সাড়ে ৮ হাজার সদস্য। এ ছাড়া আধা সামরিক বাহিনী ইপিআরে ছিল ১৩ হাজার সদস্য। তাদের অর্ধেকের মতো সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে।
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য পাঠানো হতো বাণিজ্যিক জাহাজে করে। অফিসারদের সচরাচর পাঠানো হতো বিমানে। জাহাজে করাচি থেকে চট্টগ্রাম আসতে সাত-আট দিন লেগে যেত।
ভারতের ওপর দিয়ে সব ধরনের পাকিস্তানি বিমান ওড়া নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তান বিমানবাহিনী ও অসামরিক বিমান চলাচল সংস্থা পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসের (পিআইএ) ক্ষমতা অনেক কমে যায়। আকাশপথে ঢাকা-করাচি সরাসরি দূরত্ব যেখানে ২ হাজার ৩৭০ কিলোমিটার, সেখানে কলম্বো হয়ে আসায় দূরত্ব বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৫৭৫ কিলোমিটার। অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ। পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে পাঁচটি সি-১৩০বি এবং একটি সি-১৩০ই পরিবহন বিমান ছিল। ই মডেল ছাড়া অন্যগুলোকে জ্বালানি নিতে কলম্বোয় নামতে হতো। বেশির ভাগ সৈন্য যাতায়াত করত পিআইএর মাধ্যমে।
পিআইএর ৭টি বোয়িং ৭০৭ বিমানের প্রতিটিতে ২০২ জন এবং ৪টি ৭২০বি বিমানের প্রতিটিতে ১১২ জন যেতে পারে। এগুলো করাচি থেকে কোথাও না থেমে ঢাকায় যেতে পারে। বিমানবাহিনীর তিন-চতুর্থাংশ বিমান এবং পিআইএর সব বিমান ব্যবহার করে এক যাত্রায় বড়জোর দুই হাজার সৈন্য পাঠানো সম্ভব। একমুখী যাত্রায় বোয়িং ৭০৭-এর সময় লাগে ৫ ঘণ্টা এবং সি-১৩০বি পরিবহন বিমানের লাগে ১১ ঘণ্টা। রক্ষণাবেক্ষণের কাজে কিছু কিছু বিমান নিয়মিত বসিয়ে রাখতে হয়। এ জন্য তাদের যাত্রী পরিবহনক্ষমতা দিন দিন কমে যায়।১
১ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত করাচি থেকে চট্টগ্রামে আসা ১৪টি বাণিজ্যিক জাহাজের মধ্যে ১০টিতে মালামাল, একটিতে সৈন্য ও তিনটিতে মালামাল ও সৈন্য আসে। ১ মার্চ করাচির জাপানি কনসাল জেনারেল মার্কিন কনসাল জেনারেলকে বলেন, সম্প্রতি দুই জাহাজবোঝাই অনেক সৈন্য করাচি ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। একটি জাহাজ পরিবহন সংস্থার মাধ্যমে এটা জানা গেছে। অর্থাৎ এর ফলে এক ব্যাটালিয়নের মতো সৈন্য পাঠানো যাচ্ছে।২
ঢাকার মার্কিন কনস্যুলেট অফিস সাগরপথে সৈন্য চলাচল সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাচ্ছিল না। আর্চার ব্লাডের বিবরণ থেকে জানা যায়:
হঠাৎ দেখা গেল ঢাকা বিমানবন্দরে বিমানযোগে অনেক সৈন্য আসছে। আমি দেখেছি, প্রায় ১০০ জন তরুণ পিআইএর একটি বিমান থেকে নামল। তাদের সবার পরনে একই রকম হাফ শার্ট আর পাতলা কাপড়ের ‘চিনাপ্যান্ট’। তারা লাইন করে দাঁড়াল এবং সুশৃঙ্খলভাবে হেঁটে গেল। মার্চ মাস থেকে সংখ্যাটি বাড়ছে।৩
পাকিস্তানের পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছিল মার্কিন প্রশাসন। ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হামলার ফলে দৃশ্যপট পাল্টে যায়। ২৯ মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে ফোনে কথা হয় তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের। তাঁদের কথোপকথন ছিল এ রকম—
কিসিঞ্জার: মনে হয় ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে।
নিক্সন: ভালো। শক্তি প্রয়োগ করা অনেক সময়...
