ঠিকাদারদের মারধরের শিকার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) আড়াই হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মো. গোলাম ইয়াজদানীর আর সংস্থাটিতে আসার ইচ্ছা নেই।
‘মানসিকভাবে বিপর্যস্ত’ এই প্রকৌশলী স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন। গতকাল বুধবার বিকেলে তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে এসব কথা বলেন।
গোলাম ইয়াজদানী বর্তমানে তাঁর ঢাকার বাসায় অবস্থান করছেন। তিনি সাধারণত বুধ ও বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে অফিস করেন। বাকি তিন কর্মদিবস ঢাকায় এলজিইডিতে অফিস করেন। তবে আজ বৃহস্পতিবার ও গতকাল বুধবার গোলাম ইয়াজদানী সিটি করপোরেশনে তাঁর দপ্তরে আসেননি।
কাজ না পেয়ে প্রকল্প পরিচালক গোলাম ইয়াজদানীকে গত রোববার বিকেলে নগরের টাইগারপাসে সিটি করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়ে তাঁর দপ্তরে ঢুকে মারধর করেন একদল ঠিকাদার। এ সময় প্রকল্প পরিচালকের টেবিল ও নামফলক ভেঙে ফেলা হয়।
মারধরের ঘটনায় সেদিন রাতেই নগরের খুলশী থানায় মামলা হয়। সিটি করপোরেশনের নিরাপত্তা কর্মকর্তা মো. কামাল উদ্দিন বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলায় আসামি হিসেবে ১০ জন ঠিকাদারের নাম উল্লেখ করা হয়। ৫ থেকে ১০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। মামলায় তিন ঠিকাদারসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁরা এখন কারাগারে।
গতকাল দুপুরে সিটি করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, প্রকল্প পরিচালকের কক্ষটি বন্ধ। নামফলকটি ভাঙা অবস্থায় রয়েছে। নিচে পড়ে আছে নামফলকের ভাঙা টুকরা। কক্ষের সামনে কোনো লোকজন দেখা যায়নি।
গতকাল দুপুরে সিটি করপোরেশন কার্যালয়ের প্রধান ফটকের বাইরে দেখা হয় প্রকল্প পরিচালক দপ্তরের অফিস সহায়ক তিলক সিংহের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্যার আজ (বুধবার) আসেননি। আগামীকালও (বৃহস্পতিবার) আসার সম্ভাবনা কম। তাঁর সঙ্গে ফোনে একবার কথা হয়েছিল। তিনি চিকিৎসা নিচ্ছেন। ঢাকার বাসায় আছেন বলে জানিয়েছেন।’
গোলাম ইয়াজদানী এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় গত বছরের ১৪ আগস্ট তাঁকে প্রেষণে ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতায় বিমানবন্দর সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন’ প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়। তাঁর আগে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামসহ দুজন প্রকল্পটির পরিচালক ছিলেন।
প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব নিয়ে নিয়মকানুন মেনে সব কাজ করতে উদ্যোগী হন গোলাম ইয়াজদানী। কিন্তু ঠিকাদারদের একটি দল চেয়েছিল উন্নয়নকাজ ভাগাভাগি করে নিতে। এ জন্য তারা তদবিরও করেছিল। কিন্তু তা আমলে নেননি প্রকল্প পরিচালক।
গোলাম ইয়াজদানীর দায়িত্ব পালনকালে প্রকল্পের প্রথম ধাপের ২২০ কোটি টাকার ৩৭টি ভাগের (লট) কাজে নিয়মের কড়াকড়িতে বাদ পড়তে যাচ্ছেন বেশ কয়েকজন ঠিকাদার। এটা জেনে বাদ পড়তে যাওয়া ঠিকাদারেরা জোট বেঁধে গোলাম ইয়াজদানীর ওপর হামলা চালান।
হামলার দিন সন্ধ্যায় গোলাম ইয়াজদানী চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় চলে যান। গত রোববার সিটি করপোরেশনের সাধারণ সভা ছিল। এ জন্য তিনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে এসেছিলেন। পরে আবার ঢাকায় চলে যান।
গতকাল বিকেলে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে গোলাম ইয়াজদানী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। আমার তো আর সেখানে (সিটি করপোরেশন) যাওয়ার ইচ্ছা নেই। আমি এখন ছুটিতে আছি।’
পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে গোলাম ইয়াজদানী বলেন, ‘এলজিইডি অফিসে গিয়ে স্যারদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেব। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলব। তাই এই মুহূর্তে কিছু বলতে পারছি না।’
সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে তাঁদের নিয়মিত যোগাযোগ আছে। তিনি কিছুদিনের জন্য ছুটি নিয়েছেন।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, প্রকল্প পরিচালক বর্তমানে চিকিৎসকের পরামর্শে ঢাকার বাসায় বিশ্রামে আছেন। মেয়রের অনুমতি নিয়ে আপাতত তিনি অফিস করছেন না। আর চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে অফিসে করার ইচ্ছা নেই—এ রকম কিছু তাঁদের তিনি বলেননি। তাঁর সঙ্গে মঙ্গলবার কথা হয়েছে।
পাল্টে গেছে সিটি করপোরেশন কার্যালয়ের চিত্র
প্রকল্প পরিচালকের ওপর হামলার ঘটনার পর সিটি করপোরেশনের চিত্র পাল্টে গেছে। আগে প্রধান ফটক দিয়ে যে কেউ প্রবেশ করতে পারতেন। কিন্তু এখন প্রবেশ করতে চাইলে নিজের পরিচয় দিতে হয়। দর্শনার্থী কোন কর্মকর্তার কাছে বা কোন দপ্তরে যাবেন, তা প্রধান ফটকে লিপিবদ্ধ করা হচ্ছে।
প্রধান ফটকে সশস্ত্র আনসার সদস্য নিয়োগ দেওয়ার কথা থাকলেও তা এখন পর্যন্ত হয়নি। আপাতত সিটি করপোরেশনের নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মীরা দায়িত্ব পালন করছেন।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল ও হিসাব বিভাগে ঠিকাদারদের আনাগোনা একেবারে কমে গেছে। প্রধান কার্যালয়ের তিনতলায় প্রধান প্রকৌশলী, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলীরা বসেন। চারতলায় আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প পরিচালক, যান্ত্রিক শাখার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও নির্বাহী প্রকৌশলীদের দপ্তর।
পঞ্চম তলায় রয়েছে হিসাব বিভাগ। প্রকৌশল ও হিসাব বিভাগে সব সময় ঠিকাদার ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ভিড় লেগে থাকত। কিন্তু রোববারের পর থেকে তা আর নেই। হাতে গোনা কয়েকজন ঠিকাদার এলেও তাঁদের বেশিক্ষণ অবস্থান করতে দেখা যায়নি।
প্রকৌশলী ও হিসাব বিভাগের তিন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের এখন কোনো কাজের চাপ নেই। প্রকল্প পরিচালকের ওপর হামলার ঘটনার পর ঠিকাদারদের আসা একদম কমে গেছে।