কিসিঞ্জার: প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শক্তিপ্রয়োগ অনেক সময় কাজে দেয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৩০ হাজার সৈন্য সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে বশে রাখতে পারবে না। এটা সত্য হতে পারে। তবে এখন সবকিছু শান্ত।
নিক্সন: মনে হয় পরিস্থিতি বদলে গেছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে, ৩০ হাজার সুশৃঙ্খল লোক সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে যেকোনো সময় দমন করতে পারে। ইনকা ও অন্যদের দখলে আনতে স্পেনীয়রা একই কাজ করছিল। ব্রিটিশরাও তো এ রকম করেছিল ভারতে।
যাহোক, আমি ইয়াহিয়ার ভালো চাই। টুকরা টুকরা হয়ে যাওয়ার চেয়ে অখণ্ড পাকিস্তানই ভালো। প্রশ্ন হলো, এমন একটা জাহান্নাম কেউ চালাতে পারে কি না।
কিসিঞ্জার: ঠিক কথা। ইতিহাসে দেখা যায়, বাঙালিকে শাসন করা খুব কঠিন।৪
কিসিঞ্জার অবশ্য ওয়াশিংটনে ভারতের রাষ্ট্রদূতকে বলেছিলেন, ‘পেন্টাগন ও অন্য সবখানে আমাদের সকল বিশেষজ্ঞ এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা পূর্ব বাংলার মানুষকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না। এমন হতে পারে যে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। আমাদের কী আর করার আছে। ম্যাকিয়াভেলির পথ ধরে আমরা ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিচ্ছি—আপনার কী মনে হয়?৫
সাবেক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান জানতেন একদিন পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাবে। ক্ষমতায় থাকাকালে তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিনকে তিনি বলেছিলেন, তিনি যে দ্বিতীয় রাজধানী (বর্তমানে শেরেবাংলা নগর) তৈরি করে দিয়েছেন, এটি একদিন তাঁদের কাজে লাগবে। তথ্যসচিব আলতাফ গওহরকে ডেকে তিনি বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে গেলে তার অর্থনৈতিক পরিণতি কী হবে, সেটি খতিয়ে দেখার জন্য একটা কমিশন নিয়োগ করা হোক। ১ জানুয়ারি ১৯৭১ তিনি তাঁর ডায়েরিতে লিখলেন:
পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়ে ও প্রতিহিংসার মনোভাব নিয়ে মুজিবুর রহমান নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেন। ছয় দফার ব্যাপারে যতটুকু আপস করার সুযোগ ছিল, তিনি চাইলেও এখন আর তা সম্ভব হবে না। তিনি আর স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে পারছেন না। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারাগারে তিনি আজ বন্দী। তিনি যদি কোনোরকম আপস করেন, তাহলে মানুষ তাঁকে স্বার্থপর ও বেইমান বলবে। সুতরাং তিনি তাঁর চরমপন্থা থেকে সরে আসবেন বলে মনে হয় না। ভুট্টো তাঁর সঙ্গে একটা আপসে যেতে পারেন। কিন্তু তা একটা পর্যায় পর্যন্ত। তিনিও পশ্চিম পাকিস্তানকে বেচে দেওয়ার দায় নেবেন না।
সুতরাং পরিণতি হলো দুটো স্বশাসিত অঞ্চল। যদিও কিছু বাঙালি পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পদের হিস্যা নেওয়ার কথা ভাবছে, সেটি একসঙ্গে থাকার পক্ষে যথেষ্ট নয়।
অতএব, যত তিক্তই হোক, একটা চূড়ান্ত ফয়সালার ব্যাপারে প্রত্যেক পাকিস্তানিকে তৈরি থাকতে হবে। আমার প্রস্তাব হলো, বাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তান যার যার সম্পদ নিজ হেফাজতে রেখে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের প্রয়োজন মেটাক। খাজা শাহাবুদ্দিন মনে করেন, বাংলার জন্য এটি যথেষ্ট নয়। আমি তাঁকে বলেছি, যদি তা-ই হয়, তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর এ নাটক কেন?
আমার মনে হয়, দিন যত গড়াবে, বাঙালিরা ততই বুঝতে পারবে তারা উভয়সংকটে পড়েছে। কিন্তু তারা কোনো সমাধান দেবে না। তারা সমস্যা তৈরির সহজাত কৌশল নিয়েই মেতে থাকবে।
দেশের মানুষ মুজিবুর রহমান ও ভুট্টোর হাতে তাদের ভাগ্য সঁপে দেওয়ায় আমি কৌতূহলী হচ্ছি। তাদের একজন শিক্ষিত ও আধুনিক, অন্যজন অশিক্ষিত, মাথামোটা। খাজা শাহাবুদ্দিন বলেছেন, পুরোনো রাজনীতিবিদদের ওপর মানুষ আস্থা হারিয়েছে এবং এ দুজনই তাদের ভরসা। আমি মনে করি, কথাটা ফেলনা নয়।
খাজা শাহাবুদ্দিনকে আমি বলেছি, আমি স্পষ্ট দুটি প্রবণতা দেখছি। একটি হলো সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমের নামে গোলযোগ ও অরাজকতা, অন্যটি হলো বিচ্ছিন্নতা ও দুই অংশের আলাদা হয়ে যাওয়া।৬
ভাবতে অবাক লাগে, একাত্তরের জানুয়ারিতে রাজনীতিবিদেরা এবং দেশের মানুষ যখন নতুন সরকার নিয়ে ভাবছে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দর-কষাকষি চলছে, আইয়ুব খান তখন ভবিষ্যৎ পড়তে পারছেন।
২৫ মার্চের সামরিক অভিযানের পর পাকিস্তান সরকার পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপের অভিযোগ তোলে এবং বিশ্বের সব দেশকে এ ব্যাপারে নিন্দা জানাতে বলে। ২৭ মার্চ যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ও ২৯ মার্চ যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাকিস্তানের চাওয়া অনুযায়ী একটি মীমাংসার কথা বলেন। এপ্রিলের শেষ দিকে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট পম্পিডু ইয়াহিয়ার বিশেষ দূতকে বলেন, ফ্রান্স প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে মানবিক, নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে সবকিছুর সমাধান চায়।৭
অনারব মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে প্রথম প্রতিক্রিয়া জানায় ইরান ও ইন্দোনেশিয়া। ২৮ মার্চ তারা পাকিস্তান সরকারের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে। ৩ এপ্রিল সমর্থন জানায় তুরস্ক ও মালয়েশিয়া। আরব দেশগুলোর সমর্থন আসে ধীরে ধীরে। তিন মাস পর জেদ্দায় অনুষ্ঠিত ২২টি মুসলিম দেশের একটি সম্মেলনে পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি ও অখণ্ডতার প্রতি সমর্থন জানিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রম ছিল মিসর। যদিও শুরুর দিকে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত পাকিস্তানের সংহতির প্রতি সমর্থন দিয়েছিলেন, তাঁর সরকার পরে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্য হিসেবে ভারতের প্রতি সহানুভূতি জানায়। মিসরের এ প্রতিক্রিয়া প্রকারান্তরে বাংলাদেশের পক্ষে আসে।৮
ঢাকায় পাকিস্তানের সামরিক অভিযান ও হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জানতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সংবাদপত্রের প্রতিবেদন পড়ার দরকার হয়নি। ঢাকায় মার্কিন কনস্যুলেটের কাছে একটা গোপন রেডিও ট্রান্সমিটার ছিল। ঢাকায় ধ্বংসযজ্ঞ চলাকালে শুরুর দিনগুলোয় মার্কিন কনস্যুলেট এ ব্যাপারে বিস্তারিত প্রতিবেদন পাঠাতে সক্ষম হয়। একটি প্রতিবেদনে ছিল, কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্রাবাসে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা আগুন দিয়েছিল এবং ছাত্ররা পালিয়ে যাওয়ার সময় মেশিনগান দিয়ে গুলি করা হয়েছিল।
প্রতিবেদনটি পররাষ্ট্র দপ্তরে এবং জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে হেনরি কিসিঞ্জারের সব সহকর্মীকে দেওয়া হয়। অনেক দেশ পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত নৃশংসতার নিন্দা জানালেও হোয়াইট হাউসের নির্দেশে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ছিল নীরব। ২০ এপ্রিল ঢাকার মার্কিন কনস্যুলেটের ২০ জন কর্মকর্তা মার্কিন সরকারের নীতির ব্যাপারে ভিন্নমত দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানান। তাঁরা বলেন, ‘আমাদের সরকার গণতন্ত্র দমনের এ ঘটনায় নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে।’৯
ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও নিউইয়র্কের সাবেক সিনেটর কেনেথ কিটিং ‘গণহত্যা’ প্রসঙ্গে তাঁর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। ২৯ মার্চ ওয়াশিংটনে পাঠানো এক তারবার্তায় তিনি নিক্সন প্রশাসনকে পাকিস্তানের সামরিক সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক এড়িয়ে চলার অনুরোধ করেন। নিক্সন ঢাকার কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাডকে বদলি করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সরিয়ে আনেন এবং বেশি আবেগ দেখানোর জন্য কিটিংকে ভর্ৎসনা করেন। এ প্রসঙ্গে কিসিঞ্জার বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী শক্তি প্রদর্শনের কৌশল নিয়েছে।
তবে আমেরিকায় যাঁরা পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে প্রশাসনের চুপচাপ থাকার সমালোচনা করছেন, তাঁদের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়ায় যারা মারা যাচ্ছে, তাদের নিয়ে সমালোচকদের কোনো মাথাব্যথা নেই; বরং যেকোনো ইস্যুতে তারা সরকারের অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাদের বিশ্বাস, এসব বললে ভিয়েতনামে আমাদের চেষ্টা ভন্ডুল হয়ে যাবে।’১০
২৫ মার্চ কি অনিবার্য ছিল? এটি কি এড়ানো যেত না? একাত্তরের পুরো মার্চ ধরেই আলোচনা হয়েছে বিস্তর। পাকিস্তানের রাজনীতির প্রধান দুই অনুঘটক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও ভুট্টোর মধ্যকার আলোচনায় দৃশ্যত কোনো মীমাংসা হয়নি। দুজনের কেউই পাকিস্তানের একতা ও সংহতি নিয়ে মাথা ঘামাননি। পাকিস্তান ভাঙে তো ভাঙুক, এটিই দুজনের জন্য সুবিধাজনক ছিল। কিন্তু সমস্যা হলো ভাঙার দায় একে অন্যের ওপর চাপাতে চেয়েছিলেন। ফলে দায় এসে বর্তায় ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাঁধে। এটি বুঝতে পেরে ইয়াহিয়া দুজনকেই নমনীয় হতে এবং আলোচনা চালাতে অনুরোধ করেছিলেন।১১
২৫ মার্চের সামরিক অভিযান ছিল নৃশংস ও ভয়াবহ। ওই সময় লে. জেনারেল টিক্কা খান যুগপৎ গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বে ছিলেন। ১০ এপ্রিল তাঁর কাছ থেকে সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব বুঝে নেন লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি। অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কে নিয়াজি বলেন:
একাত্তর সালের ২৫/২৬ মার্চ জেনারেল টিক্কা আঘাত হানেন। সুনসান রাত বিলাপ, কান্না আর আগুনে পুড়ল। জেনারেল টিক্কা তাঁর শক্তির সবটুকুই ব্যবহার করলেন। বিপথগামী ও বিভ্রান্ত দেশবাসীকে সামাল না দিয়ে তিনি যেন শত্রুকে আক্রমণ করলেন। সামরিক অভিযানটি ছিল নিষ্ঠুর, যা বোখারা ও বাগদাদে চেঙ্গিস খান ও হালাকু খানের অথবা জালিয়ানওয়ালাবাগে জেনারেল ডায়ারের আক্রমণের চেয়েও নৃশংস।
বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র ও বাঙালি নেতাদের গ্রেপ্তারের দায়িত্ব ছিল তাঁর। এটা না করে তিনি পোড়ামাটি নীতির আশ্রয় নেন। ফরমান আলী তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের মাটি লাল করে দিতে হবে।’ সৈন্যদের তিনি বলেছিলেন, ‘আমি মাটি চাই, মানুষ চাই না।’১২
তথ্যসূত্র
১. Blood, Archer K (2002), The Cruel Birth of Bangladesh: Memoirs of an American Diplomat, UPL, Dhaka pp. 177-178
২. lbid
৩. lbid, p. 179
৪. FRUS, Nixon-Kissinger Telecom, 29 March 1971, pp. 35-36; Bass, Garry J (2013), The Blood Telegram; Nixon, Kissinger, and a Forgotten Genocide, Alfred A Knoph, New York, pp. 64-65
৫. lbid
৬. Baxter, Craig, ed (2007), Diaries of Field Marshal Mohammad Ayub Khan, 1966-1972, Oxford University Press, Karachi p. 435
৭. Jackson, Robert (1974), South Asian Crisis: India-Pakistan-Bangladesh, Vikas Publishing House, New Delhi, pp. 38-39
৮. lbid
৯. Hersh, Seymour M (1983), The Price of Power: kissinger in the Nixon White House, Summit Books, New York, p. 444
১০. lbid, pp. 444-445
১১. Khan, Arshad Sami (2008), Three Presidents and an Aide Life, Power and Politics, Pentagon Press, New Delhi, pp. 150-151
১২. Niazi, Amir Abdullah Khan (1999), The Betrayal of East Pakistan, Oxford University Press, Karachi, pp. 45-46; Ahmed (2013), pp. 177-178